পৃষ্ঠাসমূহ

শুক্রবার, ৮ মে, ২০১৫

ভবা পাগলার ঈশ্বর

পুরো গ্রামের লোকজন ভবা পাগলার বিরুদ্ধে শ্লোগান দিচ্ছে- মুরতাদ ভবার ফাঁসি চাই। দিতে হবে। দিতে হবে। সারা বাংলায় মুরতাদ ভবার ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই। পুরো গ্রামের ধর্মানুসারীরা নির্বিশেষে ক্ষেপে গিয়েছে। কি হিন্দু, কি মুসলমান। কি বৌদ্ধ, কি খ্রীষ্টান। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবারই একটাই দাবী - অবিলম্বে ভবাকে গ্রেফতার করে ফাঁসি দিতে হবে। নতুন করে এই উৎপাত সৃষ্টি হওয়ায় গ্রামে শান্তি শৃংখলা বজায় রাখার স্বার্থে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ১৪৪ ধারা জারী করতে হয়েছে।

সারা গ্রামের মানুষের মধ্যে একটাই কথা। পুলিশ যদি ২৪ ঘন্টার মধ্যে ভবাকে গ্রেফতার না করে, তাহলে তারে যেখানে পাবে সেখানেই তাকে হত্যা করা হবে। গ্রামের লোকজন সবাই লাঠি সোঁটা নিয়ে পাহাড়া দিচ্ছে। অবস্থা বেগতিক দেখে গ্রামে অতিরিক্ত দাঙ্গা পুলিশ মোতায়ন করা হয়েছে। ভবাকে গ্রেফতার করে থানায় আনা হয়েছে। ম্যাজিট্রেড রশিদ তালুকদার, পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা সোবহান সাহেব গ্রামের গণ্যমান্য সমস্ত ব্যক্তি বর্গকে থানায় আসার জন্য অনুরোধ করেছেন।

সবাই থানায় উপস্থিত হয়েছেন। সেখানে একটি বিচারিক আদালত গঠন করা হয়েছে। ম্যজিট্রেড রশিদ সাহেব আদেশ দিলেন ভবার বিরুদ্ধে আপনাদের সুনির্দিষ্ট কি কি অভিযোগ রয়েছে  তা দাখিল করুন। ম্যাজিট্রেডের আদেশ পেয়ে মসজিদের ইমাম সাহেব মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস তসতরী বললেনঃ

- হুজুর। ভবা মসজিদের মধ্যে ইমাম যেস্থানে দাঁড়ায় সেইখানে একটা মুর্তির গায়ে পান্ঞ্চাবী পড়াইয়্যা ইমাম বানাইছে আর  ট্যাকা দিয়া লেইপ্প্যা খাড়া কইর‌্যা সমস্ত মুসল্লিগো কইছে - অই মিয়ারা, তোমরা এহন থিক্কা এই  ইমামের পিছনে দাঁড়াইয়্যা নমাজ পড়ব্যা...

ইমাম সাহেবের কথা শেষ হতে না হতেই শ্রী শ্রী হরিকৃষ্ণ পাল দাঁড়িয়ে বললো

- হুজুর কি কমু? ঐ ভবা মোগো শ্রী কৃষ্ণর গায়ে টাহা পয়সা দিয়া এমনভাবে লেইপ্প্যা রাকছে সে হেইডারে আর চিননের উপায় নাই। আর নিচে লেইখ্যা রাখছে - " শ্রী শ্রী ট্যাকাষ্ণ।" আর বাবা লোকনাথের বাণীর মধ্যে লেইখ্যা রাখছে " জলে বনে রণে যেইখানেই যাও আমারে দরকার পড়িবে।" কত্তো বড়ো সাহস...

ম্যাজিট্রেড রশিদ তালুকদার দেখলেন - ভবা তার অভিযোগ শুনে মাথা নিচু করে মিটি মিটি হাসছে। তিনি সেই হাসির রহস্য ধরতে পারলেন না। তিনি ভাবলেন আরো দুই জন ফরিয়াদি আছে। তাদের ফরিয়াদও শুনতে হবে। তাই তিনি তাকালেন বৌদ্ধ মন্দিরের জ্ঞানেশ্বর ভিক্ষুর দিকে।

ভিক্ষু জ্ঞানেশ্বর তার দিকে তাকাতে দেখে দাঁড়িয়ে সেই একই অভিযোগ আনলেন ভবার বিরুদ্ধে। তিনি বললেনঃ

- ধম্মাবতার, ঐ ভবা জ্ঞানের প্রতীক বিজ্ঞের প্রতীক ভগবান বুদ্ধকে অপমানিত করেছেন। ভগবান বুদ্ধের ধ্যানের মুর্তির মধ্যে ঐ জ্ঞানপাপী টাকা-পয়সা দিয়ে এমনভাবে লেপে দিয়েছেন যে সেটাকে আর চেনার উপায় নেই। ললাটের মুলস্থানে যেখানে আমরা ধ্যানের আকর বলি সেইখানে একটা এক টাকার কয়েন বসিয়ে দিয়েছেন। আর লিখেছেনঃ
"ওহে মুর্খের দল! তোমরা বসিয়া বসিয়া কেন অযথা সময় নষ্ট করিতেছো। শীঘ্র যাও টাকা-পয়সা কামাও। নচেৎ কোন কিছু করিতে পারিবা না। জায়গা-জমি করিতে পারিবা না। সব কিছু হারাইলে শেষে জংগলেও ঠাঁই পাইবা না।"

রশিদ সাহেব খ্রীষ্টান পাদ্রী নলেজ গোমেজের দিকে তাকিয়ে বললেনঃ

- ভবার বিরুদ্ধে আপনার কি অভিযোগ?

- হুজুর আমারও ঐ একই অভিযোগ। ভবা আমাদের গীর্জার মধ্যে প্রবেশ করে পবিত্র যীশুকে অপমানিত করেছেন। মা ম্যারিকে অপমানিত করেছেন। ক্রুশের মধ্যে টাকা গাঁথিয়া রাখিয়াছেন। আর যেখানে মা ম্যারি যীশুকে কোলে তুলে বসেছিলেন সেইখানে যীশুর হাতে একটি টাকার কয়েন ধরিয়ে দিয়েছেন। আর বাণীর স্থানে লিখে রেখেছেনঃ
"টাকার জন্য প্রার্থনা করুন।"

সবশুনে ম্যাজিট্রেড রশিদ তালুকদার বেশ উৎসাহবোধ করছেন। চারটি ধর্মের কর্তা ব্যক্তিরা একজন পাগলের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলছে। কিন্ত্তু তারা কি জানে - যাকে পাগল বলা হচ্ছে সে যদি সত্যিই প্রমাণিত হয় যে বিকারগ্রন্থ তাহলে আইনে তার শাস্তি না-ও হতে পারে। কিন্ত্তু ভবাকে দেখে তার পাগল মনে হচ্ছে না। তার হাসিই বলে দিচ্ছে নিশ্চয়ই সে কোন একটা কারণে কার্য্যগুলো করেছে। কিন্ত্তু কি তার উদ্দেশ্য? সেটাতো জানা হলো না। তাই রশিদ সাহেব ভবাকে লক্ষ্য করে তার দিকে তাকিয়ে বললেনঃ

- আসামী ভবা পাগলা। আপনার বিরুদ্ধে ফরিয়াদীরা যে অভিযোগগুলো দাখিল করেছে তাতো আপনি শুনেছেন। আপনি ধর্মকে অবমাননা করেছেন। এ ব্যাপারে আপনার কি বলার আছে?

ভবা পাগলা কিছু না বলে কেবলই হাসছে। মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে এক অভিনব পদ্ধতিতে কেবল হেসেই যাচ্ছে আর বলছে

" মান বাহর জামিয়াতে নাঁলানে শোদাম,
জুফতে খোশ হালানো বদ হালানে শোদাম।"

অর্থঃ আমার দুঃখ ও ক্রন্দনের অবস্থা কাহারও নিকট অপ্রকাশ্য নাই। ভাল-মন্দ প্রত্যেকের নিকট-ই আমার অবস্থা প্রকাশ হইয়া রহিয়াছে।