পৃষ্ঠাসমূহ

বৃহস্পতিবার, ১২ মে, ২০১৬

মনা পাগলার মৌনতা এবং.......প্রথম পর্ব

মনা পাগলাকে অাজ বেশ মলিন দেখাচ্ছে। তার মনটা ভালো নেই। কারো সাথে কথা বলছে না। সে কেমন যেন নির্জীব হয়ে ধুম মেরে বসে আছে। তাকে ও ভাবে বসে থাকতে দেখে অনেকেই বেশ অবাক হলো। কিন্ত্তু জানতে চাইলো না-কেন সে এভাবে বসে আছে?

মনা উঠে দাঁড়ালো। চারদিকটা একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখলো। কড়া রোদ উঠেছে। রোদের তাপের কারণে রাস্তায় তেমন কোন লোকজন দেখা যাচ্ছে না। বাতাস নেই বললেই চলে। আর বাতাস থাকলেও তা বেশ হল্কা লাগছে। মনে হচ্ছে বাতাসটাও বেশ গরম হয়ে গেছে। মনা আকাশের দিকে তাকিয়ে হটাৎ বলে উঠলোঃ

- পাগলাটা এমুন খ্যাপছে ক্যা...গরমে কি আমাগো সিদ্ধ কইর‌্যা ফালাইবো? না-কি কাবাব বানাইবো?

মনার কথা শুনে আশে পাশের লোকদের মধ্যে বেশ হাসির রোল পড়ে গেল। তারা সমস্বরে হেসে উঠলো। তারা যেন তাদের পরিচিত মনাকে দেখতে পাচ্ছে। মনাও বেশ উৎফুল্ল হলো। মনাকে উৎফুল্ল দেখে রশিদ জিগ্যাসা করলোঃ

-দাদা, আপনে কারে কইলেন এই কথা?

-কারে আর কমুরে ভাই...ঐ যে দ্যাখ...আকাশের দিকে তাকাইয়্যা দ্যাখ। ঐ যে জগন্নাথরে দেখতাছস, ওরে কইলাম

রশিদ উম্মুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে তেতিয়ে থাকা গোলাকার সুর্যটা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না। পরিস্কার আকাশ। মেঘের কোন লেশও নেই। কেবল সুর্য্যটার মধ্যে কেমন যেন একটা সোনালী বলয় খেলা করছে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে না আবার চোখের সমস্যা হয়....সে জন্য রশিদ চোখ ফিরিয়ে আনলো। তারপর মনার দিকে তাকিয়ে বললোঃ

-হেয় কি জবাব দিল? 

-কি কইবো? যেই ধমক দিছি। দেহিস আউক্যা কেমনে মুইত্যা দেয়?

-কন কি দাদা? বৃষ্টি হইবো?

-হ....বৃষ্টিতে বেবাকরে ঠান্ডা কইর‌্যা দিব। যাউক গ্যা...এহন চা খাওয়া...

মনা চা খেতে চাইল। আর সবাই মনার জন্য চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। একটা পাগলের জন্য এমন ভালোবাসা..এমন দরদ সচরাচর দেখা যায় না। কিন্ত্তু মনাকে সবাই বেশ ভালোবাসে। তার কথার একটা গুরুত্ব কম বেশি সকলেই দেয়। মনার সেটা পছন্দ না। মনা চায় তার মতো করে নিরিবিলিতে একা থাকতে। কেউ যেন তাকে বিরক্ত না করে। এমন একটা পরিবেশ এখন মনার জন্য জরুরী হয়ে পড়েছে।

মনা চেয়ারে বসে চা খাচ্ছে। যে স্থানটিতে চা খাচ্ছে..তার পাশে একটা বড়ো অশ্বত্থ বৃক্ষ আছে । বয়স কতো হবে, অনুমান করা যায় না। তারপরও মনে হচ্ছে চল্লিশ পন্ঞ্চাশের কাছাকাছি। বেশ একটা এলাকা জুড়ে এর প্রকান্ড ডাল-পালা বিস্তৃত। চারদিকটা পাখ-পাখালির কলতানে মুখোরিত। পাখিদের চিকিরমিচির স্থানটাকে করে তুলেছে স্বপ্নের ভুবন। স্থানটা অনেক শীতল। তাই এখানে কিছু দোকান পাট বসেছে। ছোট ছোট মুদির দোকান। চা, বিস্কুট, সিগারেট  ইত্যাদি বিক্রি হয়। লোকজনের আনাগোনাও বেশ। গাছটির কান্ড বরাবর একটা পাকা বেদী তৈরী করা হয়েছে। অন্যন্ত মনোরম পরিবেশ। মনা মনে মনে এমন একটা নিরিবিলি পরিবেশই খুঁজছিল। মনে হলো সে যেন সেটা পেয়ে গেছে। চা খা্চ্চে আর চারপাশটা দেখছে। 

মনা লক্ষ্য করলো বেদীর উপর অনেকেই খালি গায়ে ঘুমিয়ে আছে। কাজেই তার চিন্তা নেই। সে ইচ্ছে করলেই এখানে থাকতে পারবে। কিন্ত্তু সে চায় না কেউ তাকে ডিষ্টার্ব করুক। সে সে উপায়টাই খুঁজছে। আর ভাবছে কি করা যায়...

চায়ের কাপটা দোকানে দিয়ে মনা সোজা গাছটির নিচে গেল এবং একটি স্থান দেখে বসে পড়লো। তারপর সে তার স্বভাব সুলভ আচরণ শুরু করে দিল। প্রথমেই সে সাধু সন্ন্যাসীরা যে ভংগীতে বসে ঠিক সে ভাবে বসে পড়লো। এরপর সে রশিদের দিকে তাকিয়ে বললোঃ 

-শোন হযরত খাজা শাহ্ পীর চিশতী (রহঃ) তাঁর চিশতী উদ্যানে কি বলেছেন

হৃদয় বনে অতি গোপনে একারও বাঁশি শুনেছি প্রাণে
মরমে মরি চাহি নেহারি সন্ধানে আমার পাইবে দেখা।।

আমি আমার হৃদয়ের বনে হের ডাক হুনছি। হের ডাকে সাড়া দিয়াই আমি এইহানে আইছি। হেই বাঁশির সুর হুনা যায় কলবের মইদ্যে । কলবেই হেয় বাস করে । হেয় কতা কয় বোবা ভাষায়। হের ভাষা বুঝনের লিগা নির্জন জায়গা লাগে। নির্জন ছাড়া হের ডাক হুনা যায় না....

-কন কি দাদা...এইহানে কেমনে নির্জন পাইবেন? দেহেন না চাইরদিকে কেমুন কইতরের লাহান মানুষ জন। হেরা আপনেরে কি হেই ডাক হুনতে দিব?

-কথাতো খারাপ কস নাই..তাইলে কি করন যায়

-দেহি আপনের লিগা কি করতে পারি? 

মনার শিশু সুলভ আচরণের সাথে অনেকেই পরিচিত। তাছাড়া এই এলাকার অনেকেই মনাকে ভালোবাসে। মনা চাইলে তার জন্য স্থান ঠিক করে দেয়া কোন ব্যাপার না। কিন্ত্তু মনাতো কোন স্থানেই থাকতে চায় না। হুট করে আসে আবার চলে যায়। কিভাবে আসে কিভাবে যায়, সেটা সেই ভালো জানে। রশিদ অবশ্য তার জন্য জায়গা আগেই ঠিক করে রেখেছে। এখন যেহেতু মনা বলছে, তাহলে তার জন্য কাজটা সহজ হয়ে গেছে। সে মনাকে বললোঃ

-দাদা আপনের জন্য ঐ জায়গাটা ঠিক কইর‌্যা দেই?

রশিদ আঙ্গুল তুলে দেখায়। মনাও ঐ দিকটা দেখে। সে দেখতে পায়, গাছটির ঠিক উত্তর দিকে ক্ষাণিকটা খালি জায়গা পড়ে আছে। সেই জায়গাটাও খারাপ না। মনা বেশ খুশি হয়। বলে

-জায়গাটাতো ভালো। থাকতে দিব?

-হেইডা আপনে আমার উপর ছাইড়্যা দেন। আমি ব্যবস্থা করতে পারমু।

আশে পাশের লোকজনও রশিদের কথায় সায় দেয়। কারণ তারা জানে রশিদ হচ্ছে চেয়ারম্যানের ছেলে। সে তার বাবার কাছে যেয়ে যদি বলে তাহলে কোন ঝামেলাই থাকে না। তারা রশিদকে বলে মনা ভাইরে আমরা ঐ জায়গাতেই একটা ছোট ছাপড়া ঘর তুইল্যা দেই। ভাই ঐহানেই থাকবো নে। রশিদ হ্যা বলতেই তখন তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। মনার জন্য ছোট একটা ছাপড়া ঘরের ব্যবস্থা হয়ে যায়।

(চলবে)