পৃষ্ঠাসমূহ

বৃহস্পতিবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৫

আল হাক্কু মুরুনঃ মনা পাগলার ভাষণ

মনা পাগলা একটা করোল্লা হাতে নিয়ে বেশ চেঁচিয়ে বলছেঃ -আল হাক্কু মুরুন। আল হাক্কু মুরুন।। আল হাক্কু মুরুন।।। সত্য বড়ো তিতা। সত্য বড়ো তিতা। সত্য বড়ো তিতা।

তার হাঁক ডাক শুনে লোকজন জড়ো হতে আরম্ভ করলো। তারা এক পর্যায়ে সবাই মনাকে ঘিরে ফেললো। আর মনা সবাইকে সেই করোল্লা দেখিয়ে দেখিয়ে বলছেঃ আল হাক্কু মুরুন। সত্য বড়ো তিতা। করোল্লা তো তিতাই। সেটাকে এতো স্বরবে প্রচার প্রচারণা করার অর্থটা সাধারণ্যের কাছে কেমন যেন বোধগম্য হচ্ছে না। তারা বেশ উৎসুক্যবোধ করছে। দেখতে চাচ্ছে পাগলটা কি করে?

মনা তার স্বভাব সুলভ আচরণ করছে আর বলছেঃ আল হাক্কু মুরুন। সত্য বড়ো তিতা। যেমন করোল্লা। একথা বলেই সে করোল্লা দিব্যি চিবিয়ে খাচ্ছে আর উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে সকলের দিকে তাকাচ্ছে। একটা পাগলকে নিয়ে যে আগ্রহ সাধারণ্যের কাছে ছিল তা ধীরে ধীরে বেশ বড়ো হতে চলেছে। মনে হলো মনা পাগলা সেটাই চাইছিল। সে সকলকে উদ্দেশ্য করে বললোঃ

-যে করোল্লা এত তিতা তার চাইতেও বেশি তিতা ইতিহাস। আর ইসলামের ইতিহাসতো আরো বেশি তিতা। আরো বেশি মর্মান্তিক। ইসলামের ইতিহাস রক্তাক্তের ইতিহাস। ইসলামের ইতিহাস বেদনার ইতিহাস।

একটা পাগলের মুখে ইসলামের ইতিহাস শোনার জন্য কেউ নিশ্চয়ই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করবে না। যারা একটু বেশি উৎসুক ধরণের তারাই থাকলো। আর যারা পাগলের ইতিহাস শোনার চেয়ে সময়ের মুল্য অনেক বেশি মনে করলো তারা কেটে পড়লো। আমি নেহায়েত গোবেচারা ধরণের। কোন কাম কাজ নেই। থাকলেও কেউ দেয় না। টোটো কোম্পানীর ম্যানেজারের চাকরিটাতো আছেই। কাজেই আমি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলাম পাগলের সেই করোল্লা মার্কা ইসলামের ইতিহাস শোনার জন্য। আমার মতো দুই চারজন লোকও সেখানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। আমরা খুব আগ্রহ নিয়ে শুনছি মনা পাগলার সেই করোল্লা মার্কা ইতিহাস। মনা পাগলা সমানে বলেই চলেছেঃ

- আশ্চর্য ! দেড় হাজার বছর অতিক্রম হয়ে গেলো, তবু কারবালার মহাত্ম্যটাই নির্বোধ এ জাতির মাথায় ঢুকলো না। ওরা মনে করছে বছরে নির্দিষ্ট একদিন বা কয়েকদিন মর্সিয়া, মাতম, হা-হুতাশ আর ক্রন্দনের মাধ্যমে আশুরা উদযাপন করলেই বুঝি নবী-পরিবার খুশিতে গদগদ হয়ে উঠবে এবং তাতেই কারবালার সকল দায়-দায়িত্ব শেষ হয়ে গেলো ।
আচ্ছা, হা-হুতাশ আর মাতম করলেই কি কারবালার প্রতিশোধ নেয়া হয়ে গেলো? এবং নবীবংশের এত বড় আত্মোৎসর্গ স্বার্থক হয়ে গেলো ? বোকারা বোঝে না যে, কারবালার এই শোককে শক্তিতে পরিণত করতে হবে। তারপর সেই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া মোহাম্মদী ধর্মদর্শনকে পুণঃজাগরণের মাধ্যমে কারবালার প্রতিশোধ নিতে হবে । কেননা, মওলা হোসাইন (আঃ) যেটা চেয়েছিলেন, সেটাই যদি সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা না গেলো এবং এজিদী ইসলামই যদি সমাজে এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো, তাহলে মওলা হোসাইনের (আঃ) জীবন বিসর্জন দেয়ার কি মানে রইল? যদি আমরা এখনও ইয়াজিদেরই দাসত্বই করি, তাহলে কারবালায় এতগুলো জীবন বলিদানের তো কোন অর্থই রইল না। তারাও তো সেটা করলেই পারতো, যা এখন আমরা করছি !!

-বন্ধুগণ, কারবালার এ দুঃখকে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজে লাগিয়ে গাদিরে খুমের সেই বেঈমানীর প্রতিশোধ নিতে হবে।

যে সকল সাহাবারা পাহাড়ের উপর থেকে পাথর নিক্ষেপে মহানবীকে মেরে ফেলার চেষ্টা চালিয়েছিল, সেটারও তদন্ত করতে হবে। জানতে হবে কারা কারা এ কার্য্যটি করেছিল?

উম্মতের কপাল খাওয়া বৃহস্পতিবারের বদলা নিতে হবে। জানতে হবে ইয়াওমাল খামিস কি? কেন বৃহসপতিবার আসলেই ইবনে আব্বাস (রাঃ) আক্ষেপ করে বুক চাপড়িয়ে কাদতেন আর বলতেন ” হায় ইয়াওমাল খামিস?”

রসুলের লাশ অদাফনকৃত অবস্থায় তিন দিন পর্যন্ত কেন রেখে দেয়া হয়েছিল? সেটার জবাবদিহিতা করতে হবে। সে সময় রসুলের যে চারজন সাহাবারা ছিলেন তারা কে কোথায় কোন্ কোন্ স্থানে ছিলেন? তারা থাকতে কেন রাসুলের লাশ মোবারক অদাফনকৃত তিনদিন পর্যন্ত থাকবে? বাকী সাহাবারা কোথায় ছিলেন?

রসুলের মৃতলাশকে ফেলে রেখে বনি সাকিফায় সাহাবাদের অবৈধ নির্বাচনের বিচার চাইতে হবে। খিলাফতকে কেন্দ্র করে যে নির্বাচন হয়েছিল সেখানে কে কে উপস্থিত ছিল? কার নেতৃত্বে সেই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল? এর উদ্দেশ্য কি ছিল? কেনই বা রাসুল সে সময় জীবদর্শায় থাকতে তার উত্তোরাধিকার নির্বাচিত করে যাননি?

মওলা আলীকে গলায় দড়ি দিয়ে বেঁধে টেনে নেয়ার সেই অপমানের প্রতিশোধ নিতে হবে। রাসুলের প্রাণপ্রিয় কন্যা ফাতিমা (আঃ) এর জামাতা আলী (আঃ) কে কেন অপমান অপদস্ত হতে হয়েছিল? কে এসবের নেতৃত্ব দিয়েছিল?

খলিফা ওমর-আবুবকর-উসমান এ তিন জনের একজনও কেন রসুলের লাশ দাফনের সময় উপস্থিত ছিলেন না, সেটার কৈফিয়ত চাইতে হবে।

খলিফা আবুবকর কেন নবী পরিবারের সম্পত্তি বাগে ফিদাক জোর করে কেড়ে নিয়ে নবী কন্যা মা ফাতেমার পরিবারকে না খাইয়ে মারার ব্যবস্থা করেছিল সেটার বিচার চাইতে হবে।

মা ফাতেমাকে পেটে লাথি মেরে গর্ভে সন্তান সহ হত্যার সেই প্রতিশোধ নিতে হবে।

ওয়ায়েছ করণীকে দান করা রসুলের জুব্বা মোবারক প্রদানে খলিফা ওমর কেন এত বছর বিলম্ব করলো- সেটার জবাবদিহিতাও করতে হবে।

সরকারী দল কর্তৃক মদীনার দশ হাজার কুমারী মেয়েদের ধর্ষণে গর্ভবতী করানোর বদলা নিতে হবে।

বিষপ্রয়োগ ও গুপ্তঘাতক দিয়ে যে সব ইমামদের হত্যা করা হয়েছে, সেটারও প্রতিশোধ নিতে হবে…!!!

সুতরাং শুধু ঘরে বসে বসে কাঁদলে আর রাস্তায় রাস্তায় হা-হুতাশ করলে চলবে না । কারবালার বেদনাকে বুকে লালন করে সমাজে হোসাইনী ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে । তবেই কারবালায় এতগুলো প্রাণের আত্মোৎসর্গ স্বার্থক হবে…!!!

আমি মনোযোগ সহকারে শুনছি সেই মনা পাগলার করোল্লা মার্কা ভাষণ। মন্ত্রমুগ্ধ ছিলাম। তাই কিছুই খেয়ালই করিনি। আশে পাশের মানুষ যে কখন সরে গেছে টেরই পাইনি। তাকিয়ে দেখি আমি আর মনা পাগলা ছাড়া আর কোথাও কেউ নেই।

মনে মনে ভাবলামঃ ইয়াজিদি ইসলাম যদি সত্যিই দুনিয়াতে এখনো জীবিত থেকেই থাকে তাহলে ইমাম হোসাইন (আঃ) এর নানাজান অর্থাৎ ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সাঃ) যে ইসলাম আল্লাহর তরফ হতে প্রচার করেছিলেন সেই ইসলাম কোথায় গেল? তাহলে কি ইমাম হোসাইন বিন আলী (আঃ) ইয়াজিদের সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে যে কথাটি বলেছিলেন “আলাম তাসমাও আলাইসা ফি কুম মুসলিম? আমার কথা কি শুনতে পাও না? তোমাদের মাঝে কি একটি মাত্র মুসলমানও নাই?” অথচ এজিদ সৈন্যবাহিনীতে একজন হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, ইহুদি অথবা অন্য কোনো ধর্মের লোক ছিলো না। সবাই ছিল মুসলমান। তাহলে তারা কেন তার ডাকে সাড়া দিল না? তারা কি কেবল সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলমান নামধারী লেবাসযুক্ত মোনাফেক ছিল?

একটা পাগলের মনের মধ্যে যে ইতিহাস খস খস করছে বিদ্যান জাহেরী লেবাসধারী মুসলমানের মধ্যে সেই বোধ কাজ করছে না। তারা সবাই সটকে পড়ছে যে যার মতো করে। পাগলের প্রলাপ কে শুনতে চায়? আমার মতো যাদের খেদে দেয়ে কোন কাজ নেই তারাই হয়তো পাগলদের ভক্ত হয়ে ভাবুকের মতো ভাবতে বসে। আমি চেয়ে রইলাম মনা পাগলার দিকে। আর মনা পাগলা আমার দিকে। সবাইকে চলে যেতে দেখে মনা আক্ষেপ করে বলছেঃ “ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হার কারবালা কি বাদ।”