পৃষ্ঠাসমূহ

মঙ্গলবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

মনা পাগলার আত্মবিলাপ-পর্ব চতুর্থ

(তৃতীয় পর্বের পর হতে)

দেখতে দেখতে আমরা মীরপুরের ঝুট পট্রিতে এসে পড়লাম। ঝুটপট্রিতে সাধারণতঃ গার্মেন্টেসের ঝুটের ব্যবসা হয়। সাধারণ ব্যবসায়ীরা গার্মেন্ট হতে ঝুট কিনে এনে এখানে বেছে বুছে শার্ট-প্যান্ট, মেয়েদের বিভিন্ন ধরণের আইটেম বিক্রি করে। আর খুচরা ব্যবসায়ীরা তাদের কাছ থেকে পাইকারী কিনে বিভিন্ন স্থানে খুচরা বিক্রি করে। আমার বন্ধু আজহার এই ঝুটের ব্যবসা করে। তারই আশ্রয়ে রুমের কোণে বিছানা পেতে আমি থাকি। ভাড়া বলতে নাম মাত্র। আমার তেমন কেউ ঢাকায় পরিচিত নেই। তাছাড়া আর কোন আশ্রয় আমার নেই। আমি মনাকে নিয়ে সেই রুমের মধ্যে গেলাম। মনাকে আমার বিছানায় বসতে দিলাম। ভাগ্যিস আজহার এই সময় থাকে না। থাকলে হয়তো নানান র্কীতি করতো। কেন এনেছি? কি হয় আমার? যদি কোন চুরি হয়? কিংবা কে জানে হয়তো ভন্ড প্রতারক। ভান ধরে পড়ে থাকে...ইত্যাদি ইত্যাদি নানান প্রশ্নে জর্জরিত করতো। ভাগ্যটা ভালোই বলতে হবে। যাই হোক..মনাকে আমি আমার বিছানায় শুইয়ে দিলাম। মনা সেখানে আরাম করে শুইয়ে রইলো। 

মনাকে শুইয়ে রেখে আমি ফ্যানটা ছাড়লাম। মাথাটা ভন ভন করে ঘুরছে। কেন যেন এই লোকটার প্রতি আমার মায়া পড়ে গেছে। লোকটাকে দেখে বুঝার উপায় নেই যে তার মধ্যে একটা দার্শনিক মন কাজ করছে। এই মন কেবল মনাকেই বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। কেন করে? সেইটা একটা প্রশ্ন। আমি মনার দিকে তাকালাম। তার চেহারার মধ্যে কেমন যেন একটা মায়া আছে...

অামি বারান্দায় গিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। ম্যাচের কাঠিটা ছুড়ে ফেলতে যা'ব ঠিক তক্ষুণি মনে হলো মনার কথা।...পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ..আমি কাঠিটা হাতের কাছেই রাখলাম। আর সিগারেটের ছাই ফালাবার জন্য এসট্রেটা ব্যবহার করলাম...সিগারেট টানছি আর ভাবছি মনার কথা....বলেছিল

এই যে তুই আমাকে দেখছিস...বাস্তবিকই কি তুই আমাকে দেখছিস...না-কি অন্য কাউকে দেখছিস? তোর ভেতর যে আছে সে আমার ভেতরও আছে। তাহলে কে কাকে দেখছে....যে চোখ দিয়ে তুই আমাকে দেখছিস...দৃষ্টিটা তোকে বিভ্রান্ত করে বলেই তুই তার স্বরুপটা ধরতে পারছিস না...যেমন ধর আমরা একজন আরেকজনের সাথে দেখা হলে কি করি? সালাম দেই...বলি আসসালামুআলাইকুম...উত্তরে সে বলে ওয়ালাইকুম আস সালাম...কে কাকে দেখলো...কাকে দেখে কে কার প্রতি সালাম দিল ও প্রতিউত্তর দিল? রহিম সাহেব করিম সাহেবকে দেখে সালাম দিল। করিম সাহেব জবাবে রহিম সাহেবের প্রতিও সালাম দিল...বিষয়টা আপেক্ষিক...দুটি বস্ত্তুর মধ্যে একই বিষয় ক্রিয়া করছে...দুই জনের ভেতরেই লাবডুব করে বাজছে। প্রশ্নটা হলোঃ দৃষ্টির কারণে ভিন্নতার সৃষ্টি হয়েছে..দৃষ্টিটা তাকে তার বাহ্যিক দিকটা দেখাচ্ছে। ফলে ভেতরটা অজ্ঞাত থেকে যাচ্ছে..মানে হলো দৃষ্টিটা প্রতারিত করছে...তাই নয় কি? বুঝি না...

আবারো সিগারেটে টান দিয়ে মনার দিকে তাকালাম। কি নিশ্চিত মনে ঘুমাচ্ছে...হয়তো এমন আরাম করে কখনো ঘুমিয়েছে কি-না সন্দেহ আছে? বিষয়টা এমন না যে আমার বিছানা ফুলশষ্যা। তেলচিটচিটে বালিশ আর দুটি কাথা কম্বল দিয়ে একটু উচু করে পাতা। তোষকের পরিবর্তে দেয়া আর কি? আমিতো ঘুমাই ঠেকায় পড়ে...ম্যাছে থাকতে হলে এরচেয়েও ভালো ভাবে থাকা যায়। কিন্ত্তু আমার সেই সাধ্য নেই। ইনকামের অবস্থা খুবই করুণ। দুটা টিউশনি করি...যা পাই তা দিয়েই চলে যায় কোন মতে...

আমি সিগারেটটা শেষ করে অবশিষ্টাংশ বাইরে ছুড়ে ফেললাম..আবারো মনে হলো মনার সেই পুরোনো কথা...আমি দেখলাম মনা কেমন যেন করে উঠলো...তাকিয়ে দেখলাম সে ঘুরে আবারো শুয়ে পড়লো। আমি তার পাশেই হেলান দিয়ে একটি বই বের করলাম। বই মেলা থেকে কিনেছি। নামঃ ইবনুল আরাবী ও মাওলানা জালালউদ্দিন রুমী।বইটা পড়া শুরু করলামঃ 

'ওয়াহাদাতুল ওজুদ' শব্দের অর্থ ধর্মীয় দর্শনের ভাষায় সত্তার ঐক্য, ঐক্যনীতি, অদ্বৈতবাদ বা সর্বেশ্বরবাদ। তাঁর 'ওয়াহাদাতুল ওজুদ' মতবাদ অনুসারে সমগ্র অস্তিত্বশীল সত্তাসমুহের মুল সত্তা একটি। এই সত্তা ধর্মীয় ভাষায় আল্লাহ। আল্লাহ একমাত্র পরম সত্তা। তিনি বিশ্ব মাঝে ব্যাপ্ত আছেন। এই বিশ্ব জগৎ আল্লাহ সত্তাময়, আল্লাহর নাম ও গুণের প্রকাশ, আল্লাহ ও বিশ্বজগত অভিন্ন। 

ওয়াহাদাতুল ওজুদ মতবাদকে সাধারণভাবে সর্বেশ্বরবাদ বলা হয়। কারণ, এর মধ্যে আল্লাহ ও বিশ্বে যেন কোন ভেদ নাই। সমগ্র বিশ্বজগতই যেন আল্লাহ এবং আল্লাহ সমগ্র বিশ্বজগত। তার মতে আল্লাহ বিশ্বজগতে ্ এবং বিশ্বজগত আল্লাহয় অবস্থিত, সমগ্র বিশ্বজগত আল্লাহ কিন্ত্তু সমগ্র আল্লাহ বিশ্বজগৎ নয়। তার মতবাদ যে দৃষ্টিভংগী হতে গড়ে উঠেছে তা স্পিনোজীয় দৃষ্টিভংগী হতে অনেকাংশে ভিন্ন ধরণের।

আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম...মনা যে কথা বলেছিল-তা ইবনুল আরাবীর সর্বেশ্বরবাদকেই পরোক্ষভাবে সমর্থন করছে। তার মানে কি? আমিতো বইটাতে পড়ে পেলাম...মনা পেল কিভাবে? সে কিভাবে জানলো...মনার প্রতি আমার কৌতুহল বেড়ে গেল...আমি তাকালাম মনার দিকে...সে তখনো ঘুমাচ্ছে...আমি তার ঘুম ভাংগার অপেক্ষায় রইলাম...

(চলবে)