পৃষ্ঠাসমূহ

মঙ্গলবার, ১২ মে, ২০১৫

ভবা পাগলার জবান বন্দী

ভবা পাগলা আরেকটি নজীর সৃষ্টি করেছেন। তিনি একটি মাজার বানিয়েছেন। সেটার উপর টাকা দিয়ে গেলাফ চড়িয়েছেন। সেই মাজারের দান বক্সের উপর লিখে রেখেছেন - "মুশকিল আসান"- ভবা পাগলা। ইতঃপূর্বে তার কীর্তিকলাপে ক্ষেপেছিলেন চারটি ধর্মের প্রধান কর্তা ব্যক্তিরা। এবার ক্ষেপেছেন - মাজার বাদীরা। তারা ভবাকে বেইমান কাফের বলে ফতুয়া দিয়েছেন। শুনে ভবা কেবল হেসেছেন। প্রশাসনের লোকজন এই ভবার উপর ক্ষেপে গিয়েছেন ভীষণভাবে। একজন নাগরিক হিসেবে তাকে নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব সরকারের। কিন্ত্তু তার মানে এই না যে, কেবল তাকেই নিরাপত্তা দিতে সমস্ত পুলিশ বাহিনীকে নিয়োজিত রাখতে হবে? তাছাড়া ভবাকে বার বার এই ন্যাক্কার জাতীয় কাজ করতে দেখে তারাও সমানে গালি দিচ্ছেন। তারা সিধান্ত নিয়েছেন - ভবাকে ধরে নিয়ে আসবেন। সমাজে যাতে বিশৃংখলা সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করার চিন্তা ভাবনা করছেন। কিন্ত্তু তাকে তো এমনি এমনি কারাগারে প্রেরণ করা যায় না। তাকে বিচারিক আদালতে দাঁড় করাতে হবে। তার কথা শুনতে হবে। উপর থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করার জন্য। সুতরাং পুলিশের ঘুম হারাম হয়ে গেল। এই পাগলকে কোথায় পাওয়া যায়? কোথায় থাকে? তার সাঙ্গ-পাঙ্গ কারা? এতো ভারী মুশকিল হলো দেখছি । কি করা যায় ? শেষ পর্যন্ত তাকে পাওয়া গেল। তাকে হাত কড়া পড়িয়ে পুলিশের গাড়ীতে উঠিয়ে নেয়া হলো। থানায় নিয়ে তাকে হাজতে রাখা হল। পরদিন তাকে কারাগারে পাঠানো হবে। 

ভবাকে গ্রেফতারের সংবাদে মাজারবাদীদের মধ্যে একধরণের আনন্দের জোয়ার বইল। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সবাই। থানা হাজতে ভবাকে রাখা হলো। থানার উৎসুক পুলিশ সদস্যরা ভবাকে দেখছে আর টিটকারী মারছে। কেউবা সেটা সহ্য করতে না পেরে অন্যদেরকে বিরত থাকার আহব্বান জানাচ্ছে। যাকে নিয়ে এতো মাথা ব্যাথা সেই ভবা একদম নির্বিকার। সাংবাদিকরা সমানে ছবি তুলছেন। তার সাথে কথা বলতে চাইছেন। কিন্ত্তু পুলিশ প্রশাসন সে অনুমতি দিচ্ছে না। তারা নিরাপত্তার খাতিরে সেটা করতে বাধ্য হয়েছেন। তাই সাংবাদিকরা কেবল ছবি তুলেই চলে যাচ্ছেন। পরদিন তারা কোর্টে দেখা করবেন।

পরদিন ভবাকে নিয়ে যাওয়া হলো সিএমএম আদালতে।আদালতের ম্যাজিট্রেট জনাব জগন্নাথ দাস। তার এজলাস প্রাংগনে ভবাকে হাজির করা হলো। ম্যাজিট্রেট নির্দেশ দিলেন ভবার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ পড়ে শোনানোর জন্য। নির্দেশ পেয়ে আদালতের কাঠ গড়ায় দাঁড়িয়ে পুলিশের এস আই খোকন সিকদার বললেনঃ মাননীয় আদালত। এই ভবা পূর্বে ম্যাজিট্রেট রশীদ তালুকদার স্যারের থানা প্রাংগনে বিচারের সম্মুখীন হয়েছিলেন। সে সময় তাকে তিনমাস জেল দেয়া হয়েছিল।
আদালত জানতে চাইল- কি কারণে তাকে জেল দেয়া হয়েছিল?
-হুজুর, সে ধর্মীয় রীতি নীতি ভংগ করে ধর্মের অবমাননা করেছিল। এই নিন হুজুর, সমস্ত অপকর্মের চার্জশীট।

পেশকার সেই চার্জশীটের কপি নিয়ে আদালতে পেশ করলেন। সেটা দেখে আদালত ভবার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল সে কোন উকিল নিয়োগ করতে চায় কি-না? কিন্ত্তু একটি পাগলের উকিল হবার জন্য কেউ আগ্রহ দেখালেন না। ভবা সেটা বুঝতে পেরে বললোঃ

- হুজুর। ধর্মাবতার। আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সবই আমি স্বীকার করছি। কিন্ত্তু কেন করেছি? সেটার পেছনে কারণগুলো কি? সেটাতো তারা বিচার করতে চাইলো না। কেউ জানতেও চাইলো না। আমি পাগল বলে সবাই আমাকে ধীক্কার দিচ্ছে। আর আমি দেখছি সবাই পাগল।

-আদালত আপনার সমস্ত কথা শুনতে প্রস্তুত। আপনার জবানবন্দী রেকর্ড করা হবে। আপনি বলুন। নির্ভয়ে বলুন।

-ধন্যবাদ মাননীয় আদালত। হুজুর আমার বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ - আমি মসজিদের ইমাম সাহেবের স্থানে টাকা দিয়ে একটি ইমাম বানিয়েছি এবং সেটাকে মুসল্লিদের মানতে অনুপ্রাণিত করেছি। কিন্ত্তু কেন করেছি? কেন ইমামের স্থানে রেখেছি? কেন সেটা মুসল্লিদের স্থানে রাখা হয়নি। আর কেনই বা মুসল্লিদেরকে সেটা অনুকরণ করতে বলেছি?

হুজুর, হাদিছে আছেঃ ' লা সালাতা ইল্লাবি হুজুরি কলব'। হুজুরি কলব ব্যতীত সালাত হবে না। হুজুরি কলব হচ্ছে একাগ্রচিত্ত। একাগ্রচিত্তে প্রভুকে স্বরণ করে সালাত আদায় করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআন পাকে বর্ণিত আছেঃ"লা তাকরাবু সালাতা ওয়াআনতুম সুকারা" । অর্থঃ"দুনিয়ার চিন্তা-ভাবনা নিয়ে সালাতে দাঁড়িও না।" কিন্ত্তু ইমামগণ সেটা পালন করেন না। তারা সাংসারিক চিন্তায় মশগুল থাকেন। তাদের চিন্তা চেতনায় থাকে টাকা। তারা যখন সালাত আদায়ের উদ্দেশ্য করে নিয়ত করে সে সময় বলে-সমগ্র দিক হতে মুখ ফিরিয়ে তোমার দিকে আমার মন রুজ্জু করলাম। সুরা ফাতেহায় পাঠ করা হয় " ইয়া ক্যানা বুদু ইয়া কানাস্তাইন।" আমরা তোমার ইবাদত করি এবং তোমার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি। হুজুর, এখন ইমামগণ কি ভেবে দেখেছেন - তারা তাদের ইলাহ কাকে বানাচ্ছেন? কেউ যদি টাকার চিন্তা করে সেক্ষেত্রে ইলাহ হচ্ছে টাকা। গরুর চিন্তা করলে ইলাহকে নিয়ে যাচ্ছে গরুর দিকে। বিভিন্ন চিন্তায় মশগুল থেকে তারা স্রষ্টার সামনে দাঁড়িয়ে দুটি অন্যায় করছে। এক. স্রষ্টার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা এবং দুই. মুসল্লিদেরও তার সাথে নিয়ে যাওয়া। মাননীয় আদালত। ইমামকে অনুসরণ করে মুত্তাকীরা বলে থাকেন - "ইত্তাদায়াতু বেহাজাল ইমাম।"  ইমাম যদি অন্যায় করে থাকে সেই ইমামকে অনুসরণ করে মুত্তাকীরাও বিপথে যাচ্ছে। এর দায় কে নেবে? হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান সব ধর্মযাজকরা টাকার কাঙ্গাল হয়ে গেছে। তারা ধর্মকে ব্যবহার করছে হাতিয়ার হিসেবে। তাদের এই হীন্যমনতার কারণে বলী হচ্ছে সাধারন লোকজন। যাদের ধর্মবল প্রবল। ইচ্ছে ভক্তি প্রবল। তাদের সহজ সরল মনকে এরা সহজেই ব্যবহার করছে। তাদেরকে ব্যবহার করা হচ্ছে টাকা কামানোর মেশিন হিসেবে।

-প্রমাণ দিন।

-হুজুর কি প্রমাণ দিব? প্রমাণতো মন। এই হৃদয়। এই হৃদ মন্দিরের মাঝেই যে বন্দী আছে সেইতো দ্রষ্টা। সেইতো শ্রোতা। সে সবকিছু জানে।

-আবেগ দিয়ে ধর্ম কর্ম করা যায়। বিচার কার্যে প্রয়োজন হয় প্রমাণ। প্রমাণ ব্যতীত আদালত বিচারিক কার্য সম্পাদন করতে পারে না। আপনি যে কাজ করেছেন তার প্রমাণ আছে। কিন্ত্তু মসজিদের ইমাম, মন্দিরের পুরোহিত, বৌদ্ধদের ভিক্ষু, খ্রীষ্টানদের পাদ্রী-তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আনলে প্রয়োজন দালিলিক প্রমাণ এবং প্রত্যক্ষ প্রমাণ। যেটা আপনি দিতে পারেননি। ধরেই নিলাম আপনি দালিলিক প্রমাণ দিলেন কিন্ত্তু প্রত্যক্ষ প্রমাণ কিভাবে দেবেন?

আদালতের কথা শুনে ভবা বেকুব হয়ে গেল। সে কিভাবে প্রমাণ দেবে যে ইমাম মনে মনে কি বলছে? ঠাকুর পুরোহিতরা কি করছে? ভিক্ষুরা কি করছে? ফাদাররা কি করছে? কোন অলীর মাজারকে পুজি করে কিভাবে ব্যবসা করছে? আমিতো দেখছি সবই...কিন্ত্তু আদালতের ঐ বিচারককে কিভাবে দেখাই? চিন্তায় মশগুল ভবার হটাৎ চোখ গেল আদালতের এক কোণায় দাঁড় করানো একটি মুর্তির দিকে। যার চোখ বন্ধ, হাতে একটি পাল্লা যেটা সে ধরে আছে...আর সেটা দেখেই ভবা এমন বিকট শব্দে হাসতে লাগলো যে আদালতে উপস্থিত জনাকীর্ণ সকলেই হতভম্ভ হয়ে গেল। ভবা বললোঃ

-যার চোখ বন্ধ সে কিভাবে সঠিক বিচার করতে পারে সেটা ভেবেই হাসছি।

চারদিকে ভীষণ গুন্ঞ্জন উঠলো। কেউ কেউ আদালত অবমাননা করার অভিযোগ আনলো। কেউ বললো এই ভন্ডকে ফাঁসিতে দেয়া উচিত....কেউবা ভবার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অসহায় দৃষ্টিতে। ভবা দেখছে আর হাসছে....স্বশব্দ করেই হাসছে।

যতই মাননীয় আদালত বলে অর্ডার অর্ডার..ততবারই ভবা হাসছে..স্বশব্দ করেই হাসছে..