পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

করিম সাহেবের চিন্তা-ভাবনা ও হাঁসমুরগীর ছানাপোনা-নবম পর্ব

(অষ্টম পর্বের পর হতে)

করিম সাহেবকে দেখে হরিপদদা কীর্তন কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করলেন। তিনি করিম সাহেবকে বললেনঃ

-নমস্কার দাদা....ভালো আছেন?

-নমস্কার। তুমি ভালো আছো? হরিপদ

-আছি গুরুর দয়ায় ভালোই। ...আপনি আসায় খুব ভালো লাগছে করিমদা.

-আমারো ভালো লাগছে......তাছাড়া তোমার সাথে অনেকদিন প্রাণভরে কোন কথা হয় না। আজকে যখন তোমাকে পেয়েছি, তাহলে প্রাণখুলে কথা বলা যাবে....কি বলো হরিপদ..

-দাদা, কি যে বলেন?.... আপনি একজন জ্ঞানীগুণী মানুষ....আর আমি একজন সাধারণ মানুষ.....আমার সাথে কি কথা বলবেন আর আমিই বা আপনার সাথে কি কথা কমু..

-আরে এটা কোন বিষয়ই না। তুমি বেশ তত্ত্বজ্ঞানী মানুষ। তোমাদের ধর্মে বেশ প্রাঞ্জল ভাষায় ধর্মতত্ত্ব বর্ণিত হয়েছে। আমি মাঝে মাঝে গীতা এবং উপনিষদও পড়ি। সেখানে পেয়েছি অনেক দামী দামী এবং অসাধারণ ভাষা...

-দাদা....প্রতিটি ধর্মই একই কথা বলে। মুল বিষয়টাতে কোন ধর্মেই বিভেদ নেই। বিভেদ কেবল মনে। যেমন ধরেন..ধর্ম। মুল শব্দ ধৃ হতে ধর্ম শব্দের উৎপত্তি। যার অর্থ যা ধারণ করে আছে। কি ধারণ করে আছে? বস্তুর গুণাবলী। যেমন ধরেন। আগুন। এর ধর্ম দাহন করা। পৃথিবীর যেই স্থানেই যান, অগ্নি দহন করবেই। ধর্ম মানুষকে সহনশীন হতে শেখায়। কোন ধর্মই বিভেদের বীজ বোপন করে না।

-তুমি ঠিকই বলেছো হরিপদ । ধারণদঃ ধর্ম। ধর্মঃ মুলহি ভগবান সর্বোবেদ ময়ঃ হরি। ধর্মের মুল হচ্ছে ভগবান হরি। হরি অর্থ যিনি হরণ করেন। কি হরণ করেন? হরণ করেন পাপবোধ। মনের মধ্যে যে পাপ তথা ভ্রান্তি লুকিয়ে আছে, তা দুর করাই হরণ করা। কে করেন? ভগবান। ভগবান=ভব+বান-ভব মানে হচ্ছে দুনিয়া। আর বান মানে হচ্ছে আসত্তি। অর্থাৎ দুনিয়ার প্রতি আসত্তিবোধ থেকে যিনি মুক্ত, তিনিই ভগবান। অর্থাৎ ভব সাগরকে যিনি পাড়ি দিতে পেরেছেন, তিনিই ভগবান।

-দাদা, আপনি কি ভগবানকে দর্শন করেছেন?

-নাহ্...। তার স্বরুপ উপস্থিতি ধরতে পারছি কিন্ত্তু তাকে পরিপুর্ণভাবে দেখা হয়নি।

-আপনার কথা শুনে হাসি পেল দাদা।

-কেন? কেন..

-দাদা, আপনিতো শিক্ষিত মানুষ। অনেক লেখা পড়া করেছেন। শুনেছি কোরআনে আছেঃ আল্লাহু কুল্লে শাইইন মুহিত। আল্লাহ সর্ব বস্তুর মধ্যে মুহিত অবস্থায় আছেন। তার মানে অাপনাদের আল্লাহ আমাদের ভগবান তথা হরি এই পদবাচ্য। আপনারা ডাকেন আল্লাহ বলে। আর আমরা ডাকি ভগবান হরি বলে। এই হরি আছেন প্রতিটি মানবের হৃদমন্দিরে। তাকে আত্মা বলেও অনেকে মনে করেন। মুলতঃ আত্মার মুল হচ্ছে পরমাত্মা। এই পরমাত্মা সারা দেহজুড়ে বিস্তৃত।

যে-কেউ হৃদয়ঙ্গম করতে পারে, সমগ্র দেহ জুড়ে কি বিস্তৃত হয়ে আছেসেটি হচ্ছে চেতনা প্রত্যেকেই তার দেহের সুখ বেদনা সম্বন্ধে সচেতন চেতনার এই বিস্তার প্রত্যেকের তার নিজের দেহেই সীমাবদ্ধ কিন্ত্তু একজনের দেহের অনুভূতি অন্য আর কেউ অনুভব করতে পারে না এর থেকে বোঝা যায়, এক-একটি দেহ হচ্ছে এক-একটি স্বতন্ত্র আত্মার মূর্তরূপ এবং স্বতন্ত্র চেতনার মাধ্যমে আত্মার উপস্থিতির লক্ষণ অনুভুত হয় এই আত্মার আয়তন কেশাগ্রের দশ সহস্ত্র ভাগের একভাগের সমান বলে বর্ণনা করা হয়েছে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে (/) প্রতিপন্ন করা হয়েছে-
বালাগ্রশতভাগস্য শতধা কল্পিতস্য চ।
ভাগো জীবঃ বিজ্ঞেয়ঃ চানন্ত্যায় কল্পতে।।
অর্থঃ “কেশাগ্রকে শতভাগে ভাগ করে তাকে আবার শতভাগে ভাগ করলে তার যে আয়তন হয়, আত্মার আয়তনও ততখানি। 

সেই রকম অনুরূপ একটি শ্লোকে বলা হয়েছে
কেশাগ্রশতভাগস্য শতাংশসদৃশাত্মকঃ।
জীবঃ সূক্ষ্মস্বরুপোহয়ং সংখ্যাতীতী হি চিৎকণঃ।।

অর্থঃ “অসংখ্য যে চিৎকণা রয়েছে, তার আয়তন কেশাগ্রের দশ সহস্র ভাগের এক ভাগের সমান।” 

সুতরাং এর থেকে আমরা বুঝতে পারি জীবাত্মা হচ্ছে এক-একটি চিৎকণা, যার আয়তন পরমাণুর থেকেও অনেক ছোট এবং এই জীবাত্মা বা চিৎকণা সংখ্যাতীত। এই অতি সুক্ষ্ম চিৎকণাগুলি জড় দেহের চেতনার মূল তত্ত্ব। কোন ওষুধের প্রভাব যেমন দেহের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে, এই চিৎ-স্ফুলিঙ্গের প্রভাবও তেমনই সারা দেহ জুড়ে বিস্তৃত থাকে। আত্মার এই প্রবাহ চেতনারূপে সমগ্র দেহে অনুভূত হয় এবং সেটিই হচ্ছে আত্মার উপস্থিতির প্রমাণ। সাধারণ মানুষও বুঝতে পারে, জড় দেহে যখন চেতনা থাকে না, তখন তা মৃত দেহে পরিণত হয় এবং কোন রকম জড় প্রচেষ্টার দ্বারাই আর সেই দেহে চেতনা ফিরিয়ে আনা যায় না। এর থেকে বোঝা যায়, চেতনার উদ্ভব জড় পদার্থের সংমিশ্রণের ফলে হয় না, তা হয় আত্মার থেকে। চেতনা হচ্ছে আত্মার স্বাভাবিক প্রকাশ। আত্মার পারমাণবিক পরিমাপ সম্বন্ধে মূণ্ডক উপনিষদে (//) বলা হয়েছে-
এষোহণুরাত্মা চেতসা বেদিতব্যো যস্মিন্প্রাণঃ পঞ্চধা সংবিবেশ।
প্রাণৈশ্চিত্তং সর্বমোতং প্রজানাং যস্মিন্বিশুদ্ধে বিভবত্যেষ আত্মা।।
 
অর্থঃ- “আত্মা পরমাণুসদৃশ এবং শুদ্ধ বুদ্ধিমত্তার দ্বারা তাকে অনুভব করা যায়। পরমাণুসদৃশ এই আত্মা পঞ্চবিধ বায়ুতে (প্রাণ, অপান, সমান, ব্যান উদান) ভাসমান থেকে হৃদয়ে অবস্থান করে এবং জীবাত্মার সমগ্র দেহে তার প্রভাব বিস্তার করে। আত্মা যখন এই পঞ্চবিধ জড় বায়ুর কলুষিত প্রভাব থেকে পবিত্র হয়, তখন তার অপ্রাকৃত গুণাবলীর প্রকাশ হয়।

(চলবে)