পৃষ্ঠাসমূহ

বৃহস্পতিবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১৬

করিম সাহেবের চিন্তা-ধারা ও হাঁস-মুরগীর ছানাপোনা - পর্ব এক



শীতের কুয়াশা ভেদ করে যখন সোনালী সুর্যটা হেসে উঠলো ঠিক তক্ষুণী পুর্বাকাশের একচিলতে সোনালী রোদ্দুর সারা উঠোনময় সোনালী আলোয় উদ্ভাষিত হয়ে হেসে উঠলো। সারারাত ধরে যে কুয়াশার বিস্তৃত ছিল পাতায় পাতায় প্রকৃতির ছত্রচ্ছায়ায়, তা যেন মুহুর্তের মধ্যেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে কেবল সোনালী সুর্যের সংস্পর্শে। 

এমনি এক সকালে রহিমা ফজরের নামায আদায় করে খোয়ারে থাকা হাঁস-মুরগীগুলোকে উন্মুক্ত করে দিল খোয়ারের দ্বার খুলে। মুহুর্তের মধ্যেই সবকিছুই পাল্টে গেল। হাঁসগুলো প্যাক প্যাক করতে করতে হেলে দুলে খোয়ার হতে বের হয়ে এল। আর মুরগীগুলো ডানা ঝাঁপটে তার বাচ্চাগুলো নিয়ে খেলা করতে লাগলো। 

বড়ো মুরগীটা কিছুদিন পুর্বে ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফুটিয়েছে। ওমের গন্ধ তখনো মা মুরগীটার গা হতে যায়নি। মা মুরগীটা তার ছানাদের নিয়ে রাজকীয় ভংগীতে সারা উঠোনে দাপিয়ে বেড়াতে লাগলো।

রহিমা একটা খাদাতে হাঁসদের জন্য কুঁড়োগুলিয়ে নিয়ে আসলো আর মুরগীদের জন্য নিয়ে আসলো খুদ-কুড়ো। সেই খুদ কুড়ো নিয়ে রহিমা যখন আয় আয় তি তি তি…..আয় আয় বলে ডাকছিলো তখন হাঁস-মুরগীর ছানা পোনা সহ সারা উঠানে হাঁস-মুরগীতে ছেয়ে গেল। রহিমা অত্যন্ত আগ্রহ চিত্তে তাদের আদার (খাদ্য)দিচ্ছিল। খানা পেয়ে হাঁসের দল প্যাক প্যাক করতে হেলে দুলে ছুটে আসছিল। আর মুরগীর দল কক কক রবে ডেকে উঠলো। দুর থেকে করিম সাহেব তা লক্ষ্য করছিলেন। 

তিনি একটি বিষয় নিয়ে লেখা লেখি করছেন। কিন্ত্তু লেখাটিতে পুরো পুরি মনোযোগ দিতে পারছিলেন না। দু’চার লাইন লিখে আবার গভীর ভাবনায় পতিত হন। যেই আবার লিখতে যান, তক্ষুণি আগের লেখাটি কেটে দেন। আবার লিখেন। কিন্ত্তু তিনি লেখাটি সমাপ্ত করতে পারছেন না কোন মতেই। তার ভাবনার বিষয় হচ্ছে – ইনসানুল কামিল। তিনি ইবনুল আরাবীর  একটি বই পেয়েছেন। সেই বইটিতে লেখাঃ

"সুফী সাধনায় তিনি এত উন্নত হন যে তাঁর ভক্তরা তাঁকে “শায়খুল আকবার” বা শ্রেষ্ঠ শায়েখ উপাধিতে ভুষিত করেন। তাঁর গ্রন্থাবলীর মধ্যে “আল ফতুহাতুল মক্কীয়া” বা মক্কার প্রত্যাদেশ সর্বশ্রেষ্ঠ। এই গ্রন্থখানি বর্তমানে চারটি সুবৃহৎ খন্ডে ও পাঁচশত ষাটটি অধ্যায়ে বিভক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়। তাঁর মতে, এই গ্রন্থের প্রতিটি শব্দ তিনি অলৌকিকভাবে প্রত্যাদিষ্ট হন এবং তার মধ্যে ঐশীবাণী ছাড়া অন্য কিছুই নাই। “ফতুহাত” রচনা সম্পর্কে তিনি বলেন যে, তিনি যদি ফতুহাত রচনা না করতেন, তাহলে তিনি ঐশী অগ্নিতে ভষ্মীভুত হতেন।"

তিনি আরো বলেন যে, "মক্কায় অবস্থানকালে তিনি হযরত মুহাম্মদ (দঃ)-কে ফেরেস্তাগণ, নবীগণ ও আউলিয়াসহ আলমে মাসুরে তখতে উপবিষ্ট দেখেন এবং তাঁর দ্বারা ঐশী রহস্য উদঘাটনের আদেশ প্রাপ্ত হন। এক সময়ে কাবা ঘর প্রদক্ষিণের সময় এক সুন্দর স্বাস্থ্যবান ও লাবন্যপুর্ণ যুবককে তাঁর সাথে কাবা প্রদক্ষিণ করতে দেখেন এবং এই যুবকই তাঁকে দৃশ্যাতীত রহস্যময় চির অনন্ত পরম সত্তা আল্লাহর আরশ দেখান এবং এই দৃশ্য অবলোকন করে তিনি মুর্ছা যান। মুর্ছা ভংগের পর ঐশী রহস্য গ্রন্থাকারে প্রকাশের আদেশ তিনি লাভ করেন।"

লেখাটি পড়ে তিনি বেশ চিন্তা-ভাবনা শুরু করে দিলেন। কারণ হিসেবে বের করলেনঃ

১. তিনি রসুল পাক (সাঃ)- কে ফেরেস্তাগণ, নবীগণ ও আউলিয়াসহ আলমে মাসুরে তখতে উপবিষ্ট দেখেন।
২. একটি সুদর্শন যুবক তাকে দৃশ্যাতীত রহস্যময় চির অনন্ত পরম সত্তা আল্লাহর আরশ দেখান।
৩. এবং মুর্ছা ভংগের পর তিনি ঐশী আদেশ লাভ করেন।

তিনি শুনেছেন এবং জেনেছেন যে, কুল্লি নাফছিন জায়কাতুল মউত। প্রত্যেকটি নফস মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। সেই সুত্র ধরে আবদুল্লাহ পুত্র মুহাম্মদ (সাঃ) ও মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করেছেন এবং তৎপুর্ব সমস্ত নবী-অলীগণ সকলেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন এবং এই নশ্বর ধরণী ত্যাগ করেছেন। তাহলে কিভাবে সম্ভব রসুল পাক (সাঃ)- কে ঘিরে ফেরেস্তাগণ, নবীগণ ও আউলিয়াসহ আলমে মাসুরে তখতে উপবিষ্ট হওয়া? তাছাড়া তাঁরা যদি এই নশ্বর ভুমি ত্যাগ করেন, তাহলে এই ধরাতেই কেন তাঁদের দেখতে পাওয়া যায়? আর কেনই বা তাঁরা এই নশ্বর ভুবনে ফিরে এসে দেখা দেন? ঐ পরপারের যে স্থানে তাঁদের থাকার কথা – সেখানে যদি তাঁরা থাকেন তাহলে যার সাথে দেখা দেন, তিনি যদি সেরুপ উপযুক্ত না হন, তাহলে তাঁদের সাথে দেখা হবার তো সম্ভাবনাই থাকে না। আর তিনি যদি উপযুক্ত হনই, তাহলে তিনিতো সেখানেই দেখা দিলেই পারতেন? কেন তাঁরা এই ধরাতেই দেখা দেন? তবে কি তাঁরা মরেননি? তারা কি অমর? নাহ…নাহ…তা কিভাবে সম্ভব?

করিম সাহবের ভ্রু কুঁচকে গেল। ভ্রু কুঁচকে তিনি বেশ বিরক্তভাব নিয়েই উঠানের দিকে তাকাতেই দেখলেন-রহিমা তি তি করে হাঁস মুরগীদের ডাকছে। তারা সেই ডাক শুনে দ্রুত ছুটে আসছে। একে অন্যের সাথে খাবার নিয়ে প্রতিযোগীতা শুরু করে দিয়েছে।

মাথা ক্ষাণিকক্ষণ চুলকে তিনি আবার লেখা শুরু করলেনঃ

আচ্ছা সুরা বাকারা আয়াত-১৫৪ তে বলা হয়েছেঃ “ওয়াতাকুলু মাইইয়াখতালু ফি সাবিলিল্লাহি আমওয়াত বাল আহহিয়া ওয়ালা কিলল্লাহ তাশউরুন” ওয়া(এবং) তাকুলু(কতল-কতল হওয়া) মাইইয়াখতালু ফি সাবিলিল্লাহি (আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়েছেন) বাল(বরং) আহহিয়া(হাইয়ুন-জীবিত) ওয়ালা কিলল্লাহ তাশউরুন(তাশুর – বুঝতে পারা)। যারা আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়েছেন তাঁদেরকে মৃত বলো না বরং তারা জীবিত। তোমরা তা বুঝতেই পারবে না। 
এছাড়া সুরা আলে-ইমরানের ১৬৯ নং আয়াতে বলা হয়েছেঃ ওয়ালা তাহসাবান্নাল্লাযীনা কুতিলু ফি সাবিলিল্লাহি আমওয়াতা বাল আহইয়াউন ইন্দা রাব্বিহিম ইউরযাকুন।” অর্থঃ যাঁরা আল্লাহর রাস্তায় কতল হয়েছে তাঁদেরকে মৃত মনে করো না। বরং তাঁরা জীবিত নিজের রবের নৈকট্যপ্রাপ্ত, নিজের রবের পক্ষ হতে রিজিকও প্রাপ্ত।

এখানে দেখা যাচ্ছে যে, যারা আল্লাহর রাস্তায় কতল হয়েছেন-তাদেরকে মৃত বলতে নিষেধ করেছেন স্বয়ং আল্লাহ পাক। তাহলে শহীদরা অমর-এ কথাতো কোরআনেরই। যদি তাই হয় তাহলে যারা শহীদ হন, তাদের দেহ গোসল করিয়ে কাফনের কাপড় পড়িয়ে জানাজা দেয়া হয় কেন? জীবিত ব্যক্তির জন্যতো কোন জানাজার নামাজ জায়েজ নয়। তথা প্রযোজ্য নয়। তাহলে এই আনুষ্ঠানিকতা কেন? জীবিত ব্যক্তিকে কেউ কি কবর দেয়? কবরতো দেয় মৃত ব্যক্তিদের।

দ্বিতীয় আয়াতে দেখা যাচ্ছে আরো ভয়াবহ অবস্থা আর তাহলোঃ 
তাঁরা রবের নিকট হতে রিজিক প্রাপ্ত। রিযিক কি? রিযিক বলতে আমরা যা আহার করি তাই। সেটা যদি রিযিক হয়, তাহলে মৃত ব্যক্তি কিভাবে রিযিক গ্রহণ করে? বাল আহইয়াউন ইন্দা রাব্বিহিম ইউরয়াকুন। বাল(বরং) আহইয়াউন(হাইয়ুন-হায়াত-জীবিত) ইন্দা রাব্বিহিম (রবের নিকট হতে প্রাপ্ত) ইউরযাকুন (রিযিক)।

এছাড়া অন্য একটি প্রশ্ন এসে যায় আর তাহলোঃ শহীদের মর্যাদা বড়ো না নবী-অলীদের মর্যাদা বড়ো? যদি শহীদের মর্যাদা বড়ো হয় তাহলে ভাষা আন্দোলনে যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছেন বা ভাষা সৈনিক শহীদ হয়েছেন, তাদের কেহ দেখেছেন বলে তো শুনিনি? তাছাড়া তারা তো কারোর উপর আদেশও করেননি। যত কাহিনী শুনি তার সিংহভাগই অলী-আউলিয়াদের শানেই। কি বলার আছে আর কি লিখবো? যদি মর্যাদার প্রশ্ন ধরি, তাহলে বলা হয়ঃ “বিদ্বানের কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও পবিত্র”। তাহলে কোরআন মতে বিদ্বানও শহীদের মর্যাদা পান না তথা জীবিত থাকার কোন প্রশ্নই উঠছে না। প্রশ্ন উঠছে - যারা শহীদ হয়েছে তাদেরকে মৃত বলা নিষেধ। কেবল তারাই জীবিত। আর বাকী যারা মারা যাবে তারা সবাই মৃত। বিষয়টি কেমন যেন চিন্তায় ফেলে দিল করিম সাহেবকে। কি কোন কুল কিনারা করতে পারছেন না।
(চলবে)