পৃষ্ঠাসমূহ

সোমবার, ৪ জানুয়ারী, ২০১৬

শ্বেতার ডায়রী-অষ্টম পর্ব

(সপ্তম পর্বের পর)

শ্বেতা তার ডায়রিতে লিখেছিলঃ

তারিখঃ২২শে এপ্রিল,২০১৪
বারঃমঙ্গলবার

প্রিয় সাজিদ,
তোমায় ভালোবেসেছি আমি, তাই
শিশির হয়ে থাকতে যে ভয় পাই,
তোমার কোলে জলের বিন্দু পেতে
চাই যে তোমার মধ্যে মিশে যেতে
শরীর যেমন মনের সঙ্গে মেশে
জানি তুমি আমার কোনদিন মনের মতো হবে না। তোমাকে যতবারই আমি আমার মনের মতো সাজাতে চেয়েছি, ততই তোমার পাগলামি বেড়েছে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়েছে, তুমি হয়তো আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবেই তোমার পাগলামির মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছো। ওমন ভরদুপুরে কেউ হাঁটে না। অথচ তুমি আমাকে নিয়ে সেই চৈত্রের ভরদুপুরে হাঁটলে। বললে-সুর্য স্নান হবে। সুর্যের আলোয় আলোকিত হব। কিন্ত্তু বাস্তবে কি হলো? বাড়িতে গিয়ে আমাকে আম্মুর বকা শুনতে হলো। জ্বর হলো। ডাক্তার ডাকতে হয়েছিল। তুমি জানো যে, আমি রোদে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারি না। কিন্ত্তু তোমার কথা আমি ফেলতে পারিনি। তোমার পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে হাঁটতে পারা আমার জন্য বেশ রোমান্টিক অনুভুতির জন্ম দিয়েছিল। সেই রোমান্টিক অনুভুতির ঘোর কাটলো ১০২ ডিগ্রী জ্বর নিয়ে। আচ্ছা, আমার যখন জ্বর হয়েছিল, তোমারো কি জ্বর হয়েছিল?

আমি শ্বেতাকে বলতে পারিনি-আমার জ্বর হয়েছিল। সত্যিইতো আমার কোন জ্বর হয়নি। কারণ, আমি শ্বেতার মতো কোন ধনীর দুলারী নই। আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। আমাকে রোদ বৃষ্টির কথা চিন্তা করলে চলে না। ব্যাঙের মতোন চলতে হয় আমাদের। আমাদের কোন রাজপ্রাসাদ নেই। ভাঙ্গা টিনের চালের উপর বৃষ্টির পানি যখন টুপ টুপ করে পড়ে তখন জীবনানন্দ দাসের মতোন ওমন উঁচু স্তরের কবিতা বের হয় না। প্রচন্ড খররৌদ্রে যখন টিনের চালা আগুন গরম হয়ে ওঠে, তখন ঠান্ডা এসির বাতাস কল্পনা করি না। ভোরের সোনালী সুর্যালোক যখন ভাঙ্গা টিনের চালা গলিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে তার প্রখরতা জানান দেয়, তখন  জীবনের দর্শন আমরা লাভ করি বাস্তবতার নিরিখে। বাস্তবতাই আমাদের দর্শন শেখায়। আমরা দার্শনিক হই কেবল বেঁচে থাকার ন্যুনতম প্রয়াসে। যেটা গালিব বলেছিলঃ

মত পুছ কে ক্যা হাল হ্যায় মেরে তেরে পিছে
তু দেখ কে ক্যা রঙ্গ হ্যায় তেরে মেরে আগে।।

যে ভালোবাসা একসময় আমাকে স্বপ্ন দেখাতো, সেই স্বপ্নসাধটা ধুলিস্মাৎ হয়ে যাচ্ছে কেবল আমারই ভুলে। কিন্ত্তু ভুলটা কি সত্যিই আমার? আমি যা করি, তা কি সত্যিই ইচ্ছাকৃত? না-কি যে ইচ্ছাময় আমাকে চালাচ্ছে, তারই কোন গোপন ইচ্ছার অভিব্যক্তি? আমার মনে পড়লো মীর্যা গালিবের আরেকটি শায়েরঃ

হাজারো খোয়াইশে অ্যাসে কি হর খোয়াইশ পে দম নিকলে
বহুত নিকলে মেরে আরমান লেকিন ফিরভি কম নিকলে।।

ভোরের আলোয় ফুটে ওঠার সাথে সাথে দেখলাম জনা দুয়েক মুসল্লি হাঁটা চলা করছে। ইব্রাহিম কর্ডিয়াক হাসপাতালের সামনে দেখলাম একটা এম্বুলেন্স পো পো করে বের হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন এ দুনিয়ার মায়া ছেড়ে ওপারে চলে গেছে। আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে দেখলাম কান্নার রোল পড়ে গেছে। আর ডায়বেটিস হাসপাতালের সামনে দেখলাম আস্তে আস্তে ডায়বেটিস রোগীদের সিরিয়ালটি দীর্ঘায়িত হচ্ছে। কি বিচিত্র দৃশ্য এটি। কি নির্মম অথচ কতো বড়ো সত্য। বেঁচে থাকার তাগিদে একদল আসছে হাসপাতালে আর ঐ হাসপাতালের অন্য পাশ দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে ওপারে। না ফেরার দেশে...অন্যদিকে যে পাশটায় আমি বসে আছি সেইপাশটা সম্পুর্ণ বিপরীত। নতুন করে জীবন সাজানোর বিলাশ বহুল প্রসাধন নিয়ে বসে আছে ফুল ক্রেতারা। 

একেতো সারাটা রাত একটা দুঃবির্ষ জার্নি করা তার উপর মন খারাপ করা একটা দৃশ্য..নির্মম বাস্তবতার দৃশ্য...উঠতে হবে আমাকে..যেতে হবে বহুদুর। এখনো অনেক পথ পাড়ি দেয়া বাকী। আমি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালাম।

(চলবে)