পৃষ্ঠাসমূহ

শুক্রবার, ১ জানুয়ারী, ২০১৬

শ্বেতার ডায়রী-সপ্তম পর্ব

(ষষ্ঠ পর্বের পর)
সাত্তার ভাই আমাকে নিয়ে ওসির রুমে গেলেন। রুমে ঢুকেই জোড় কদমে বেশ কায়দা করে স্যালুট দিলেন। তারপর আমাকে দেখিয়ে বললেনঃ

-স্যার, একে ধরেছি স্যার। ধারা ৫৪। সন্দেহজনক ঘোরাফেরা করছিল স্যার।

-হুম....কি কিছু পেয়েছেন?

-না স্যার। তেমন কিছুই পাইনি। কেবল এই ডায়রীটা পেয়েছি। 

-কোন জংগীর সাথে সম্পৃক্ততা কিংবা কোন তথ্য আছে কি?

-না স্যার। স্যার এই যে ডায়রী...

সাত্তার ডায়রীটা এগিয়ে দিল ওসির দিকে। আমি তাকিয়ে আছি ওসি সাহেবের দিকে। পাশের চার্ট টেবিলে লেখাঃ আব্দুল লতিফ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তার মানে ওসি সাহেবের নাম আব্দুল লতিফ। দেখি লতিফ সাহেব কি করে? আমি তাকিয়ে থাকলাম ওসি সাহেবের দিকে। তিনি ডায়রীটা নাড়া চাড়া করে দেখে বললেনঃ

-ফালতু একটা জিনিস কেন আনছো? এইসব ছেলে পেলেরা প্রেম ভালোবাসা করে দেশটার বারো বাজিয়ে দিল। আজ অমুকে বিষ খায় তো কাল আরেকটা ফাঁসিতে ঝোলে..যত্তসব....এ্যাই কি নাম তোর?

-সাজিদ হাসান।

-হুম। কোথায় থাকিস?

-স্যার মীরপুর এক নম্বরে। কলওয়ালাপাড়া মসজিদের সামনে।

-রাতে বের হয়েছিলি কেন?

-স্যার মাথা ধরেছিল। তাই ঔষধ কেনার জন্য বের হয়েছিলাম। আর সেই সময়...

-থাক্ আর বলতে হবে না। সেন্ট্রি....ওর বন্ড সই নিয়ে ছেড়ে দেন। যাতে আর কখনো অযথা যত্রতত্র ঘুরে না বেড়ায়...
 
আমি ওসি সাহেবের রুম হতে বের হতে পেরে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানালাম স্রষ্টার কাছে। স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থটা যেন বুঝতে পারলাম। যখন চলে যেতে চাইলাম তখন সাত্তার নামক পুলিশটি ডায়রীটা ফেরত দিল। আমি ডায়রীটা নিয়ে থানা হতে বের হয়ে এলাম।

শাহবাগের মোড়ে একদিকে যাদুঘর অন্যদিকে হাসপাতাল। আমি চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম আকাশটা ততক্ষণে পরিস্কার হতে শুরু করেছে। ফুলের দোকানদাররা তাদের ফুলগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে রাখছে। টং দোকানের মালিকরা তাদের দোকানের পশরা সাজাতে ব্যস্ত। কেউ চুলা জ্বালিয়ে পানি গরম করছে। চা বানানোর জন্য। আমি চা খাওয়ার জন্য একটি বেন্ঞ্চিতে বসলাম। বসা মাত্রই আমি লক্ষ্য করলাম যে, একটি পোষ্টারে লেখাঃ  "মাহবুবে খোদা ......মাহবুবে এলাহি...পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ) -এর শুভেচ্ছা "।
একটি বিষয় বেশ আমাকে বেশ ভাবিয়ে তুললো। আশেকে নবীগণ যাদের নবী প্রেমিক বলা হয়, তাদের নবীপ্রেম এবং পুর্ববর্তী যারা রসুলের জামানায় ছিলেন তাদের নবীপ্রেমে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। উদাহরণ স্বরুপ বলা যায়ঃ পনেরো শতকের ঘটনা। আল্লামা আবদুর রহমান জামী (রঃ) ছিলেন একজন মহান রসুল প্রেমিক। নবী প্রেমের কারণেই তিনি একজন কালোত্তীর্ণ মহাপুরুষে পরিণত হয়েছিলেন। একদা তিনি রসুল পাকের শানে না'ত তথা কাসিদা লিখে রঁওজায়ে আকদাসের জেয়ারতের উদ্দেশ্যে মদীনায় গমণ করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। তার একান্ত ইচ্ছে-রঁওজা পাকের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর বিখ্যাত না'ত-ই-রসুলটি পাঠ করা। যখন আল্লামা জামী (রঃ) নবী প্রেমে বিভোর হয়ে মদীনা পানে ছুটলেন, তখন মক্কার তৎকালীন গভর্ণরকে স্বপ্নে হুজুর পাক (সাঃ) এই বলে নির্দেশ প্রদান করেন যে, পারস্য হতে আগত যার নাম জামী (রঃ) তাকে যেন কোন মতেই মদীনায় যেতে দেয়া না হয়। স্বপ্নাদেশ পেয়ে মক্কার গভর্ণর তাকে পাকড়াও করে কারাগারে নিক্ষেপ করেন। এরপর গভর্ণর আবার হুজুরে পাক (সঃ)-কে স্বপ্নে দেখেন। স্বপ্নে রাসুলে পাক (সঃ) বললেনঃ
"আবদুর রহমান জামী (রঃ) কোন অপরাধী নয়। বরং সে কিছু কবিতা রচনা করেছে। এখানে এসে সে এগুলো আমার রওজার পাশে দাঁড়িয়ে আবৃত্তি করতে চায়। যদি  এমন হয়, তাহলে শরীয়তের আইন ভংগ করে রঁওজা হতে আমার হাত মাসাফাহার (Hand Shake) জন্য বের হয়ে আসবে। তা ঠিক হবে না। তাই তাকে বলো-এখানে এসে সে যেন এই কবিতাটি পাঠ না করে "। স্বপ্নের মাধ্যমে এ সুসংবাদ শুনে গভর্ণর কারাগার হতে তাঁকে মুক্ত করেন এবং তাঁর প্রতি বিরাট সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শন করেন। (কাসিদা-ই-নু'মান, পৃষ্ঠা ৩১২-১৩)। সে বিখ্যাত কাসিদাটি ছিলঃ

তানাম ফারসুদা জা পারা, জে হিজরা ইয়া রাসুল আল্লাহ
দিলাম পাজ মুর্দা আওয়ারা জে ইসইয়া, ইয়া রাসুল আল্লাহ।
------------------------------------------------------
চুন সু.ইয়ে মান গুজার আরি, মানে মিসকীন জানা দারি
ফিদা.ই.নাকস.ই.নালাইনাত, কুনাম জা, ইয়া রাসুল আল্লাহ।
------------------------------------------------------
জে খারদা খাইশ হাইরা নাম, সিয়া সুদ রোজ ইসইয়ানাম
পাসেমা নাম, পাসেমা নাম, পাসেমা নাম ইয়া রাসুল আল্লাহ।
------------------------------------------------------
জে জামে হু্ব্ব তু মাস্তাম, বা জানজিরি তু দিল বাস্তাম
না'মি গুইয়াম কি মান বাস্তাম, সুকুন দা ইয়া রাসুল আল্লাহ।
------------------------------------------------------
চুন বাজু.ই শাফা'য়াত রা, খুশাই.ল বার গুনাগারা
মাকুন মাহ.রুমে জামে রা, দারা আন, ইয়া রাসুল আল্লাহ।
------------------------------------------------------
উল্লেখ্য যে, সেই নবীপ্রেমিকও মাহবুবে খোদা শব্দটি ব্যবহার করতে সাহস দেখাননি। এমনকি হযরত ওয়ায়েস কারণী (রাঃ) ও ব্যবহার করেননি। এমনকি হযরত মুসা (আঃ) ও যিনি আল্লাহ পাকের সাথে সরাসরি তুর পর্বতে কথোপকথন করতেন, তিনিও ব্যবহার করেননি । কিন্ত্তু হাল জামানায় এমন সব বিখ্যাত বিখ্যাত খেতাব যুক্ত পীর ফকির দরবেশ দেখা যায়, যারা অধিকাংশই পান্ডিত্যবহুল কেতাবীজ্ঞানে জ্ঞানী। কিন্ত্তু আধ্যাত্মিকতা তাদের জন্য সুদুর পরাহত। যদিও এসব বিষয়ে মাথা না ঘামালেও চলতো কিন্ত্তু বাহুল্যের কারণেই হোক কিংবা অন্যকোন কারণেই হোক, যে বা যারা এই শব্দটি ব্যবহার করছে, তার পক্ষে অবশ্যই কোন না কোন কারণ আছে। কারণটা কি, সেটা সেই ভালো জানে।

দোকানী আমাকে চা দিল। শীতের এই আমেজে এককাপ গরম চা যে কি পরিমাণ আনন্দ দিতে পারে, তা কেবল প্রত্যক্ষদর্শীরাই বলতে পারবে। আমার সেই আনন্দ বিষাদে পরিণত হলো - শ্বেতার লেখাটি পড়ে।
(চলবে)