পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ১৫ মে, ২০১৬

মনা পাগলার মৌনতা এবং.........দ্বিতীয় পর্ব

(প্রথম পর্বের পর হতে)

মনা দেখলো যে তার বাসস্থানের ঝামেলাটা মোটামুটি মিটেছে। কিন্ত্তু মনা জানে, তার জন্য যেটা নির্দিষ্ট করা হয়, তা কিছুদিন সত্য থাকে। তারপর সেটা হারিয়ে যায়। আজকে যেটা মনার জন্য নির্দিষ্ট। কালকের জন্য সেটা অনির্দিষ্ট। তারপরও মনা মনে মনে ভাবলোঃ ‍‍‌যা পাওয়া যায়, তা না পাওয়ার থেকে অনেক ভালো।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো। লোকজন যার যার গন্তব্যের দিকে চলে যেতে লাগলো। স্থানটা ফাঁকা হতে শুরু করেছে। পাখির কলকাকলিতে মুখরিত স্থানটিতে বেশ ভালোই লাগছিল মনার । মনা কেমন যেন তন্ময় হয়ে যাচ্ছে। তার ভেতর কে যেন জানান দিচ্ছেঃ তুমি যেটা করতে চাচ্ছ, সেটা তোমার জন্য নির্ধারণ করা হয়নি। তোমাকে যে কাজ দেয়া হয়েছে সেটাই তুমি কর। কেন তুমি অন্যের দাসত্ব করতে চাচ্ছ? তোমার প্রভুতো কারো দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ নয়। তাহলে তুমি কেন সেই শৃংখলে আবদ্ধ হতে যাচ্ছ? তোমার এই শৃংখলে আবদ্ধ হওয়া ঠিক হবে না।
কথাটা শুনে মনা চমকে উঠলো। সে তো ঠিকই বলছে। মুক্ত পাখিকে বন্ধী করা হলে সে যেমন দাপিয়ে বেড়ায়, ঠিক তদ্রুপ মনাও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সে উঠে দাঁড়ালো। তারপর রশিদের দিকে তাকিয়ে বললোঃ

-ভাইরে আমার লিগা তোর ছাপড়া ঘর বানানের দরকার নাই।

-কন কি দাদা? সব কিছু ঠিক কইর‌্যা হালাইছি আর আপনে চইল্যা যাইতে চাইতাছেন? কি হইছে?

-কি হইছে, হুনবি?

-না কইলে কেমতে হুনমু?

-তয় হোন...পাগলের জন্য কোন ঘর নির্দিষ্ট করা থাকে না। যেইডা থাকে হেইডা অইলো মাটির ঘর।  বুঝছস...

এ কথা বলেই মনা হন হন করে হাঁটা শুরু করলো। কারো দিকে সে তাকাচ্ছে না। সে হাঁটছে আপন মনে। তার হাঁটার ধরণ দেখে সবাই কেমন যেন হতভম্ভ হয়ে গেল। কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। কি করবে...রশিদও কেমন যেন ম্রিয়মান হয়ে গেল। সেও অন্যদের মতো মনার হাঁটা দেখছে...

মনা হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে একটা গাছের ছায়ায় বসে পড়লো। আর ঐদিকে আকাশে মেঘের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। আকাশটা কালো মেঘে ঢেকে যাচ্ছে। যে কোন মুহুর্তে ভারি বর্ষণ হতে পারে। সেই বর্ষণে মনা কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। আশে পাশে কোথাও কোন লোকালয় দেখা যাচ্ছে না। মাঠের পর মাঠ। আর মাঠের দুপাশ দিয়ে কাঁচা রাস্তা। রাস্তার ধারে ঝোপঝাড়। আকাশটা অণ্ধকার হয়ে যাওয়ায় কেমন যেন একটা ভুতুরে পরিবেশের সৃষ্টি হলো। মনা ভালো করে তাকিয়ে দেখতে লাগলো কি করা যায়...ঠিক সেই মুহুর্তে মেঘের ভারী গর্জন শোনা যাচ্ছে...বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে...মনা বৃষ্টিতে ভিজছে। ভিজে কাক হয়ে মনা হাঁটতে হাঁটতে একটা স্কুলের দেখা পেল। সে স্কুলের বারান্দায় উঠে বসলো। তারপর গায়ের ময়লা জামাটা খুলে ভালো করে চিপড়ালো। ঝাড়া দিয়ে সেটা দিয়ে মাথাটা মুছলো। লুঙ্গিটাও ভিজে গেছে। লুঙ্গিটির একটি কোণা ধরে সে সেটাকে নিংড়ালো। বেশ কিছু পানি বার করার পর সে সেটাকেও ঝাড়া দিল। স্কুলের টিনের চালে বৃষ্টির একটানা রিমিঝিমি শব্দ শোনা যেতে লাগলো। আর টিনের ছাদের কোণা ধরে পানি পড়ার শব্দ পাচ্ছে। দুরের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করে তাকালো বাহিরের দিকে। ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। কোন কিছুই ষ্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। মনা বারান্দার একটা কোণায় বসে পড়লো। হেলান দিলো একটা পিলারের গায়ে। তারপর আলতোভাবে চোখ বুঁজে ধ্যানের দিকে হারিয়ে যেতে লাগলো।

ধ্যান মুলতঃ কোন একটা বিষয়ের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করে সেটার দিকে খেয়াল করা বা রাখা। ধ্যান ধৈ ধাতু হতে এসেছে। যার অর্থ চিত্তকে নিবন্ধ করা। যার দিকে চিত্তকে নিবন্ধ করা হয় সেটা হচ্ছে ধেয়্য আর যিনি ধ্যান করেন তিনি হচ্ছেন ধ্যেয়ী। আর পুরো বিষয়টা হলো ধ্যান বা মেডিটেশন । মোরাকাবা মোশাহেদা। পার্থক্য হলোঃ কে কোন্ বিষয় নিয়ে ধ্যান করবেন, সেটা তার নিজস্ব বিষয়। গুরু কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে অনেকেই ধ্যান করেন। মনাও করছে। মনা যেটা করছে সেটা হলো গুরুর প্রতিচ্ছবি তার অন্তরের মণিকোঠায় নিয়ে আসা। সে প্রথমে তার শ্বাস-প্রশ্বাসের দিকে খেয়াল করছে। দেখলো শ্বাস খুব আস্তে আস্তে প্রবাহিত হচ্ছে। অর্থাৎ মন এখন শীতল অবস্থায় আছে। বিক্ষিপ্ত অবস্থায় নেই। অর্থাৎ অচন্ঞ্চল অবস্থায় আছে। সে আস্তে আস্তে দেখতে পেল তার গুরুর প্রতিচ্ছবি তার নিকট স্পষ্ট হয়ে আসছে। সেটা এতোটাই স্পষ্ট হতে শুরু করেছে যে মনে হচ্ছে মনা হাত দিয়ে তার গুরুকে ধরতে পারবে। সে সেদিকে দৃষ্টি নিবন্ধিত করে অচন্ঞ্চলভাবে বসে রইলো।
(চলবে)