পৃষ্ঠাসমূহ

সোমবার, ১১ মে, ২০১৫

একটি শোক সংবাদ- শেষ পর্ব

(পূর্ব প্রকাশের পর)

তথ্যটি পাওয়ার পর শফিক সাহেবের আগ্রহ বেড়ে গেল। কিন্ত্তু তার তৃষ্ঞার নিবৃত্তি হচ্ছিল না। তাকে আরো জানতে হবে। তিনি গুগল ব্যবহার করে নেটে সার্চ দিলেন। কিন্ত্তু কোন পোষ্টই তার মনের তৃষ্ঞা পূর্বের মতো নিবৃত্ত করতে পারছিল না। অধিকাংশই নানান বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ রাখে। তিনি সেদিকে গেলেন না। মৃত্যু কি? সেটা মোটামুটি জানা গেলেও মৃত্যুটি কেন? সেটার উপর তেমন কোন ভালো মানের লেখা তার দৃষ্টি গোচর হচ্ছিল না। বেশ বিরক্ত হয়েই তিনি সার্চ করা বাদ রাখলেন। তিনি এবার দৃষ্টি দিলেন ধর্মগ্রন্থের দিকে। তার মনে পড়লো কোরআনের একটি আয়াত। এটি প্রায়ই প্রত্যেকটি মুসলিম নর-নারীই জানে। সেটি কি? সেটি হলোঃ”কুল্লি নাফসিন জায়েকাতুল মউত।” প্রত্যেকটি প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করিবে। অন্য স্থানে বলা হয়েছেঃ”ইয়া আইয়্যাতুহান নাফসুল মুতমাইন্নাতু ইরজিই ইলা রাব্বিকি রাদিয়াতাম মারদিয়াতিন। ফাদখুলুফি ইবাদি। ওয়াদ খুলি জান্নাতি ” [সুরা ফজর। আয়াত ২৭-৩০] হে প্রশান্ত আত্মা ফিরিয়া আস তোমার রবের দিকে একাগ্র খুশি মনে। (তার) একই মর্জি অনুসারে। সুতরাং আমার দাসের মধ্যে নিহিত হও। এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর। সুরা বনী ইসরাইল ৪৯-৫০নং আয়াতে বলা হয়েছে-”এবং তাহারা বলে (আমরা) যখন পচে গলে হাড়ে পরিণত হইব তখনও কি আমাদেরকে নতুনভাবে সৃজন করিয়া পুণরায় উঠানো হইবে?[ওয়াকালু আ-ইজা কুন্না ইজামান ওয়ারুফাতান আ-ইন্না লামারউসুনা-খালকান জাদিদান] তুমি বল, তোমরা পাথর অথবা লৌহখন্ডে পরিণত হইলেও।” [কুলু কুনু হেজারাতান আও হাদীদান]। সুরা আনআম ৩৮নং আয়াতে বলা হয়েছেঃ ” এবং পৃথিবীতে বিচরণশীল যত প্রাণী রহিয়াছে এবং দুই ডানায় ভর করে যত পাখি ওড়ে অবশ্যই তাহারা তোমাদের মতো একটি উম্মত(দল,সম্প্রদায়) ব্যতীত নয়। (ওয়ালা মিন দাববাতীন ফিল আরদে ওয়ালা তায়েরীন ইয়াতীরু বে জানাহাইহে ইল্লা উমামুন আমসালুকুম)।
সনাতন ধর্মের প্রধান একটি বিষয় জন্মান্তরবাদ। গীতায় বলা হয়েছেঃ “জাতস্য হি ধ্রবো মৃত্যুর্ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ। তস্মাদপরিহার্যেহর্থে ন ত্বং শোচিতুমর্হসি।।” (গীতা ২/২৭)
অর্থঃ ” যার জন্ম হয়েছে তার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী; এবং যার মৃত্যু হয়েছে তার জন্মও অবশ্যম্ভাবী। অতএব তোমার কর্তব্য সম্পাদন করার সময় শোক করা উচিত নয়।”
বিষয়টি তাকে ভাবিয়ে তুললো।একটু বিরতি নিয়ে তিনি আবার লেখা শুরু করলেন। হেডিং হিসেবে লিখলেন মৃত্যু কেন?
কোন্ জিনিসটি পৃথিবীতে চিরন্তন সত্য? কোন্ বিষয়টি নিয়ে মানুষ এতো দুঃচিন্তাগ্রন্থ হয়েছে? কোন্ বিষয়টি অতিক্রম করার জন্য সুফী সাধকগণ জীবনের সকল বাসনা ত্যাগ করে ধ্যান মগ্ন হয়েছেন? মৃত্যুর বিষয়টি ছাড়া আর কোন বিষয়ই মানুষকে এতো বেশি ভয় পাইয়ে দেয়নি। কাজেই মৃত্যু একটি অনিবার্য্য পরিণতি। এটিকে স্বীকার করে নেয়া ছাড়া অন্য কোন গত্যান্তর নেই। কিন্ত্তু মৃত্যটি কেন?
পদার্থ বিজ্ঞানের শক্তির নিত্যতা বিধির সুত্রটি অধ্যয়ন করলে জানা যায়-”শক্তির সৃষ্টি বা ধংস নেই। শক্তিকে শুধুমাত্র একরুপ হতে অন্যরুপে রুপান্তরিত করা যায়। সমগ্র সৃষ্টি জগত, সাগর, মহা-সাগর ইত্যাদি কোথা হতে আসলো? এ কথা সকল ধর্মগ্রন্থ কর্তৃক স্বীকৃত যে, সকল সৃষ্টি জগতই এক পরম সত্তা একটি মহাশক্তি হতে নির্গত হয়েছে এবং উহাতেই প্রত্যাবর্তন করবে। একথা পবিত্র কোরআন শরীফেও বর্ণিত আছে। যথাঃ ইন্নানিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজেউন।
প্রকৃতির দিকে খেয়াল করলে দেখলে আমরা কি দেখতে পাই? সমুদ্র হতে পানি বাষ্প হয়ে আকাশে মেঘের আকারে জমা হচ্ছে। মেঘ বরফে রুপান্তরিত হচ্ছে। সেই মেঘই আবার বৃষ্টি হয়ে সমুদ্রে প্রত্যাবর্তন করছে। মাটির নীচ হতে একটি ক্ষুদ্র বীজ হতে অন্কুর উঁকি মারছে। ক্রমে শিশু চারা গাছটি ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। তারপর বাড়তে বাড়তে একটি বিরাট বৃক্ষ রুপ ধারণ করছে। তারপর বৃক্ষটি কিছু বীজ রেখে মৃত্যু মুখে পতিত হলো। একটি পাখির দিকে তাকিয়ে দেখুন, দেখুন কিভাবে একটি ডিম থেকে তার জন্ম হয়? তারপর সে জীবন-যাপন করে তারপর তার মৃত্যু হয় আর মৃত্যুকালে রেখে যায় কতোগুলো ডিম। সমস্ত সৃষ্ট জগত এ নিয়মে চক্রাকারে ঘুরছে। যেখান থেকে তার সৃষ্টি সেখানেই সেটি প্রত্যাবর্তন করছে। সুতরাং মৃত্যু অর্থ কখনোই ধ্বংস নয়। এর অর্থ যা থেকে তার উদ্ভব উহাতেই তার প্রত্যাবর্তন। ক্রমেই সমগ্র সৃষ্টি জগত জন্ম মৃত্যুর আবর্তে ঘুরতে ঘুরতে সেই পরম সত্তায় বিলীন হচ্ছে। কোরআন দর্শনে সুফী সদরউদ্দিন আহমদ চিশতী সাহেব ও তাঁর কোরআন দর্শনে এই চক্রাকারের কথাই বলেছেন। কোরআন দর্শনে উল্লেখ আছেঃ হামিম অর্থ নরকের ঘোলা পানি বা বীর্য। যা হতে জীবের সৃষ্টি। হাবিয়া অর্থ-মাতৃগর্ভ বা ভ্রুণ। জাহিম – নরকের আগুন অর্থাৎ নরকের জ্বালা যন্ত্রণা। মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত নরকবাসীগণ হামিম-হাবিয়া-জাহিম এই চক্রাকারে ঘুরছে। হয়তো এ বিষয়টি বুঝতে পেরেই মাওলানা জালালউদ্দিন রুমী বলেছেনঃ-
আমি পাথর হয়ে মরি আবার গাছ হয়ে জন্মাই
গাছ হয়ে মরি আবার পশু হয়ে জাগি
পশু হয়ে মরি আবার মানুষ হয়ে জন্মাই
তাহলে ভয় কিসের? কি বা হারাবার আছে মৃত্যুতে?
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা মোটামুটি বলা যায়, ইসলামের দৃষ্টিতে আমাদের বৃহত্তর জীবনকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়ঃ
১) মাতৃ গর্ভে আসার আগে মহান সৃষ্টি কর্তার আছে আমাদের অবস্থান,
২) মাতৃ গর্ভে আমাদের দশ মাসের আবাস,
৩) পৃথিবীর বুকে আমাদের জীবনযাপন,
৪) মৃত্যু আর পুনরুজ্জীবনের মধ্যকার জীবন আর সর্ব শেষে
৫) পুনরুজ্জীবন থেকে আরম্ভ করে শেষ বিচার আর তার পরবর্তী স্বর্গ অথবা নরকের জীবন।
শেষ বিচারের পরে আমরা আমাদের চূড়ান্ত গন্তব্যে পোঁছাবো। এর পরে সেখানে আমাদের পথ চলা বন্ধ হবে। আরম্ভ হবে অনন্ত জীবন। যার কোন শেষ থাকবে না। বর্তমানে আমাদের অবস্থান ৩ নম্বর পর্যায়ে। আমরা পৃথিবীর বুকে ধরে এগিয়ে যাচ্ছি। পরবর্তী পর্যায়ের দিকে। যা হল মৃত্যু। এটা আমরা ইতিমধ্যেই জানি, আমরা আমাদের বর্তমান অবস্থান কি ভাবে কাটাচ্ছি। তার উপরে নির্ভর করছে আমাদের বৃহত্তর জীবনের পর্যায় ৪ ও ৫।
সর্বশেষে বলা যায় – মৃত্যু হচ্ছে একটি সেতু স্বরুপ। যা বন্ধুকে বন্ধুর সাথে মিলিয়ে দেয়। মৃত্যু নিয়ে ভীততো তারাই হবে যারা অন্যায়-অবিচার অনাচার করছে। তাদের জন্য দুঃসংবাদ। আর যারা সৎ কার্য সমাধা করবে তাদের জন্যতো সুসংবাদ। তারা প্রভুর সান্নিধ্যে আশ্রয় লাভ করবে….চিরজীবনের জন্য চিরস্থায়ী নিবাসের জন্য।
লেখাটি শেষ করে তিনি নিজেই অনেক ভাবিত হলেন। স্রষ্টার স্বরণ নেয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। ওয়াশ রুমে গিয়ে ওযু করে এশার নামাযের প্রস্তুতি নিলেন। নামায শেষ করে নিজের সন্তানদের দিকে তাকিয়ে তার মনে হলো তিনি বিদায় নিলে তারই ফেলা যাওয়া বীজের অন্কুরগুলোও ক্রমান্বয়ে উদ্ভিদাকারে বড়ো হবে। এবং তারাও কিছুদিনের অবকাশ পাবে। তারপর তারাও বিদায় নিবে। কি অদ্ভুত এ মানব জীবন। কি রহস্যময় তার লীলা…স্রষ্টার করুণাধারায় সিক্ত শফিক সাহেবের দুচোখে তখন শ্রাবণের বারিধারা অনর্গল বয়ে চলেছে….
দুর হতে বাবাকে দেখছিল অর্থি। বাবার চোখে জল দেখে অর্থি দৌড়ে এসে বললো
- বাবা, তুমি কাঁদছো কেন?
-ও তুমি বুঝবে না মা। তিনি মেয়েকে শক্ত করে চেপে ধরলেন। যেন যম তাকে ছিনিয়ে নিতে না পারে। কিন্তুু তিনি জেনে গেছেন..তা সম্ভব নয়। তিনি স্বশব্দে কেঁদে উঠলেন। আর বিড়বিড় করে আবৃত্তি করলেন মীর্যা গালিবের একটি শায়ের -
আমি যেতে চাই বসতবাটিতে,
এমন স্থলে,
যেখানে কোথাও কেউ নেই।
আমার বক্তব্য বুঝতে কেউ নেই,
আমার সঙ্গে কথা বলারও কেউ নেই,
সেখানেই, আমি যেতে চাই।
আমি গড়তে চাই,
এমন একটি বসতবাটি,
প্রবেশের একটি দরজা ছাড়া,
সীমানা দেওয়াল ছাড়া,
সেখানে কোনো প্রতিবেশী থাকবে না,
এবং কোনো পাহারা থাকবে না।
এখানে কেউ একত্র হবে না,
আমার প্রতি যত্নবান হতে,
যখন আমি পশুচর্মে আবৃত হব।
তখনো কেউ থাকবে না,
শোকসন্তপ্ত অথবা কাঁদবে,
যখন আমি চলে যাব।