পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

করিম সাহেবের চিন্তা-ভাবনা ও হাঁসমুরগীর ছানাপোনা-পর্ব এগারো

(দশম পর্বের পর হতে)

করিম সাহেব হরিদাসের কথা শুনে বললোঃ

-দাদা তুমিতো বললে এই জ্ঞান লাভ করতে হলে সদ্ গুরুর কাছে যেতে হবে। তারপর তার থেকে এই পরমতত্ত্ব জ্ঞান লাভ করতে হয়। তার মানে তুমি গুরু ধরেছো।

-অবশ্যই ধরেছি। না ধরলে এই তত্ত্ব কথা জানলাম কিভাবে?

-এইসব তত্ত্বকথাতো এখন বই থেকে পাওয়া যায়। যে কেউ বই পুস্তক পাঠ করে এই বিদ্যা অর্জন করতে পারে। তাই না?

-হ্যাঁ তা পারে। কিন্ত্তু উপলব্দি করার ক্ষমতা থাকবে না। অর্থাৎ সে বুঝতে পারবে না এই দেহজগতে কোথায় কিরুপ লীলা খেলা চলে? যেমন ধরো শ্রীকৃষ্ণ এবং অর্জুনের কথা। একটি গাছে দুটি পাখি- একটি জীবাত্মা অন্যটি পরমাত্মা (শ্রীকৃষ্ণ) মুণ্ডক উপনিষদ ও শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে আত্মা ও পরমাত্মাকে একই গাছে বসে থাকা দুটি পাখির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে একটি পাখি (জীবাত্মা) সেই গাছের ফল খাচ্ছে অন্য পাখিটি (শ্রীকৃষ্ণ) তাঁর বন্ধুকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছেন। এই দুটি পাখি গুণগতভাবে যদিও এক, তবুও তাদের একজন সেই জড়-জাগতিক গাছের ফলের আকর্ষণে আবদ্ধ, আর অন্য জন একান্ত সুহৃদের মতো তার কার্যকলাপ কেবল পর্যবেক্ষণ করে চলেছেন। শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন স্বাক্ষীরূপ পাখি আর অর্জুন হচ্ছেন ফল আহারে রত পাখি। যদিও তাঁরা একে অপরের বন্ধু তবুও তাঁদের একজন হচ্ছেন প্রভু এবং অন্য জন হচ্ছেন ভৃত্য। জীবাত্মা পরমাত্মার সঙ্গে তার এই সম্পর্কের কথা ভুলে যাবার ফলেই এক গাছ থেকে আর এক গাছে অর্থাৎ এক দেহ থেকে আর এক দেহে সে ঘুরে বেড়ায়। এই জড় দেহরূপ বৃক্ষে জীবাত্মা কঠোর সংগ্রাম করছে। কিন্ত্তু যে মুহূর্তে সে অন্য পাখিটিকে পরম গুরুরূপে গ্রহণ করতে সম্মত হয় যেভাবে অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ লাভের জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করতে সম্মত হয়েছিলেন তৎক্ষণাৎ অধীন পাখিটি সমস্ত শোক থেকে মুক্ত হয়। 

মুণ্ডক উপনিষদে (৩/১/২) ও শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে (৪/৭) প্রতিপন্ন করে বলা হয়েছে –
সমানে বৃক্ষে পুরুষো নিমগ্নোহনীশয়া শোচতি মুহ্যমানঃ ।
জুষ্টং যদা পশ্যত্যন্যমীশমস্য মহিমানমিতি বীতশোকঃ ।।

“দুটি পাখি একই গাছে বসে আছে, কিন্তু যে পাখিটি ফল আহারে রত সে গাছের ফলের ভোক্তারূপে সর্বদাই শোক, আশঙ্কা ও উদ্বেগের দ্বারা মুহ্যমান। কিন্ত্তু যদি সে একবার তার নিত্যকালের বন্ধু অপর পাখিটির দিকে ফিরে তাকায় তবে তৎক্ষণাৎ তার সমস্ত শোকের অবসান হয়। কারণ তার বন্ধু হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান এবং তিনি সমগ্র ঐশ্বর্যের দ্বারা মহিমান্বিত।” 

অর্জুন তাঁর নিত্যকালের বন্ধু ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দিকে ফিরে তাকিয়েছেন এবং তাঁর কাছ থেকে ভগবদগীতার তত্ত্ব জানতে পেরেছেন। এভাবেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে শ্রবণ করার ফলে তিনি ভগবানের পরম মহিমা উপলব্ধি করতে পারেন এবং সমস্ত শোক থেকে মুক্ত হন।

এখন দাদা আপনি বলেন-যারা বই পুস্তক পাঠ করবে, তারা কিভাবে সেই পরমতাত্ত্বিক জ্ঞান লাভ করবে? জ্ঞানের উৎপত্তিতো ধ্যানযোগে লাভ হয়। ধ্যান না করলে জ্ঞান হয় না। বিদ্যা পড়লে বিদ্বান হওয়া যায়। কিন্ত্তু জ্ঞানী হওয়া যায় না। যেমন ধরুনঃ যে লোক অক্ষর চেনে না, সে যেমন তার ভাষায় কথা বলছে কিন্ত্তু লিখতে দিলে পারছে না। তার মানে সে অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন নয়। তাই সে নিরক্ষর। আর যে জানে, তাকে বলা হয় বিদ্বান। তথা অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তি। তিনি কিন্ত্তু জ্ঞানী নন। কারণ জ্ঞানীগণ যে জ্ঞান লাভ করেছেন, তা যখন লিপিবদ্ধ করা হয় তখনই তা হয় কিতাব তথা পুস্তক বা বই। মুল পুস্তক কিন্ত্তু সেই জ্ঞানীর অন্তঃকরণে। যেখান থেকে সে জ্ঞান লাভ করেছিল। সে যখন তা ভাষায় বর্ণনা করলো তা শব্দরুপে আমাদের কর্ণ কুহরে প্রবেশ করলো। আমরা শুনতে পারলাম। শব্দ উচ্চারণ না করলে কিভাবে তা ধ্বনি হয়? ধ্বনিতো তখনই হয় যখন উচ্চারণ করা হয়। আর উচ্চারিত হয় স্বরতন্ত্র তথা স্বরযন্ত্র হতে।

করিম সাহেব কিছুই বললেন না। তিনি চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন কেমন সুনশান নীরবতা। শীতের কুয়াশায় চারিদিকে ঢেকে আছে। সেই কুয়াশা শিশিরের রুপ ধারণ করে টিনের চালার উপর টুপ টুপ করে পড়ছে। বাড়ীর পাশে দেবদারু গাছটি কেমন ঝিম মেরে বসে আছে। একটুও কাঁপুনি নেই। অথচ তিনি শীতের কথা চিন্তা করে এখনোই ঠক ঠক করে কাঁপছেন। তাকে যেতে হবে মান্দ্রা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তিনি আঁতকে উঠলেন। তিনি তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ালেন।
বললেনঃ

-হরি দা আজ উঠি। অনেক রাত হয়ে গেছে। বাড়ী ফিরতে হবে।

-সে কি? প্রসাদ খাবেন না?

-না দাদা। আজ নয় অন্য আরেক দিন। এক্ষুনি যেতে হবে। নয়তো রিক্সা পাবো না...এখন পাই কি-না সন্দেহ আছে। তাছাড়া আজকে বেশ শীত পড়েছে। সাথে কুয়াশাও।

তিনি আর দেরী করলেন না। হড় হড় করে হেটে চলে এলেন মুল রাস্তার ধারে। একটা রিক্সা পাওয়ায় তিনি হাফ ছেড়ে বাঁচলেন।

 (চলবে)