পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ৩ মে, ২০১৫

মাটির পুতলা-প্রথম পর্ব

সামনে পহেলা বৈশাখ। বৈশাখ উপলক্ষে পূর্বমশাং বটতলা হাটে একটা মেলা বসে। সেই মেলায় দুর দুরান্ত হতে অনেকে ফেরি নিয়ে আসে। বসে চরকা,চটপটি আর ফুসকার দোকান। বসে হরেক রকমের খাদ্য সামগ্রীর ভাসমান দোকান। অধিকাংশই আসে ভ্যানগাড়িতে বসা দোকান-পাট।হাটে অনেকেই পুতুল কিনতে আসে। তাই পাল পাড়াতে পুতুল বানাতে ব্যস্ত মৃৎশিল্পীরা। সবাই খুবই আগ্রহ নিয়ে কাজ করছে। তাদের চোখে মুখে মৃদু হাসির রেশ। গলদ ঘর্ম হয়ে সবাই কাজ করে যাচ্ছে। এরই ফাঁকে সামিউল আর তাসরীফ আসে সেই পাল পাড়াতে। তাদের দেখে রমেশপাল এগিয়ে আসে। ভাবছে কাষ্টমার আসছে বুঝি অগ্রিম অর্ডার দেয়ার জন্য। হাসি মাখা মুখ নিয়ে তাই এগিয়ে যায় রমেশ পাল। যেয়েই তাদের দেখে বলে-নমস্কার দাদা।
-নমস্কার। সামিউল জবাব দেয়।
-দাদা মেলাতো দেরী আছে। এখনো অনেকেরই অর্ডার শেষ করতে পারি নাই। এরমধ্যে নতুন মালের অর্ডার নিতে পারুম না।
-না না আমরা কোন মালের অর্ডার দিতে আসি নাই।
কথাটা শুনে রমেশপাল কেমন যেন দমে যায়। ঝিমিয়ে পরা বলদের মতো সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে জিগ্যেস করে
-তাইলে কি জন্যে আসছেন,দাদা?
-আমরা আসছি আপনাদের পুতুল বানানো দেখতে। কিভাবে আপনারা পুতুল তৈরী করেন?
-এইডা কোন কথা? পুতুল কেমনে বানায় এইডা দেহনের কি অইলো?
-সেটা আপনি বুঝবেন না। আপনি আমাদের পুতুল বানানো দেখান।
-চলেন। আপনাদের দেখাই।
এই বলে রমেশপাল তাদের নিয়ে যেখানটায় মাটির স্তুপ করা আছে সেইখানটায় নিয়ে গেল। সেখানে দেখা গেল একগাদা এটেল মাটির রাশ পরে আছে। কেউ একজন সেই মাটিটাকে পানি দিয়ে আটা গোলানোর মতো করে মেখে রাখছে। আরেক জন সেই মাটিটা নিয়ে ইচ্ছে মতো দলা-মোচড়া করছে। তার পর সেটা নিয়ে একটা ছাঁচের মধ্যে ঢেলে দিচ্ছে। ছাঁচে ফেলা সেই মাটির অংশটুকু আরেকটি ছুড়ি দিয়ে কেটে নিচ্ছে। এরপর সেই ছাঁচটাকে হাল্কা একটা বারি দিয়ে বের করে নিচ্ছে সেই পুতুলের কাঁচা অংশটুকু। সারি সারি পুতুল এভাবে বানাচ্ছে। কাঁচা পুতুলগুলো আরেকজন নিয়ে সেগুলোকে আগুনে পোড়াচ্ছে। এরপর সেই আগুন থেকে বের করে আরেকটি স্থানে রাখছে। স্তুপীকৃত পোড়া পুতুলগুলো নিয়ে আরেকজন সেগুলো পরিস্কার করছে। পুতুলগুলো তখনো রং করা হয়নি। সারি সারি পুতুল রাখা আসে সেইখানে। পুর্বে কাঁচা পুতুলগুলো রোদে শুকানো হতো। এখন সেটা করতে হয় না। কারণ প্রযুক্তির উৎকর্যতায় তারা সেই কাজটা করে গ্যাসের চুলায়। কোন কোন ক্ষেত্রে কাঠ কয়লায়।
সামিউল আর তাসরীফ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুতুল বানানো দেখছে।
তাদের চোখে মুখে নতুন কিছু আবিস্কার করার একটা আইডিয়া উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে। তারা দুজনেই বেশ প্রফুল্ল। রমেশপাল তা দেখে ক্ষানিকটা বিরক্তবোধ করছে। এখনও অনেক কাজ পড়ে আছে। আর এর মধ্যে এই দুইজন তার কাজে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললো
-দাদা যেইটা দেখতাছেন সেইটা হইলো সামনের পাট। পেছনের পাটটাও ঐভাবে বানান হয়। তারপর ঐ দুই পাট একসাথে কইর‌্যা জোড়া দেওন লাগে। চলেন কেমনে জোড়া দেয় সেইটা আপনেগো দেখাই।
সামিউল আর তাফরীফ তাকে অনুসরণ করে পেছন পেছন গেল। সেখানে গিয়ে দেখলো তিন-চারজন একসাথে কাজ করছে। একস্থানে রাখা সামনের অংশ আরেক স্থানে রাখা পেছনের অংশ। দুইটি অংশ একত্র করে সেটাতে মাটি দিয়ে এমনভাবে জোড়া দিচ্ছে বোঝার উপায়ই নেই যে দুটো আলাদা।
সামিউল জিগ্যেস করলো-আপনারা কি এই ছাঁচ ছাড়া অন্য কোন উপায়ে পুতুল বানান?
-দাদা আমরা আগে হাত দিয়া টিপপ্যা মাটির পুতলা বানাইতাম। এতে সময় অনেক বেশি লাগতো। এখনতো ছাঁচ কিনতে পাওয়া যায়। আমরা সেই ছাঁচগুলি কিন্ন্যা আনি।
-হুম। আচ্ছা জোড়া দেওয়া পুতুলগুলো কি পরে রং করেন?
-ঐ দেখেন দাদা। ঐ যে জোড়া দেওয়া ঐ পুতলাগুলারে রং কইর‌্যা ডিজাইন করতাছে।
রমেশ পাল হাত দিয়ে ইশারা করে দেখায়। সেই ইশারার দিকে সামিউল আর তাসরীফ দুজনেই তাকায়। দেখে সেখানে একজন বসে বসে আপন মনে রং করে যাচ্ছে।
সামিউল একটা পুতুল হাতে নেয়। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সেই পুতুলটার দিকে। একটা নারী পুতুল। চোখের দিকটায় বেশ মায়াবি লাগছে। হলুদ পেরে শাড়ি পরানো। মাঝে সবুজ দাগ। বুকের কাজটাও বেশ পরিপাটি করা।  তার অবাক করা দৃষ্টির প্রখরতা নতুন কিছু চিন্তা করতে সাহায্য করছে। কিন্ত্তু কি চিন্তা করছে সামিউল? তাসরীফ সামিউলের সেই অবাক করা দৃষ্টি দেখে ভাবতে থাকে। তাসরীফ জিগ্যেস করে
-কিরে কি চিন্তা করছিস?
সম্বিৎ ফিরে পেয়ে সামিউল বললো
-কিছু না। চল যেতে যেতে বলি। তারপর তারা দুজন রমেশপালকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নেয়। পথে যেতে যেতে তাসরীফ জানতে চায় সেই রহস্যময় দৃষ্টির কারণটা।
(চলবে)