পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

মনা পাগলার আত্মবিলাপ-পর্ব তৃতীয়

(দ্বিতীয় পর্বের পর হতে)

-সেই কখন থেকেইতো বলছেন তারপর শুরু হইলো আসল ঘটনা। আসল ঘটনাটাতো কিছুই বলছেন না?

-আরে অতো অধৈর্য্য হইস না...বলছি তো। শোন..

জুতা জোড়া যখন বাইরে ছুইড়্যা মারলাম তখন সেইটা লাগলো অন্য আরেকজন মুসল্লির গায়। সে তখন বেশ রেগে গিয়েছে। কোন দিকপাশ না চেয়ে সে আমাকে একটা ঘুসি দিল। সেই ঘুষিরটা খেয়ে টাল সামলাতে না পেরে অামি পরে যাই পাশে বসে থাকা অন্য আরেকজন মুসল্লির উপর। শুরু হলো হুড়োহুড়ি। মারামরি। কোলাহলে কোন্দলে শান্ত স্নিগ্ধ মসজিদটা হয়ে উঠলো অশান্ত। কথা কাটা কাটি, ধাক্কা ধাক্কি। শেষ পর্যন্ত অন্যান্য মুসল্লিরা ঘাড় ধরে আমাকে মসজিদ থেকে বের করে দিল। তাদের ধারণা, দোষটা নাকি আমার। আমি যদি জুতাটা সামনে রাখতাম, তাহলে নাকি এই ঘটনা ঘটতো না। কিন্ত্তু আমি জুতা সামনে রাখবো কেন? 

-আহা জুতা জোড়া সামনে থাকলে কি এমন ক্ষতি হতো? রাখলেই তো পারতেন? এতটুকু সহনশীলতা দেখালে তো আপনাকে এত কিল ঘুসি থাপ্পর খেতে হতো না.... 

-ভাইরে মসজিদ হইতাছে সেজদার জায়গা। মসজিদ এর মুল হইল সজিদ তথা সেজদা। সেজদা অর্থ আত্মসমর্পণ। সেজদা কারে দেয় জানস? জানস না। মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিনের উদ্দেশ্যেই সেজদা দেওন লাগে। কেন লাগে? কারণ তুই, আমি আমরা সবাই তারই সৃষ্টি রাজ্যে বাস করি। তার রাজ্যে বাস করে তারই দেয়া রিজিক আমরা খাই। স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যেই সেজদা দিতে হয়। আর সেই সেজদা দেওনের সময়, যদি সামনে জুতা থাকে, তাহলে মনের মধ্যে শিরিকের সৃষ্টি হয়। মনটা হইয়া যায় দো'মনা। সেই মন নিয়া সেজদা দিলে মোনাফিকির সৃষ্টি হয়।

-কি বলছেন আবল তাবল...তাহলেতো সব মুসল্লীরাই...

-ভাই, শোন..রাগ করিস না। একটু ভেবে দেখ....বোখারী শরীফের একটি হাদিসে আছেঃ "তুমি এমন ভাবে আল্লাহর ইবাদত করো যেন তুমি তাকে দেখতে পাও। আর যদি তা না পারো...তাহলে মনে মনে চিন্তা কর..আল্লাহ তোমাকে দেখছেন।" এমন হাদিসতো আমরা প্রায়ই ইমাম সাহেবদের মুখে শুনি। সেইটাই যদি ধরি, তাহলে দেখ্...ইমাম সাহেব যখন সুরা ফাতেহা পাঠ করে বলে..."ইয়া ক্যা'না বুদু ওয়া ইয়া ক্যা'নাস্তাইন...আমরা তোমরই ইবাদত করি এবং তোমার নিকটই সাহায্য প্রার্থনা করি..সেই সময় যদি জুতাটা সামনে থাকে..তাহলে সেই সময় তুই কাকে দেখছিস, কার কাছে সাহায্য চাচ্ছিস...মুখে বলছিস স্রষ্টার কথা আর অন্তরে চিন্তা করছিস তোর জুতার কথা...দেখছিস জুতাটা..ঠিক আছে না-কি কেউ নিয়ে গেছে...এইটা কি মুনাফেকী না...এইটাকে তুই কি বলবি?

তারপর ধর...মসজিদকে অনেকেই বলে আল্লাহর ঘর। সেইটা মস্তবড়ো ভুল। অাল্লাহর ঘর হলো বাইতুল্লাহ...মসজিদ হলো ইবাদত বন্দেগীর স্থান। যেখানে বসে ইবাদত বন্দেগী করা হয়। যারা ইবাদত বন্দেগী করে, তাদের বলা হয় মুসল্লি। শব্দগত অর্থ যদি ধরিস তাহলে দেখ... মসজিদ মুল সজিদ তথা সেজদা। ইবাদত যার মুল আবদ অর্থ দাস। বন্দেগী অর্থ বন্দনা করা তথা প্রশংসা কীর্তন করা। গুণ-গান করা। মুসল্লী হলো শান্তিকামী। যে কোন ব্যক্তি যদি স্রষ্টার সর্বশক্তিমান অবস্থা প্রত্যক্ষ করে কিংবা অনুধাবণ করে তারই গুণ-গান করার জন্য যে স্থানটিতে আত্মসমর্পণের উদ্দেশ্যে তার মাথাটা স্রষ্টার প্রতি অবদমন করে, সেটাই হয় সেজদা। যে স্থানটিতে করা হয় সেটাকে বলা হয় মসজিদ। সেটাকে তো পাক পবিত্র হওয়া বান্ঞ্চনীয়। নয় কি? 

তোরা তো কথায় কথায় বলিস...পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অর্ধেক। তাই না?

-হ্যাঁ বলি। এটাতো হাদিসেই আছে...

-মানিস?

-কেন মানবো না? একশো বার মানি...

-তোরা মানিস ঘোড়ার ডিম। মানলে দেশের এই অবস্থা হয়? প্রতিটি রাস্তা-ঘাট ময়লা আবর্জনায় পরিপুর্ণ। ময়লা দুঃগন্ধযুক্ত। পরিবেশ পরিস্থিতি খুবই খারাপ। নাকে রোমাল চেপে হাঁটতে হয়। অথচ দ্যাখ, কি আশ্চর্য্যের বিষয়...বাংলাদেশ একটা মুসলিম রাষ্ট্র। সেই মুসলিম রাষ্ট্রটা যদি এই হাদীসটাই মানতো..তাহলে প্রতিটি রাস্তা ঘাট ঝকঝকে তকতকে থাকার কথা...হাদিসটার কথা ধরলে ঈমানের পরিচয় পাওয়া যায়...বিপরীত দিকে তাকা, যাদের কে বলিস ইহুদী নাসারা তাদের দেশে যেয়ে দেখ...রাস্তা-ঘাট কতো পরিস্কার পরিচ্ছন্ন...হাদিসটা তোরা বলিস মানে ওরা...প্রতিটি মুসলিম রাষ্ট্রেই এই একই অবস্থা...

কথাটা শুনে মনাকে কি বলবো? আমি নিজেইতো পরিস্কার রাখি না আমার রুমটা। বিছানা পত্র। বালিস...সবকিছুই এলোমেলো ছড়ানো ছিটানো থাকে। কলা খাই তো খোসাগুলো ড্রেনের ভেতর ফেলে দেই কিংবা এখানে সেখানে। বাজার করে নিয়ে আসলে পলিথিনটা ছুঁড়ে ফেলে দেই..জানালা দিয়ে রাস্তার ধারে...সিগারেট খেলে ছাইপাশতো যেখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখি। তার মানে আমার ঈমান দুর্বল ঈমানের লক্ষণ..কি বলবো বুঝতে পারছি না...

আমি মনার দিকে তাকালাম..দেখলাম সে থুতনিতে হাত দিয়ে ক্ষতস্থানটা বুলাচ্ছে। কথা বলতে তার বেশ কষ্ট হচ্ছে...। আমি আর কোন কথা তাকে জিগ্যাসা করলাম না...শুধু রিক্সাওয়ালাকে বললাম...এ্যাই ডান দিকে যাও...

আমার দিকে তাকিয়ে মনা বললোঃ

-আমার দুঃখ কি জানিস?

-এখন কোন কথা না। পরে বাড়ীতে যেয়ে শুনবো...প্লীজ...

(চলবে)