(পুর্ব প্রকাশের পর)
আমাকে উঠতে দেখে দোকানী বলে উঠলোঃ
-মামা কি কট খাইছেন?
-মানেটা কি? কট খাইছেন?
-মামা আপনি ধরা খাইছিলেন না-কি? হেইডা জিগাইলাম?
-হুম।
-দেইক্ক্যাই বুইঝ্যালাইছি...
-কি ভাবে?
-আপনের চোখ দুডা লাল টকটকা হইয়্যা রইছে। মনে অয় হারা রাইত বহাইয়্যা রাকছিল..
-তুমি তো দেখছি সবই বলে দিতে পারো...
-মামা অনেক দিন ধইর্যা চা বেচি। আপনেগো মতো মামারা মামীরা এইহানে চা খাইতে আহে। হেগো অনেক কতাও হুনি..
দোকানীর আলাপে কেমন যেন আনন্দ পেলাম। মনের গহীনে যে ব্যাথাটা টন টন করছিল তা যেন কিছুটা হলেও সান্তনার বাণী খুঁজে পেল। কে কি ধরণের আলাপচারিতা করে দোকানী তা আমাকে অকপটে বলে যাচ্ছিল। ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের বন্ধু-বান্ধবীদের নিয়ে অনেক সময় এসমস্ত টং দোকানীতে বসে আলাপচারিতা করে। তাদের আলাপের অনেক কথাই তারা না শোনার ভান করে শুনে ফেলে...তাছাড়া রিক্সাওয়ালা কিংবা সিএনজি চালক কিংবা প্রাইভেট কারের ড্রাইভারই হোক তারাও যে তাদের প্রাইভেট কথা শুনছে না..তারই বা কি গ্যারান্টি আছে? তাইতো সন্দেহের তালিকায় পুলিশ প্রথমেই জিগ্যাসা করে টং দোকানদারদের। কারা কারা আড্ডা মারে...কিংবা কোন দুঘর্টনায় প্রাইভেট কারের চালকদের এবং বাসার পরিচারিকাদের। দোকানীর কাছ থেকে অনেক কিছুই জানা হলো। এবার উঠতে হবে। আমি মানিব্যাগ বের করে দোকানীকে টাকা দিতে গিয়ে দেখলাম-সেখানে ভাঁজ করা শ্বেতার লেখা একটা চিঠি। চিঠিটা ডায়রীর সাথেই ছিল। আমার মনে পড়লোঃ গতদিন দুপুরে কুরিয়ার সার্ভিসে আমার কাছে একটা গিফট নিয়ে একজন সার্ভিসের লোক এসেছিল। আমার হাতে একটি গিফট বক্স দিয়ে দস্তখত নিয়ে গিয়েছিল। আমি গিফট বক্সটি খুলে দেখি সেখানে একটি ডায়রী এবং একটি চিঠি। চিঠিতে লেখা ছিলঃ
প্রিয় সাজিদ,
যখন তোমার ঘুম ভাংগবে, যখন তোমার হাতে আমার ডায়রীটা থাকবে, তখন আমি থাকবো তোমার থেকে অনেক অনেক দুরে। আমি চলে যাচ্ছি আব্বুর সাথে ইংল্যান্ডে। সেখানে আমি আমার খালামণির সাথে থাকবো। সেখানেই স্থানীয় একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে আমার ভর্তি কনফার্ম হয়ে আছে। তোমার সাথে আর এ জীবনে দেখা হবে কি-না জানি না। তবে জেনে নিও শিরিন সিকদারের বয়েতের উদ্ধৃতি দিয়েই বলছিঃ
মৃন্ময়ী মাটির মত্ত শিরীন শারেঙ্গী.
উতলা ভূতলা বুকে তার উন্মাদ ঝংকার:
হায় পথ আছে আমার পাথেয় কই!
আমার পাথেয়তো তুমিই ছিলে। কিন্ত্তু জীবনের বাস্তবতায় আজ আমি আমার পাথেয় হারিয়ে ফেলছি। তবে জেনে নিও
ভালোবাসতে বাসতে
আমি ভালোবাসা ছাড়া আর সব ভুলে গেছি,
মৃত্যু যন্ত্রনায় জ্বলতে জ্বলতে
আমি বাঁচতেই ভুলে গেছি।
ফিরে যদি দেখো শিরীনের শবদেহ, অনিমেষ চোখ -
বুঝে নিও,
প্রতীক্ষায় থাকতে থাকতে
আমি চোখ বুঝতেই ভুলে গেছি।
ইতি
তোমারই
শ্বেতা।
সেই চিঠিটা পড়ে আমার বেশ কষ্ট হচ্ছিল। আমি শ্বেতাকে কখনো বলিনি যে - শ্বেতা, তোমাকে আমি খুঁজতে যখন তোমাদের বাড়ীতে যাই, তখন তোমার আম্মু আমাকে দেখে বলেছিল-এই ভিখিরীর ছেলে কি করে শ্বেতার ক্লাসমেট হয়? যত্তসব...সেই কষ্টের কথা তোমাকে কোনদিনও বুঝতে দেইনি। বুকের যন্ত্রণা চেপে কেবল তোমার স্মৃতিতে যেন চির জাগরুখ থাকি, সেই চেষ্টাটাই করেছি। আজ তোমার চিঠি পড়ে মনে হচ্ছে আমার পাগলামিটা স্বার্থক হয়েছে। সেই পাগলটাই আজ তোমার অজান্তেই মির্জা গালিবের একটি শায়ের তোমার উদ্দেশ্যেই বলছেঃ
থা জিন্দেগী মে মর্গকা খটকা লাগা হুয়া
উড়নেছে পেশতর ভি মেরা রং জর্দ থা।।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। মিরপুরের বাস চলাচল করছে। বাসে চেপে আমাকে ফিরতে হবে আমার সেই চিরচেনা মেসে। তেল চিটচিটে বালিশ আর তালি দেয়া খ্যাতা যার সম্বল, তার ধনীর দুলারীদের সাথে প্রেম করতে নেই। কেবল স্বপ্ন দেখাই সার। মনে মনে আবৃত্তি করলাম আরেকটি শায়ের
কিতনা খফ হোতা হ্যায় শামকে অন্ধোরো মে,
পুছ উন পরিন্দো সে জিন কে ঘর নেহি হোতা।।
আকাশের পানে তাকিয়ে দেখলাম সুর্যটা হাসছে। গোটা চারেক কাক ডাকাডাকি করছে। আর আমি ধীর পায়ে চলেছি আমার গন্তব্যে।