পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ২২ মে, ২০১৬

মনা পাগলার মৌনতা...এবং সপ্তম পর্ব

(পুর্ব প্রকাশের পর হতে)

মনা এবং আজহার বেশ নিশ্চুপ হয়ে আছে। এদিকে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতের আঁধারে তলিয়ে যাচ্ছে সময়। চারিদিকে সুসান নীরবতা। আর ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। একচিলতে হ্যারিকেনের আলোয় পরিবেশটাকে কেমন যেন অচেনা করে তুলেছে। মনা তার পোটলা থেকে একটা ছবি বের করলো। তারপর সেটার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল একদৃষ্টিতে। কোন দিকেই তার দৃষ্টি যাচ্ছে না। সেই দৃষ্টিতে দেখা গেল একচিলতে বারিধারা। সিক্ত এ বারিধারা তার কপোল বেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। আজহার এ দৃশ্য দেখে অভিভুত হয়ে পড়লো। কিয়ের সে নিরাকারের চিন্তা করবে..পাগলের এ প্রেম দেখে আজহার আত্মহারা হয়ে গেল। সে মনাকে জড়িয়ে ধরে বললোঃ

-ভাই এইটা কার ছবি?

মনা চোখ মুছতে মুছতে বললোঃ

-আমার গুরুর ছবি।

আজহার কিছুক্ষণ ছবিটির দিকে তাকিয়ে থেকে কিছু বললো না। সে ভেতর বাড়ির দিকে চলে গেল। আর মনা সেই মনোরম পরিবেশে গুরুর ছবির ধ্যান করতে মনোনিবেশ করলো। কতোক্ষণ এভাবে ছিল-সে খেয়াল নেই। তাকে আজহার ডাকলো

-মনা ভাই..ও মনা ভাই...

-জ্বি...

-খাবেন। চলেন। আগে খেয়ে নেই। তারপর আবার বসা যাবে। 

মনা তার জিনিসপত্রগুলো গুচ্ছিয়ে রাখলো। তারপর একটা পাত্রে পানি দিয়ে নিজের হাতটা ভালোভাবে পরিস্কার করে ধুইলো। এরপর সে ও আজহার একসাথে খেতে বসলো। রমিজ একটা বলে করে ভাত নিয়ে এসেছে। সাথে একটা বাটিতে ঢেরসভাজি, ডিম ভাজা এবং ডাল নিয়ে এসেছে। রমিজ ভাত দিতে দিতে বললোঃ

-দাদা, তোরা কি সারারাত কথা কবি?

-বলতে পারি। ক্যান তোর কি কোন সমস্যা আছে?

-নাহ্। আমারও শুনতে ইচ্ছে করে। 

-তোর শোনার দরকার নেই। ব্যাস আর দিস না। মনা ভাইরে দে...

রমিজ মনার প্লেটটা নিয়ে তাতে ভাত তরকারি দিতে লাগলো। ভাত বেশি দেখে মনা...হা..হা...করে উঠলো। 

-আরে সর্বনাশ। ভাত আরো কমাইয়্যা দেও। 

মনা, আজহার আর রমিজ খাবার শেষ করে প্লেটগুলো গুছগাছ করে উঠিয়ে রাখলো। তারপর সেগুলো ভেতর বাড়িতে নিয়ে গেল। আসার সময় রমিজ চা নিয়ে এল। সেই গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে মনা আজহারের দিকে তাকিয়ে বললো

-বাই কি সত্যই সারারাইত কতা কইবেন?

-বলবো না মানে? দেখেন না কি করি...

-পারবেন তো

মনা হেসে বললো। তারপর দুজন আবার আয়েশ করে বসে পুর্বের কথায় ফিরে গেল। রাতের পরিবেশের সাথে তাদের কথা-বার্তার পরিবেশ এমনটাই মানিয়ে গেল যে আজহারের মনে হলো সে যেন এমন একটা পরিবেশের জন্যই অপেক্ষা করছিল। যার কাছ থেকে কিছু জানতে পারবে। যে জানাতে পারবে। অন্যদিকে মনার মনে হচ্ছিল তাকে এমন করে কেউ কখনো ডেকে আদর যত্ন করে খাওয়ায়নি..এমন আরামদায়ক বিছানায় ঘুমাতে পারবে...সেটা ছিল তার কাছে স্বপ্নের চেয়েও বেশি কল্পনাতীত। সে ভাবতেই পারছে না..দয়াময় কি খেলা খেলতে চাচ্ছে তার সাথে..

-কি চিন্তা করলারে ভাই...কিছুইতো কইল্যা না...

-আসলে চিন্তা কইর‌্যা কোন দিক-নির্দেশনা পাচ্ছি না...কোরআন মতে একবার মনে হয় সে নিরাকার। আবার মনে হয় সে আকার..

-আসলে তুমি এইভাবে চিন্তা কইর‌্যা কোনদিনও সঠিক নির্দেশনা পাইবা না...একটা বীজের কথা চিন্তা কর। এই বীজের উৎপত্তি অইলো কোথা থিক্ক্যা? কেমতে আইলো এই বীজের উপাদান? কৈ থিক্ক্যা ওর উপাদানগুলি পাইলো? এই দুনিয়ার কথাই ধরো না....অনেকেই কয় পন্ঞ্চ উপাদানে এই দুনিইয়্যা সৃষ্টি...এই উপাদানগুলি আল্লাহয় পাইলো কোইথিক্ক্যা? হেইডা চিন্তা করছো?

-হুম...সবকিছুই আল্লাহর মধ্যেই ছিল...

-কেমতে ছিল...

-সেটাতো বলতে পারবো না...সেটা তো বলা কারো পক্ষে সম্ভবপর না...

-তাই? তাইলে একটা হাদিছ হোনো। হাদিছে বলতাছে আবিদারা নামক এক সাহাবা একবার রাসুলপাকরে কইলোঃ "ইয়া রাসুল্লাহ (সাঃ) সৃষ্টির পুর্বে আল্লাহ পাক কোথায় আছিল? উত্তরে মহানবী (সাঃ) কইলোঃ সৃষ্টির শুরুতে আল্লাহ পাক আল-আমা নামক একটা কুয়ায় (অন্ধাকারাচ্ছন্ন কুয়াশা) কুচ্ঝটিকারুপে ছিলেন।" তাইলে নবী কইলো কেমতে? হেয় যদি আল্লাহর পরে সৃষ্টি অয়, তাইলে তারতো সৃষ্টির আগের কতা জাননের কতা না? আবার ধরেন আল্লাহ যহন আদমরে বানাইছে হেইসময়তো মহানবী (সাঃ)-র জন্মও অয় নাই। তাইলে কেমতে কইলোঃ "আমি তহনও নবী ছিলাম যহন আদম মাটি ও পানির মইদ্যে মিশ্রিত ছিল।" আবার আল্লাহ পাক নিজেই কইতাছেঃ"কুনতু কানজাম মাখফিয়ান ফা আহবাবতু আনউরাফা ফা খালাকতুল খালক।" আমি অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা কুপে গুপ্তছিলাম। নিজেরে প্রকাশের ইচ্ছায় সৃষ্টি করলাম।

-মনা ভাই..আপনে যে কথাগুলো হাছিস হিসেবে বলছেন, সেটার উৎস কোথায়? অর্থাৎ কোথা থেকে বলছেন? আপনি কি কারো কাছ থেকে শুনে বলছেন? না কোন বই পুস্তকে পেয়েছেন?

-বই পুস্তকেও পাইছি আবার মাইনশের কাছ থিক্ক্যাও হুনছি। আপনে যদি বিশ্বাস না করেন তাইলে আমি আপনেরে দেহাই ।আমার কাছে প্রমাণ আছে। এই দেহেন...মনা একটি বই আজহারের দিকে বাড়িয়ে দেয়

আজহার বইটা হাতে নেয়। বইটির নাম সুফীবাদ ও চার তরীকার পীর। লেখক এম.খলিলুল্লাহ। অনেক পুরোনো বই। পাওয়া যাবে কি-না সন্দেহ। কারণ বইটির আর কোন প্রকাশনা বের হয়েছে বলে জানা নেই। মনা বইয়ের ভাজ করা পৃষ্ঠাটা আজহারের দিকে এগিয়ে দিতেই দেখে...৩৯নং পৃষ্ঠায় মনা যা বলেছে তা ঠিকই উল্লেখ করা আছে। পার্থক্য হলো মনা বলেছে চলিত ভাষায় অর্থাৎ তার কথিত ভাষায় আর বইয়ে আছে সাধুভাষায়।

-ঠিক আছে। আসলে আমিতো তেমন জানি না। তাছাড়া ধর্মের ব্যাপারে আমার জানার আগ্রহ আছে। কিন্ত্তু পুরোপুরি জানিনা। তাই মাঝে মাঝে কারো দেখা পেলে কথা বলতে ইচ্ছে করে। জানতে ইচ্ছে করে সত্য কিছু...

-তাইলে তো আপনের কাছে গভীর কতা কওন যাইবো না..আপনে তো বুজবার পারবেন না...তহন আবার আমার ঝামেলা অইবো..

-না না একেবারেই যে জানি না...তা না। কিছু না কিছুতো জানিই...আর যা জানি তা আপনের মতো অত চিন্তা করে দেখি নাই...তাই হয়তো বুঝতে কষ্ট না হলেও চিন্তা করছি...ভাবছি.....বীজের কথা বলছিলেন

-আইচ্ছা বীজের কতা বলছিলাম...বীজটা কি? একটু ভাইব্যা দেহেনতো...এই একটা লাউয়ের বিচির কতাই ধরেন না...এই বিচির মইধ্যে কতো অগণিত লাউ প্রচ্ছন্নভাবে আছে..হেইডা কি কেউ গইন্ন্যা কইতে পারবো? মানুষের বীজের কথাই ধরেন না...একটা বীজের মইধ্যে অগণিত মানুষ...একটা মানুষের মইধ্যে কি আছে? তার মইধ্যে আল্লাহ আছে। আছে ছয় লতিফা...আছে... মোকাম..মন্ঞ্জিল...আছে আকল...নকল...অারো কতো কি?

মনার মুখে একথা শুনে আজহার একেবারেই হা হয়ে গেল। সে কখনো মানববীজ সর্ম্পকে এভাবে ভাবেনি। আজহার এই বীজের গভীরের কথা শুনে আবারো অপলক দৃষ্টিতে মনার দিকে তাকিয়ে রইলো।
(চলবে)