পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ১৬ জানুয়ারী, ২০১৬

করিম সাহেবের চিন্তা-ধারা ও হাঁস মুরগীর ছানাপোনা - তৃতীয় পর্ব

(দ্বিতীয় পর্বের পর হতে)

রহিমা রান্না ঘরে চলে যেতেই করিম সাহেব আবার চিন্তা-ভাবনা শুরু করে দিলেন। তিনি আজকে সকালে যে বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করছেন, তার একটা সমাধান আজকের মধ্যেই বের করতে হবে। তিনি চান আজকের মধ্যেই বিষয়টি নিষ্পত্তি করে ফেলতে। তিনি তার ভাবনায় আবারো ডুবে গেলেন।

তিনি আবারো বইটি হাতে নিলেন এবং পড়া শুরু করে দিলেন। 

ইবনুল আরাবীর দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠগ্রন্থ "ফুসুল-উল-হিকাম"। এই গ্রন্থখানি ২৭টি অধ্যায়ে লিখিত এবং প্রত্যোকটি অধ্যায় এক একজন নবীর নামের শিরোনামায় উল্লেখিত। এই গ্রন্থে সুফীবাদের বিভিন্ন বিষয় সর্ম্পকে আলোচনা করা হয়েছে। তার রচনার পদ্ধতি, ভাষা, উপমা ইত্যাদি অত্যন্ত জটিল,দুর্জ্ঞেয় ও দুর্বোধ্য হওয়ার ফলে অনেকে তাঁর অর্থ বুঝতে পারেননি এবং তাঁর মতো একজন মুক্তবুদ্ধি, গোঁড়ামিশুন্য, উদারমনা, প্রত্যাদিষ্ট ধর্মের বাহ্যিক অর্থের সমালোচক ইবনে তাইমীয়া, আল-তাফতাযানী ও ইব্রাহিম আল বিকায় প্রমুখ চিন্তাবিদ "যিন্দিক" বা কাফের বলে আখ্যায়িত করেন। যারা তাঁর মতবাদ বুঝতে সক্ষম হয়েছেন, তাঁরা তাঁকে "সিদ্দিক" বা বিশ্বাসী, "শায়খুল আকবর বা শ্রেষ্ঠ শায়খুল, 'হাকায়েক' বা সভ্যতার সমুদ্র বলে উল্লেখ করেছেন। জামালউদ্দিনের মতে, " তিনি জ্ঞানীকুলের শিরোমণি এবং আল্লাহ তাকে সব রকম জ্ঞান দান করেছেন।" তার ফুসুল-উল-হিকাম এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস নিম্নরুপঃ

প্রথম অধ্যায়ের নাম " আদমের জ্ঞান"। আদম বিশ্ব জগতে আল্লাহর প্রতিনিধি। মানুষ হিসেবে আদমের উচ্চ স্থানের কথা বলা হয়েছে। মানুষ সকল ঐশীগুণ সমন্বিত ক্ষুদ্র বিশ্ব এবং সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ জীব, সৃষ্টির প্রথম ও শেষ কারণ, আল্লাহর পুর্ণ-প্রকাশ, পুর্ণ-মানব, পুর্ণ-জ্ঞানের অধিকারী। ফেরেস্তাগণ আল্লাহর শক্তি, আল্লাহর নাম ও গুণে প্রকাশ, তাঁদের জ্ঞান ও গুণের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বিশ্ব জগৎ আত্মসচেতন নয়। বাইরের দিক দিয়ে আলোচনা করলে বলতে হয় যে, এটা আল্লাহর জ্ঞানের মধ্যে অবস্থিত। দৈহিক বহুত্বের জন্য সত্তাকে বহু বলা যায় না। মানবতাও মুলতঃ এক। সবকিছুর মুলে এক।


তিনি আদমের জ্ঞান অধ্যায়টি কয়েকবার পড়লেন। কিন্ত্তু তাঁর দৃষ্টি নিবন্ধিত রইল কেবল একটি বিষয়ের উপর। আর সেটা হলোঃ সবকিছুর মূলে এক। তার মানে কি? সমগ্র বিশ্ব তাঁরই মুকুর। তিনিই জ্ঞানের আধার। তিনিই সব। সব কিছুই তিনি। তাহলে আদম এবং হাওয়া বলে যে কথাটি আছে-সেখানে হাওয়া সৃষ্টির কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না। হাওয়া কি আদমের মতোই কোন সৃষ্টবস্ত্তু? না-কি অন্য কোন উপায়ে হা্ওয়াকে সৃষ্ট করা হয়েছে? তাছাড়া আদমকে যখন সৃষ্টি করা হয় তখন ফেরেস্তারা তা দেখেছে। যখন আদম ছিল তখন হাওয়ার কোন অস্তিত্বই ছিল না। হাওয়া আসছে পরে। তার জাওজ হিসেবে। কোরআনেও সেটা উল্লেখ করা হয়েছে জাওজ বলে। তার মানে - আদমের ভিতরই কি হাওয়ার অস্তিত্ব ছিল? না-কি হাওয়া হটাৎই সৃষ্টি হয়েছে এবং মানবীয় রুপ ধারণ করে তার জাওজ হিসেবে আর্বিভুত হয়েছে? তাছাড়া আদমের সৃষ্টির ব্যাপারে কোরআনে যেরুপ বর্ণনা করা হয়েছে-হাওয়াকে সৃষ্টির ব্যাপারে সেরুপ বর্ণনা অনুপস্থিত। কিন্ত্তু কেন? এর কারণ কি? তিনি ভেবে পেলেন না। কারণ, যখন আদম ছিল তখন হাওয়া ছিল না। আদমকে যেভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে সেভাবে যদি হাওয়াকে সৃষ্টি করা হয়, তাহলে সেখানে আদমের উপস্থিতি অনস্বীকার্য। আদমের দেখার কথা। আদম দেখলো-তার সম্মুখে একটা রমনীরুপে হাওয়াকে। তাহলে সে কিভাবে আদমের মতো সৃষ্ট পদার্থ হয়? তাহলে সে কি সৃষ্টির বাইরের কোন অস্তিত্বের কেউ? যে তাঁর সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছে স্বয়ং সম্পূর্ণরুপে? তাহলে আদমের কাছে হাওয়া কি একটি রহস্যের নাম? যে রহস্যের ভেদ অজানা? কি ধরে নেব?

করিম সাহেবের মাথা ঘুরতে লাগলো। তিনি আবারো একটি সিগারেট ধরালেন। ঠিক সেই সময় রহিমা চায়ের কাপ নিয়ে হাজির। একটি প্লেটে করে মুড়ি ভেজে এনেছেন। তিনি চা এবং মুড়ি টেবিলের উপর রাখলেন। করিম সাহেব সিগারেটের ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন-আচ্ছা তুমি কি হাওয়া সর্স্পকে কিছু জানো?

আচানক এ প্রশ্ন করায় রহিমা অপ্রস্তত হয়ে ঘাবড়ে গেল। সে কি বলবে, ঠিক বুঝতে পারছে না। সে তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললোঃ

-তুমি কি কিছু বললে?

-না, মানে আমি তোমাকে জিগ্যাসা করছিলাম তুমি কি হাওয়া সর্ম্পকে কিছু জানো কি-না?

-আমি কি তোমার মতো অত জ্ঞানী গুণী মানুষ যে জানবো? তোমার তো খেয়ে দেয়ে কাজ নেই সারাদিন বই পড়বে আর এটা ওটা লিখবে? আচ্ছা এইসব ছাই পাস দিয়ে কি হবে আমাদের? বলোতো? 

-তোমাকে জিগ্যাসা করাটা আমার উচিত হয়নি। তোমার মতো গন্ডমুর্খ হওয়ার চাইতে গাধা হওয়াও অনেক ভালো।

-তোমার সেটাই হওয়া উচিত। গাধা তো সারাদিনমান খেটে খুটে বেড়ায়। কাজ করে। তুমিতো কাজ কাম বাদ দিয়ে সারাদিন লেখালেখি নিয়ে থাকো। এই দিকে ছেলে-মেয়েদের লেখা-পড়া, ঘর-সংসার কোন দিকেই তোমার মন নেই। তুমি কখনো সংসারের কোন খোজ খবরই রাখো না। থাকো তোমার লেখা লেখি নিয়ে। চা আর মুড়ি দিয়ে গেলাম। খেয়ে আমাকে উদ্ধার করো। আমার তোমার মতো অত জেনে কাজ নেই।

করিম সাহেব ভুলেও ভাবতে পারেননি রহিমা তার খোদক্তি এভাবে করবে? তিনি বেশ অপ্রস্তুত এবং বিব্রত বোধ করলেন।
(চলবে)