পৃষ্ঠাসমূহ

সোমবার, ১৬ মে, ২০১৬

মনা পাগলার মৌনতা.....এবং -তৃতীয় পর্ব

(পুর্ব প্রকাশের পর হতে)

মনা কতোক্ষণ এভাবে বসে ছিল ঠিক মনে করতে পারছে না। তার পা ধরে এল। শরীরটা বেশ ভারী মনে হচ্ছে। একসময় সে তাঁর মুর্শিদের স্বরণে বিভোর হয়ে সেজদায় লুটিয়ে পড়লো। তারপর উঠে বসলো। বৃষ্টিটা থেমে গেছে। কিন্ত্তু চারদিকে রেখে গেছে একটা শীতল অনুভুতি। সন্ধ্যা হতে তখনো অনেক সময় বাকী। কিন্ত্তু পরিবেশটা এমন যেন এক্ষুণিই সন্ধ্যা গড়িয়ে আসবে। মনা মনে মনে চিন্তা করলো রাতে কোথায় থাকবে? আর কোথায়ই যাবে...আশে পাশে কাউকেই সে দেখতে পাচ্ছে না। স্কুল ঘরের দারোয়ানও নেই। অবশ্য যে স্কুল তাতে চোর আসলেও চোরের শুধু শুধু সময়ই নষ্ট হবে। নেয়া মতো কোন কিছুই নেই। কাজেই স্কুলে দারোয়ান রাখা হয়নি। ভাবলো-আজ রাতটা এখানে কাটালে কেমন হয়? কিন্ত্তু চেনা নেই জানা নেই এমন একটা পরিবেশে থাকাটা কি ঠিক হবে? ভাবতে ভাবতে মনা উঠে দাঁড়ালো। নাহ্ এখানে থাকা ঠিক হবে না। যেখানে নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই সেখানে থাকাও নিরাপদ নয়। মনা কোন দিকে না তাকিয়ে হাঁটা শুরু করলো।

রাস্তা-ঘাট কাদা পানিতে মাখামাখি। লোকজন বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়ে ছিল। বৃষ্টি তাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে বাধা দিয়েছিল। এখন আর সেই বাধা নেই। মেঘ কেটে গেছে। লোকজন দলে দলে বের হচ্ছে। মনা সে দিকটায় গেল। তারা একটা চায়ের দোকানে বসলো। মনাও তাদের সাথে বসলো। মনাকে দেখে সবাই ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো। তাকে তো এ অঞ্চলে কখনো কেউ দেখেছে বলে মনে হয় না। সবাই বার বার তার দিকে তাকাচ্ছে। মনাও তাদের দিকে তাকাচ্ছে। তারপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে মনা বললোঃ 

-ভাই আমারে কড়া দেইখ্যা একটা লিকার চা দেন। ডাইরেক্ট লিকার।

দোকানী অবাক হয়ে মনার দিকে তাকিয়ে বললোঃ

-খাইতে পারবেন তো?

-একটু চিনি বাড়াইয়্যা দিয়েন। তাইলেই অইবো।

দোকানী চিনি দিতে দিতে জিগ্যেস করলোঃ

-আপনেরেতো আগে কহনো দেহি নাই..এইহানে থাহেন

-নারে ভাই..আমি কই থাকি কই খাই কিছুই জানি না। সে সব জানে...

-হেয় কেডা... 

-আরে মিয়া হেরে চিনলা না..হেয়ইতো সব। যব কুছভি না থা তব ম্যায় থা...যখন কোনকিছুই ছিল না তখন আমি ছিলাম।

দোকানী কি বুঝলো কে জানে কিন্ত্তু আশে পাশের লোকজন মনার দিকে তাকিয়ে রইল। সবাই মনাকে দেখছে...দোকানী মনাকে লক্ষ্য করে চা টা এগিয়ে দিল। মনা চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললোঃ

তুহি হ্যায় হিন্দু তুহি মুসলমান
তুহি বুৎখানা তুহি হ্যায় কাবা
তোমহারা পুজন তোমহারা ভজন
সবার হৃদে তব সিংহাসন।।

তুমিই হিন্দু তুমিই মুসলমান। তুমিই বুৎখানা তুমিই কা'বা। সবাই তোমারই পুজা-আর্চনা করছে । তোমারই ভজনা করছে। তুমিই সবার হৃদয়েই আছো। তোমার সিংহাসন হচ্ছে এই মন-মন্দির। কুলুবুল মো'মেনিনা আরশু আল্লাহ। মোমিনের কলবেই আল্লার বাস। আল্লাহ মোমিনের কলবের মইদ্যেই থাহে...এইডা হাদিসের কথা।

মনার কথা শুনে পাশে বসা রমিজ মিয়া মনাকে জিগ্যেস করলঃ

-বাবা তোমারেতো এই গ্রামে কহনো দেহি নাই...কই থিক্ক্যা আইছো?

মনা রমিজ নামক বৃদ্ধলোকটির দিকে তাকিয়ে বললোঃ

-কইথিক্ক্যা আইছি তা কইতে পারুম না। কেমতে কমু? আমি কি জানি আমি কই আছিলাম। আমি যেইহানে আছিলাম হেইজায়গাডা ছিল অন্ধকারে ঢাকা। অন্ধকারে কেমতে চক্ষে দেহুম...

-আরে মিয়া আমি তোমারে হেই কথা জিগাই নাই। আমি জিগাইছি তোমার বাসা কই?

-বাসা...পরের জায়গা পরের জমি ঘর বানাইয়া আমি রই আমিতো সেই ঘরের মালিক নই...আমার কোন বাসা নাই। যেইহানে রাইত হেইহানেই কাইত।

-এই গরামে কেমতে আইল্যা..

-পাঠিয়ে দিয়েছ তাইতো এসেছি...আমি কিছুই জানি

-বাই এই পাগলের লগে কি কথা কন। বাদ দেনতো...পাশে থেকে রহিম বললো। রহিমের কথা শুনে রমিজ মিয়া একেবারেই থেমে গেল। থেমে গেলে কি হবে..সে আড় চোখে মনা দেখতে লাগলো। মনা নির্বিকার চিত্তে চুক চুক করে চা খাচ্ছে। সে কারো দিকেই আর কোন দৃষ্টিপাত করছে না।

লোকজন আস্তে আস্তে করে উঠে যেতে লাগলো। আরো কিছু লোকজন জড়ো হচ্ছে।  তারা কেউ চা খাচ্ছে। কেউ সিগারেট ধরিয়েছে। যারা আসছে তারাও মনাকে দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। কিন্ত্তু তারা কেউ মনাকে কিছু বলছে না। শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। এর মধ্যে মনা দেখতে পেল একটা লোক অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে । অনেকক্ষণ ধরেই মনা তাকে দেখছিল। এবার তাদের মধ্যে দৃষ্টিপাত হলো। মনা তারে ইশারায় ডাকলো। লোকটি উঠে এসে মনার পাশে বসলো। মনা তাকে বললোঃ

-ভাই, আপনে আমার দিকে তাকাইয়্যা কি দেকতাছেন?

-দেখছি। আপনার ভেতর সেই ভাব আছে। যে ভাবটাকে বলা হয় প্রেমের ভাব। যা সহজেই কেউ রপ্ত করতে পারে না। আর আপনি কি সহজেই সেই ভাব নিয়ে বসে আছেন। আচ্ছা, আপনি যে একটু আগে একটা গান গাইছিলেন, সেটা কি আপনে লিখেছেন?

লোকটির কথা শুনে মনার বেশ ভালো লাগলো। মনা বুঝতে পারলো লোকটি বেশ শিক্ষিত এবং মার্জিত স্বভাবের। কতো সুন্দর করে কথা বলছে। একটুও তাকে ঘৃণা করছে না..মনা তার দিকে তাকিয়ে বললোঃ

-না। গানের কথা লেকছে হযরত খাজা শাহ্ পীর চিশতী (রহঃ)। আমি এই গানডা হুনছিলাম একটা ক্যাসেটে। হেইডাই মুখস্ত করইয়্যা গাইছি।

(চলবে)