রহিম সাহেবের মনটা বেজায় খারাপ। তিনি এ বছর কোরবাণী দিতে পারছেন না।
প্রতি বছরই তিনি কোরবাণীর আনুষ্ঠানিকতা সারেন। কিন্ত্তু এ বছর কোরবাণী দিতে
না পারার যন্ত্রণা তিনি কিছুতেই সহ্য করতে পারছেন না। তার ছেলে-মেয়েরা
কোরবাণীর পশু দেখতে পারবে না -এটা কিছুতেই হতে পারে না। তাছাড়া তার ছোট
মেয়ে অর্থি তার বান্ধবীকে মোবাইলে বলছেঃ
-জানিস, আমার বাবা এ বছর বড় দেখে একটা গরু কিনবে। তোরা কি কিনেছিস?
রহিম সাহেবের মনটা আরো বেশি খারাপ হয়ে গেল। আহা! মেয়েটা কতো আশা নিয়ে
তার বান্ধবীকে বলছে গরু কেনার কথা। অথচ তিনি জানেন তার পকেটে টাকা নেই। যে
টাকা আছে তাতে বড়ো জোর একটা ছাগল কেনা যেতে পারে। তিনি কি করবেন, ভেবে
পাচ্ছেন না। অস্থির চিত্তে তিনি বারান্দায় এপাশ ওপাশ হেঁটে বেড়াচ্ছেন। কি
করা যায় তাই ভাবছেন? কারো কাছ থেকে যে টাকা ধার করবেন সে সাধ্য নেই। টাকা
ধার করলে কিভাবে শোধ দেবেন? এম্মনিতেই তিনি দেনায় জড়িয়ে যাচ্ছেন। যে পেঁয়াজ
ছিল ত্রিশ-চল্লিশ টাকা তা হটাৎ করে বেড়ে হয়ে গেল আশি টাকা। প্রতি কেজিতে
বাড়তি ব্যয় হচ্ছে চল্লিশ টাকা। মাছ-মাংসের কথা না হয় ছেড়েই দিলেন। নিত্য
প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। দেখার কেউ নেই। দেশের চলমান
রাজনীতি নিয়ে এম্মনিতেই যে ঘোর অন্ধকার ছিল তাও আরো গাঢ় হয়ে আসছে। তার উপর
লেখা-পড়া করার উপর সরকার ট্যাক্স বসাচ্ছে। ছাত্ররা মাঠে নামছে।
রাস্তা-ঘাটের যে অবস্থা তাতে মরার উপর খড়ার ঘা হয়ে নামছে পরিবহন সেক্টরে।
বাস ভাড়া বাড়ছে। রিক্সা ভাড়া বাড়ছে। অথচ সে অনুপাতে বাড়ছে না তার ইনকাম। কি
করা যায়? এই বয়সে এসে শেষ পর্যন্ত ঘুষ দুনীতিতে লিপ্ত হবেন না-কি সেই
চিন্তা করছেন। তার চিন্তায় ছেদ পড়লো একটি কলিং বেলের শব্দে। কে আসতে পারে এ
সময়? তিনি দরজা খুলতে গেলেন। কিন্ত্তু তার আগেই সায়মা দরজা খুলে দিল।
দেখলেন সাত্তার সাহেব আসছেন। সাত্তার সাহেব তার কলিগ মানুষ। তাছাড়া তার
প্রতিবেশি। তাকে দেখে আপাততঃ চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে তাকে সালাম দিলেন।
তারপর কুশল জিগ্যেস করলেন।
-কেমন আছেন ভাই?
-আছি কোন রকম।
-কেন ভাই? কি হয়েছে? বসতে বসতে সাত্তার সাহেব জানতে চাইলেন।
-কি আর হবে? এ বছর বোধ হয় আর কোরবাণী দিতে পারবো না।
-ভালো তো। একটা পশু হত্যা করা হতে বেঁচে গেলেন।
-জ্বী? রহিম সাহেব মনে হয় পশু হত্যা ব্যাপারটা বুঝতে পারেননি। তিনি বেশ আশ্চর্য্য বোধ করলেন।
-সত্য কথাইতো বলছি। সাত্তার সাহেব বললেন।
-শুনেন ভাই, সব সত্য শুনতে নেই। সত্য বড়ো নির্মম।
-আরে ভাই তার জন্যইতো বলছি। আপনি একটা পশু হত্যা করার অপরাধ হতে বেঁচে গেলেন আর কি?
-কেন ভাই? কোরবাণী করা কি পশু হত্যা করা?
-অবশ্যই।
-তার মানে আপনি বলতে চাইছেন কোরবাণীর ঈদ মানে হচ্ছে পশু হত্যার আনন্দ অনুষ্ঠান?
-না। আমি যে অর্থে বুঝাতে চাইছি সে অর্থে আপনি বুঝেননি। অথবা আপনি যে অর্থে বুঝছেন সে অর্থে আমি বলিনি..
-ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না। আপনি কি বললেন আর আমি কি বুঝলাম?
-শোনেন, “ক্বোরবানুন” অর্থ নিকটবর্তী হওয়া, নৈকট্য। আর ঈদ মানে আনন্দ।
সুতরাং ক্বোরবাণীর ঈদ অর্থ হচ্ছে নিকটবর্তী হওয়ার আনন্দ। কার নিকটবর্তী?
প্রভু গুরুর। যিনি সারা জাহানের প্রভু। আপন নাফসানিয়াত পশুবৃত্তিকে জবেহ
করে পবিত্র হতে হয়। জবেহ করা অর্থ “ উৎসর্গ করা, পবিত্র করা বা শুদ্ধিকরণ”।
সপ্ত ইন্দ্রিয় দ্বার পথে যে সব ধর্মরাশি তথা মুর্তি মানবের মন-মস্তিস্কে
প্রবেশ করে তা মন-মস্তিস্কে স্থায়ী ছাপ ফেললে তাকে বলা হয় শিরিক। এই
শিরিকের কারণেই বারংবার জন্ম-মৃত্যুর আবর্তে পতিত হতে হয়। ফলে তা দুঃখের
কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই মুর্তিগুলি বর্হিজগত হতে দৃশ্যমুর্তি, শব্দমুর্তি,
গন্ধমুর্তি, অনুভুতিমুর্তি ইত্যাদি রুপে আসে এবং তা মনজগতে ভাবমুর্তির উদয়
করে অস্তিত্বের সাথে লেগে থাকে। তথা শিরিক সম্পন্ন করে। এগুলি হয় তার
পুণঃজন্মের উপাদান। উপাদান শুন্য হলে জন্মান্তর নাই। জন্মই দুঃখের কারণ। তা
সে জাহান্নামের হোক আর জান্নাতেরই হোক। জান্নাতে দুঃখের পরিমাণ কম হলেও
আছে। সকল প্রকার দুঃখ হতে তথা জন্মচক্র হতে মুক্ত হতে চাইলে তাকে অবশ্যই
প্রকৃত মুসলমান হতে হবে অর্থাৎ পরিপুর্ণভাবে সমর্পণকারী ব্যক্তিই কেবল
গুরুর নির্দেশ পালনের সাহায্যে অনন্ত জন্মচক্রের দুঃখ হতে মুক্ত হয়ে
লা-মোকামে তথা মোকামে মাহমুদায় উন্নীত হতে পারে।
রহিম সাহেব ফ্যাল ফ্যাল করে সাত্তার সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি পুরো বিষয়টা বুঝতে চেষ্টা করলেন।
(চলবে)