পৃষ্ঠাসমূহ

বুধবার, ১৮ মে, ২০১৬

মনা পাগলার মৌনতা.....এবং পঞ্চম পর্ব

(পুর্ব প্রকাশের পর)

লোকটি মনাকে শক্ত করে ধরে আছে। যেন মনা কোন দাগী আসামী। পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। মনা এক সময় একটু ক্ষেপে গিয়ে বললোঃ

-দুক্কু পাই। হাত ছারেন। আমি কি পলাইয়্যা যামু গা....

-ও সরি...আসলে আপনাকে দেখার পরই মনে হয়েছে আমি যেন আপনার মতো কারোর জন্য অপেক্ষা করেছিলাম।

-ভাইরে আমি সাধারণ পাগল মানুষ। আমারে লইয়্যা মাতামাতি করলে কোন লাব অইবো না। আমি কিছুই জানি না।

-যেটুকু জানেন, সেটুকুই আমার কাজে লাগবে। চলেন...ঐ যে আমাদের বাড়ী। 

মনাকে নিয়ে লোকটি তাদের বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা হলো। এদিকে দিনমণি তখন ডুবে যাবার পালা। সকলের কাছে সে যেন বিদায় চাইছে। যাবার আগে দিনমণি পরিস্কার আকাশে কেমন একটা রক্তিম আভা ছড়িয়ে একটা মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি করে দিয়েছে । সেই রুপ এবং রসের আধারে মনা এবং সেই লোকটি যেন তার রস আস্বাদন করতে চাইছে। রাস্তায় বৃষ্টির পানিতে ভিজে কাদামাটিতে একাকার হয়ে গেছে। আর কাদার পরিমাণ এতোটাই বেশি যে হাঁটা চলা করা মুশকিল। তারপরও তারা পা টিপে টিপে বাড়ীর কাছাকাছি আসতে আসতে সন্ধ্যা নেমে গেছে। চারদিকে গাছ-গাছালি আর পাখ-পাখালির ডাক। তার উপর জোনাকী পোকার আলো। কেমন যেন একটা মনকাড়া ভাব এনে দেয়। লোকটি একটি দরোজার সামনে কড়া নেড়ে জোরে ডাক দিলঃ

-রমিজ..এই রমিজ..দরজা খোল..
ওপাশ হতে একটা কিশোর দরজাটা খুলে দিল। দ্যাখে তার দাদার সাথে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। ময়লা জামা-কাপড় পড়া। গায়ের রং জং ধরা কেমন যেন কালো-ধুসর বর্ণের। মাথায় কেমন উসকো খুসকো চুল। মাথা চুলকাচ্ছে।  ঐ লোকটিকে দেখে রমিজ তার দাদাকে জিগ্যেস করেঃ

-দাদা তোর সাথে কেরে?

-তুই চিনবি না। তুই এককাজ কর। ঘরটা ভালো করে গুছিয়ে দে। আর আমাদের বালতিতে করে পানি দে। হাত পা ধুতে হবে।

রমিজ মাথা নিচু করে পানি আনতে যায়। কিছুক্ষণ পর একটা বালতিতে করে পানি নিয়ে আসলো। তারপর মনাকে বললো হাত পা ধোয়ার জন্য। মনা ভালো করে হাত পা ধুয়ে জামার আস্তিনে হাত মুখ মুছলো। তা দেখে রমিজ খিল খিল করে হেসে উঠলো। তারপর একটা গামছা এগিয়ে দিল। মনা সেটা নিল না। সে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। ঠিক সেই সময় মনা দেখতে পেল একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা হেরিকেনের আলো হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে শাড়ির আঁচল কামড়ে ধরে আছে। মহিলাটি বেশ পরিস্কার। তার পরনে হাল্কা লাল পেড়ে সাদা শাড়ি। তারপর সে ডাকলোঃ 

-বাবা আজহার, তুমি আইছো? তোমার সাথে ঐটা কে?

-ও তুমি চিনবে না, মা। 

-একটা অচেনা মানুষকে এই ভর সন্ধ্যেবেলা ঘরে নিয়ে এলি,বাবা?

-মা, তুমি ভয় পেয় না। সে খারাপ লোক না। বিজ্ঞের মতো কথা বলে। আবার গানও জানে। আজকে ওর কথা সারারাত শুনবো বলে নিয়ে এসেছি। প্লীজ মা, তুমি কিছু বলো না...

-তোর যা খুশি কর। কিন্ত্তু এমন একটা লোককে এই বাড়িতে আশ্রয় দেয়াটা কি ঠিক? তুই তো আমার কথা শুনবি না, তোর যা ইচ্ছা কর.....

এ কথা বলে মহিলাটি ভেতর বাড়ি চলে গেল। মনা দাড়িয়ে দাড়িয়ে সবকিছু শুনলো। মনার ইচ্ছে করছিল ঐ মুহুর্তে সে এই স্থান ত্যাগ করে। দিন হলে হয়তো ঠিকই করতো...কিন্ত্তু এই সন্ধ্যা বেলা সে কোথায় যাবে..কার কাছে যাবে...কেউতো তাকে কাছে রাখতেই চাইছে না। কেমন যেন দুর দুর করে তাড়িয়ে দিতে পারলেই যেন বাঁচে....মনা সেই মুহুর্তে জেনে নিল ঐ লোকটির নাম আজহার। আজহার ভাই ভালো লোক। তার ভেতর সে সত্যের ঝিলিক দেখতে পেয়েছিল। সেই সত্যের পরশটা পাবার জন্যই সে আজহারের সাথে এসেছে। 

-কি ব্যাপার মনা ভাই? আপনি দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? ভেতরে আসুন।

মনা সম্ববিত ফিরে পেয়ে আস্তে করে ঘরের ভেতর প্রবেশ করলো। টেবিলের উপর হারিকেন জ্বলছে। সেই আলোয় চারপাশটা পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। যেখানে টেবিলটা রাখা তার পাশেই একটি বড়ো খাট আছে। দরজার ওপাশটায় আরেকটা খাট আছে। সেই খাটের পাশেরই ছোট একটা জানালা। মনা সেখানে আয়েশ করে বসলো। একটু পরেই একটা ট্রেতে করে রমিজ আদা চা আর মুড়ি নিয়ে এল। তারপর তার দিকে চায়ের পেয়ালাটা এগিয়ে দিল। একমুঠ মুড়ি মুখে পুড়ে আজহার চিবুতে চিবুতে বললোঃ 

-মনা ভাই, আজকে কিন্ত্তু আপনাকে ঘুমাতে দেব না। দরকার হলে সকালে ঘুমাবেন। থাকবেন আমার এখানে। কোন সমস্যা নেই। বাড়ীতে আমি মা আর আমার ছোট ভাই ছাড়া আর কেউ নেই। কাজেই কোন ঝামেলা নেই। বুঝতে পারছেন তো?

-ভাইরে পারছিতো। কিন্ত্তু আমার কাছে কি জানতে চাও হেইডাইতো জানি না...মনা চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললো।

-আসছি সেই কথায়। তার আগে খেয়ে নেই..

চা শেষ করে আজহার মনার পাশে এসে হেলান দিয়ে বসলো। অন্যপাশে মনা বসলো। তারপর আজহার মনাকে প্রশ্ন করলোঃ

- আমার জানার আগ্রহ সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি সর্ম্পকে এবং তার নিজের সর্ম্পকে।

সেই কথা শুনে মনা বললোঃ

-সৃষ্টিকর্তা সর্ম্পকে পরিস্কার ধারণা তুমি পাইবা না। তুমি যেইটা পাইবা সেইটা হইলো একটা ধারণা। এই ধারণা অনেকটা অনুমান নির্ভর। সঠিক ধারণা তুমি তখনই পাইবা যহন দেখবা তোমার আর তার মাঝে কোন পার্থক্য নাই। তুমি তোমার নিজের মতোই তারে পাইবা। ধর একটা আয়না। হেই আয়নায় যুদি তুমি তোমারে দেহ..তাইলে কি দেকবা? তোমারে দেকবা? তাই না? কেমতে দেকবা? দেকবা হেইডা তোমার মতোই কিন্ত্তু উল্টা। কিন্ত্তু হেইডা যুদি তোমার সামনে আইস্যা দাঁড়ায়, তাইলে কিন্ত্তু উল্টা দেকবা না। দেকবা ভাবদি। মানি তোমার মতোই। তুমিও যা হেও তা। দুডার মইদ্যে কোন পার্থক্য নাই...

-তার মানে আমি অায়নায় যে ছবিটা আমার দেখছি, ঠিক সেইরুপ অবয়ব আমার ভেতরেই একটা অস্তিত্ব আছে। সেই অস্তিত্বটাই যদি আয়নায় দেখি তাহলে দেখবো আমার মতোই কিন্ত্তু উল্টা। আর সেটা যখন আমার সামনে এসে দাড়াবে, তখন সেটা দেখতে আমার মতোই হবে.....হাউ স্ট্রেন্ঞ্জ...হাউ ক্যান ইট পসিবল...

-বাই রে পসিবল টসিবল বুঝি না...অনেক অলি আউলিয়ারা তাই দেকছে। তাগো কালাম যুদি তুমি পড়, তাইলে দেকবা হেইহানে পরিস্কার কইর‌্যা হেরা বলতাছে...

বাহার সু জ্বালুয়া.ই দিলদার.ই.দিদাম
বাহার চিজ ই.জামাল.ই.ইয়ার দিদাম। ।

না দিদাম হাইচ.ই.জামাল.ই.ইয়ার দিদাম
পুর ইজ ওয়াই কুচা ও বাজার দিদাম।।

ছো খুদরা বিন গারাম দিদাম হামুন সাত
জামাল.ই.খুদ.জামাল.ই.ইয়ার দিদাম।।

নামায ই জাহিদান মেহরাব ও মিনবার
নামায ই আশকান বার দার দিদাম।।

জো এইাক জুররা রাসিদ আজ গায়িব এ হাফিজ
হামা আকাল ও খিরাদ বিকার দিদাম।।

[সুত্রঃ হাফিজ সিরাজি]

(চলবে)