পৃষ্ঠাসমূহ

শুক্রবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১৬

করিম সাহেবের চিন্তা-ধারা ও হাঁস-মুরগীদের ছানাপোনা-পর্ব দুই

(প্রথম পর্বের পর হতে)

করিম সাহেব বেশ চিন্তিত মুখে মলিন বদনে বসে আছেন। তার মুখ-মন্ডলে চিন্তা-রেখা সুস্পষ্ট। তা দেখে রহিমা করিম সাহেবকে বললেনঃ

-কি ব্যাপার? তোমাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে? কি হয়েছে?

-নাহ্ । তেমন কিছু না। আর যা হয়েছে তা তুমি ব্যাখ্যা দিতে পারবে না।

রহিমা জানে তার স্বামী যখন কোন কিছু নিয়ে লেখা লেখি করে তখন তাকে চেনা যায় না। তিনি যেন অন্য কোন গ্রহের মানুষ হয়ে যান। কেমন যেন অচেনা মনে হয় লোকটাকে। অথচ তার স্বামী যখন তারই সাথে খাবার খায় এবং একই বিছানায় ঘুমায়, তখন তাকে চির চেনা লোকটির মতোই মনে হয়। কিন্ত্তু লেখার সময় তিনি লোকটির সাথে পুর্বের লোকটির কোন সায়ুজ্য খুঁজে পান না। তাছাড়া তাকে নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করলে বেশ রেগে যান। তাই রহিমা সবসময় দুরত্ব বজায় রেখে চলেন। রহিমা করিম সাহেবকে বললেনঃ

-তুমি কি চা খাবে? আদা দিয়ে লাল চা বানিয়ে আনি...খেলে বেশ ভালো লাগবে

করিম সাহেব তার কোন উত্তর না দিয়ে কেবল "হুম" বলে উঠোনের দিকে তাকিয়ে রইলেন হাঁস-মুরগীদের দিকে। দেখলেন, সবাই কেমন গোগ্রাসে খাবারগুলো খাচ্ছে। হাঁসগুলো তার চেপ্ট্যা ঠোঁটদুটো খাদার মধ্যে ডুবিয়ে কেমন যেন একটি খ্যাত খ্যাত শব্দ করে কুড়োগুলো খাচ্ছে। আর মুরগীটা একটা একটা করে খুদগুলো ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে। একবার মাথা উঠাচ্ছে আবার নামাচ্ছে। অনেকটা আমরা যেমন নামাযে দাঁড়াই, সেজদা দেয়ার পুর্বে যেমন রুকু হতে উঠে দাঁড়াই, ঠিক তেমন মনে হচ্ছে। একবার মাথা উপরের দিকে উঠাচ্ছে পরক্ষণেই আবার মাটিতে থাকা খুদের মধ্যে ঠোকর দিচ্ছে। তাকে অনুসরণ করছে মুরগীর ছানাগুলো। তারাও মায়ের মতো করেই খাদ্য খাচ্ছে। করিম সাহেব কি মনে করে যেন সেই দিকটায় অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

রহিমাও সেদিকটা দেখার চেষ্টা করলো। সেও দেখলো-তার স্বামী উঠোনে থাকা হাঁস-মুরগীদের খাবারের দৃশ্য উপভোগ করছে। কিন্ত্তু সে ঠিক কি চিন্তা করছে, সেটা রহিমা ধরতে পারলো না। সে বেশ অবাকই হলো। রহিমা জিগ্যেস করলোঃ

-কি, কিছু বলছো না যে? চা বানিয়ে আনবো?

-আরে আনো না...দেখছো না একটি বিষয় নিয়ে কাজ করছি..

-কি কাজ করছো?

-হাঁস মুরগীদের খাবার গ্রহণের দৃশ্যগুলো মনোযোগ সহকারে দেখছি।

-সেটা দেখার কি হলো? আমিতো রোজই দেখি..

-তুমি দ্যাখো কিন্ত্তু উপভোগ করো না...

-উপভোগ? সেটা আবার কি? 

-সেটা হলো দর্শন।

-দর্শন? 

-হ্যাঁ। দর্শন। 

করিম সাহেব একটি সিগারেট ধরিয়ে ফুঁস করে একরাশ ধোঁয়া বের করলেন। তারপর বললেনঃ

-দেখা এক জিনিস আর দর্শন আরেক জিনিস। স্বাভাবিক দৃষ্টি নিয়ে যে দেখা, সেটা হলো সাধারণ দর্শন তথা দেখা। সাদা মাটা। সেটা উপভোগ্য বিষয় নয়। কিন্ত্তু যখন সেই দৃষ্টির মধ্যে গভীর কোন তত্ত্ব খোঁজার চেষ্টা করা হয়, তখন সেখান হতে একটি উপভোগ্য বিষয় বের হয়ে আসে। সেটাই সেটার দর্শন। তথা মুল বিষয় বস্তু। তুমি দেখেছো সাধারণ দৃষ্টি নিয়ে। তাই তোমার কাছে বিষয়টি উপভোগ্য হয়নি। সেটা দর্শন নয়। কিন্ত্তু আমি সেই দৃষ্টি নিয়ে তাকাই নি। আমি সেই দৃশ্যের মধ্যে একটা উপভোগ্য বিষয় খুঁজতে চেষ্টা করেছি। তাই সেটা আমার কাছে বেশ উপভোগ্য মনে হয়েছে। সেটাই আমার দর্শন।

-খুলে বলো।

রহিমা বেশ আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলো। সে প্রতিদিনতো একই কাজ করে আসছে। সে হাঁস-মুরগীদের যত্ন আত্তি করছে। তাদের খাবার দিচ্ছে। আবার যথারীতি সাঁঝে হাঁস-মুরগীদের খোয়ারে তোলে দোর লাগিয়ে দেয়। দোরটির মুখে একটি ইট দিয়ে রাখে, যাতে সেটা সরিয়ে কোন শিয়াল কিংবা খাটাশ মুরগী কিংবা হাঁস ধরে নিয়ে যেতে না পারে। এত কিছু করার পরও সে দর্শন করতে পারলো না-বিষয়টা তার কাছে বেশ রহস্যময় মনে হলো। রহিমা তাকিয়ে আছে তার স্বামীর দিকে।

করিম সাহেব সিগারেটে দম নিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছাড়লেন। তারপর বেশ কায়দা করে তার দর্শনের বিষয়টি খুলে বলার চেষ্টা করছেন। শোন তাহলেঃ

- আল্লাহ পাক সমগ্র সৃষ্টিজগতের আধার। তিনি স্রষ্টা হয়ে খালিকরুপে সমগ্র সৃষ্টিজগতের ভার নিয়েছেন। তিনি সেই সৃষ্ট বিষয়ের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞ। তাই তাদের রিজিক তিনি দান করেছেন অকৃপণভাবে। জমিনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছেন। সেই রিযিক গ্রহণ করে দেহবীজ উৎপন্ন করে সৃষ্টিধারা অব্যাহত রেখেছেন মুরীদুন ছেফাতের মাধ্যমে। দেহবীজ তৈরীর মুল উপকরণ হচ্ছে খাদ্য। খাদ্য বিনে দেহবীজ উৎপন্নসম্ভবপর নয়। সেই খাদ্য যেটা জমিনের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, মুরগীটার দিকে লক্ষ্য করো - দ্যাখো তাকিয়ে। সে কিভাবে সেগুলো একটা একটা করে খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। আর বাচ্চাদের সেই খাবার গ্রহণের কৌশল শেখাচ্ছে। বাচ্চাগুলো মাকে অবলোকন করে অবলীলায় মায়ের ভংগীতেই খাবারগুলো খাচ্ছে। তার পাশেরই দ্যাখো মোরগটাও খাবার খাচ্ছে। সে খাবার গ্রহণের সময় তার ধারের কাছে কা্‌উকেই ভীড়তে দিচ্ছে না। সে জানে, তার জন্যই খাবারটা বেশি জরুরী। কেননা, তাকে প্রডাক্টিভিটি চালিয়ে রাখার জন্য খাদ্যটা বেশি জরুরী। আর মা মুরগীটা তার ছানাদের নিয়ে অন্যদিকটায় অবস্থান করে অবলীলায় খাদ্য খেয়ে যাচ্ছে। 

অপরদিকটায় দ্যাখো-হাঁসদের খাদ্যের ব্যাপারে আগ্রহের কমতি নেই। তারা গোগ্রাসে কারো দিকে না তাকিয়ে কে কতো বেশি খাবার খেতে পারে, সেরকম এক ধরণের প্রতিযোগীতার সৃষ্টি করে চলেছে। মনে হচ্ছে, অন্য দিকে দৃষ্টি দিলে হয়তো পাশেরটা তার থেকে বেশি খাবার খেয়ে ফেলতে পারে। কারো যেন কোন হুঁস নেই। পাতি হাঁসটি তার বাচ্চাদের দিকেও খেয়াল করছে না। বাচ্চাগুলো মরিয়া হয়ে খাবার গ্রহণের চেষ্টা করছে। সেও তার মা-বাবার মতোই একই কায়দায় খাবার খাচ্ছে। পার্থক্য হলোঃ মা মুরগীটা তার বাচ্চাদের প্রতি কর্তব্যপরায়ন এবং শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপারে বেশ আগ্রহশীল। আর মা হাসটি তার বাচ্চাদের ব্যাপারে গাফেল। সে সেদিকটায় মোটেও খেয়াল করছে না। না তার খানা খাদ্যে, না তার চলা-চলতিতে। ফলে তাদের যে খাদ্য ছিটকে পড়ছে তার দিকে তাদের খেয়ালই নেই। অথচ মুরগীটি প্রতিটি দানা একটা একটা করে খুটে খুটে খাচ্ছে। কি অদ্ভুদ! তাই, না?

রহিমা তার স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার মনেও সেই খেয়াল চাপলো। করিম সাহেব কি হাঁসদের মতোই গাফেল ? সে কি এই সংসারের দিকে এমন দৃষ্টি নিয়ে কখনো দেখেছে? কি করে এই সংসারটা চলে? কিভাবে ছেলে-মেয়েদের মানুষ করতে হয়? কিভাবে তাদের জন্য সেই ভোর হতে রাত অবধি গাধার খাটুনি খাটতে হয়? তার চিন্তা-ভাবনা করার মতো ফুরসৎ কই? কিভাবে সে করিম সাহেবের মতো দর্শন খুঁজে বেড়াবে? রহিমার চোখে জল চলে আসছে সংসারের অভাব অনটনের মধ্যে থেকে তার স্বামীর দর্শন চিন্তা দেখে। যে ব্যক্তি সামান্য পশু-পাখিদের মধ্যে দর্শন চিন্তা করতে পারে, সে নিশ্চয়ই বড়ো কোন কিছু অবশ্যই চিন্তা করতে পারে। রহিমা স্বামীকে খুশি করার জন্য বললোঃ

-সত্যিই তো? সেইভাবে তো কখনো দেখিনি। চিন্তাও করতে পারিনি। 

এ কথা বলে রহিমা রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। এখনো অনেক কাজ বাকী। ছেলে-মেয়েদের জন্য নাস্তা তৈরী করতে হবে। নিজেদের জন্যও খাবার তৈরী করতে হবে। তাকে তো কেউ হাঁস-মুরগীদের মতো খাবার তৈরী করে খেতে দেবে না। তার খাবার তার নিজেরই তৈরী করতে হবে।
(চলবে)