পৃষ্ঠাসমূহ

বৃহস্পতিবার, ২৮ জানুয়ারী, ২০১৬

করিম সাহেবের চিন্তা-ভাবনা ও হাঁস-মুরগীর ছানাপোনা-অষ্টম পর্ব

(সপ্তম পর্বের পর হতে)

করিম সাহেব ভেবে পেলেন না-সেটা সত্যি কি-না? একবার মনে হচ্ছে সত্যি আরেকবার মনে হচ্ছে মিথ্যা। সত্য-মিথ্যার দোলা চালে পথ চলতে লাগলেন তিনি । আর দু'পাশ দিয়ে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্য অবলোকন করছেন।

শীতের আমেজ তখনো পুরোপুরি কাটেনি। সদ্য প্রসুত শিশুর মতো সুর্যটা কেবল হাত-পা ছোঁড়াছুঁড়ি করছে। দুর থেকে যে সুর্যটা এতদীপ্তিময় মনে হচ্ছে সেই সুর্য্যের হাসিটা কেমন যেন ম্লান লাগছে করিম সাহেবের কাছে। নদীর পাশ দিয়ে বয়ে চলা মেঠো পথে হাঁটতে ভালোই লাগছে। মাঝে মাঝে শীতের ঝাপটা গায়ে লাগছে। আবার সুর্য্যের হাসি তা বিলীন করে দিচ্ছে। ভাগ্যকুল বাজারটা অতি প্রাচীন। পদ্মার পাশ দিয়ে বসা অন্যান্য হাট-বাজারের মতোই এ বাজারটা। পার্থক্য কেবল এ বাজারের অধিকাংশ ব্যবসায়ীরাই সনাতন ধর্মাবলম্বী। তাছাড়া এ বাজারটা ধরতে গেলে এ অন্ঞ্চলের অধিবাসীদের প্রাণ। তাদের দেহের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে এ বাজারটি। করিম সাহেব গায়ের চাদরটা জুতসইভাবে পেঁচিয়ে বাজারের ব্যাগটি নিয়ে হন হন করে হেঁটে যাচ্ছেন। তাকে দেখে লক্ষণদা বললেনঃ

-নমস্কার কর্তা...বাজারে যাইতাছেন না-কি?

-হ। তুমি কই যাইতাছো?

-অামি একটু বালাশুর যামু। ঐ হরিপদ দাদারে খবর দিতে...

-হরিপদ দাদারে হটাৎ দরকার পড়লো? কোন অনুষ্ঠান আছে নি?

-জ্বে দাদা। আমাগো লক্ষ্মীপুজা আছে। আর একটা কীর্তনের আসরও আছে।

-তা বেশ। যাও..দেহি সময় পাইলে আমিও যামুনে...

-তাইলে তো ভালোই অয়....

হাঁটতে হাঁটতে করিম সাহেব বাজারের কাছাকাছি চলে এলেন। আর তাকে শেষ বার নমস্কার জানিয়ে লক্ষণও একটা রিক্সা নিয়ে বালাশুরের দিকে চলে গেল। হরিপদ বেশ জ্ঞানী লোক। তত্ত্ববেশ বোঝেন। তাছাড়া তার গলা বেশ। কীর্তন তিনি ভালোই গান। আর করিম সাহেবও কীর্তন বেশ পছন্দ করেন। করিম সাহেব বেশ পুলকিত হলেন। মনের মধ্যে একটা কেমন যেন অজানা ভালোলাগার অনুভুতি কাজ করলো। তিনি আর দেরী করলেন না। তাড়াতাড়ি বাজার করে বাড়ীতে ফিরে এলেন।

বাড়িতে এসে তিনি হাত-মুখ ধোয়ার জন্য পুকুর পাড়ে গেলেন। পুকুর পাড়ের ধারে দেখলেন-হাসগুলো ছানাপোনা সহ পানিতে সাঁতার কাটছে। মাঝে মাঝে পুকুরের মধ্যে ডুব দিচ্ছে আবার ভেসে উঠছে। একটু দুরে দেখলেন-পুরুষ হাঁসটি ওপারে নোংরা কাদামাটি খ্যাত খ্যাত শব্দ করে ঘাটছে। তার পাশেই আরেকটি হাঁসের বাচ্চা সেটাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করছে। করিম সাহেব বেশ মজা পেলেন। দৃশ্যটি তিনি আনমনে অবলোকন করছেন। কোন দিকেই তার খেয়ালই নেই। তিনি যে একটি আর্টিকেল লিখতে বসছিলেন, তা বেমালুম ভুলে গেলেন। তার মন পড়ে রইলো ঐ হাঁসগুলোর দিকে।

রহিমা মাছ কেটে তা ধুতে গেলেন পুকুর পাড়ে। পুকুর পাড়ে যেয়ে সে দেখলো করিম সাহেব খালি গায়ে তেল মেখে বসে আছে। গোসল করার নাম গন্ধও নেই। কেমন যেন আনমনা হয়ে হাঁসগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। রহিমা জানে, এ লোকটি যেন কেমন। কোন দিকেই তার খেয়ালই নেই। কি ভাবছে কে জানে? 

-কি গো, কি ভাবতাছো?

-দ্যাখতাছি। হাঁসগুলির তামশা...

-এইডা দেহনের কি অইলো? আমিতো রোজই দেহি।

-তোমার দেহা আর আমার দেহার মইদ্যে বিস্তর ফারাক। দ্যাহো হাঁসগুলি সারাদিন ময়লা কেদ্যার মইধ্যে কেমুন ঘাডাঘাডি করতাছে। পানিতে ডুবাইতাছে। অথচ সন্ধ্যায় যহন খোয়ারে ঢোকে তখন ওগো গায়ে একটুও ময়লা লাইগ্যা থাকে না। তুমি যদি ময়লাতেও থাকো আর মাওলা পাকের নাম লইয়্যা সাঁতার কাটো এই ভবনদীর পাড়ে তাইলে এই হাঁসের মতোই তোমার জীবন হইবো। মানে হইলোঃ তুমি হইবা হাঁস।

-হাঁস ???

করিম সাহেব কথা বাড়ালেন না। তিনি তাড়াতাড়ি গোসল করে ওঠে এলেন। তারপর দুপুরের খাবার খেয়ে বিকেলের দিকে রওনা হলেন লক্ষণদার বাড়ীতে। লক্ষণদের বাড়ী কামারগাঁও। এখন রওনা হলে  সন্ধ্যা নাগাদ পৌছে যাবেন। সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে এসেছে। সন্ধ্যা বাতি জ্বালিয়ে হরিপদদা ধুপ ধুপনা জ্বালিয়ে বাড়ীর বারান্দায় একটা মাদুর পেতে বসে কীর্তন গেয়ে চলেছেন।

যার মুখে ভাই হরি কথা নাই তার কাছে তুমি যেও
যারে দেখে তুমি ভুলে যাবে হরি তার পানে তুমি চেও না।।

করিম সাহেব কিছু না বলে সেই অনুষ্ঠানে বসে পড়লেন। তিনিও হাত জোড় করে চোখ বুঁজে মাথা দোলাতে লাগলেন। সনাতন ধর্মালম্বীগণের ন্যায়। দেখলে বোঝার উপায় নেই..তিনি সেই করিম সাহেব যিনি ভাগ্যকুল কলেজের দর্শনের প্রাক্তন শিক্ষক। বয়সের ভারে ন্যুজ্জ করিম সাহেব বেশ উপভোগ করছেন সেই কীর্তন।
(চলবে)