পৃষ্ঠাসমূহ

বৃহস্পতিবার, ২১ মে, ২০১৫

জোলাভাতি

সারাদিন ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত শফিক সাহেব পার্কে থাকা বেন্ঞ্চিতে বসে পড়লেন। লেকের ঝিরি ঝিরি হাওয়া, পাতার মর্মর শব্দে আর পাখিদের কলতানে কিছুক্ষণের মধ্যেই তার শরীরটাকে শীতলতার পরশ বুলিয়ে দিল। কেমন যেন একটা ঘুমের আবেশ তৈরী হলো। তিনি বেন্ঞ্চে আলতোভাবে নিজেকে এলিয়ে দিলেন। চোখে তখন রাজ্যের ঘুম চলে এল। পাখির ডাকে আর বাতাসের আবহনে তিনি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। কোয়ান্টাম মেথডের মতো চোখ বুঁজে পড়ে রইলেন। 

পাশেই দেখলেন পথ শিশুরা মাটি কাদা আর কচুরি পানা দিয়ে জোলাভাতি খেলছে। তিনি তাদের কথা বার্তা শুনতে পাচ্ছেন। সেই কথা শুনতে শুনতে তিনি হারিয়ে গেলেন অতীত স্মৃতিতে........

বাড়ীর পাশ দিয়ে বয়ে চলা ছোট একটি খাল। খালের গভীরতা খুব বেশি না হলেও সেটাতে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। একটু দুরেই বাগান। বাগানের গাছ গাছালি আর পাখিদের কলতানে সব সময়ই মুখোরিত থাকতো। খালের মুখেই ঝুঁকে পড়া বাদাম গাছের একটি ডালে থোকা থোকা কাঠ বাদাম ধরেছে। সেই বাদাম পেড়ে আনতেন। কচুরি পানা দিয়ে তৈরী করতেন গরু। মাটি দিয়ে ভাত রান্না করতেন। কাদা মাটি আর কচুরি পানা দিয়ে তৈরী করতেন তরকারী। তারপর সেটা সবাই মিলে মিথ্যে মিথ্যে খাওয়ার জন্য বসতেন। কখনো মুন্নি বা তিন্নিকে বউ বানাতেন। বলতেন 

-বউ আমি গোছল সেরে আসতাছি। তুমি ভাত রাইন্ধ্যা আমারে ডাক দিও। 

-আইচ্ছা। তুমি গোছল কইর‌্যা তাড়াতাড়ি আইস্যে।

গোসল করতে খালে ঝাঁপ দিতাম। সারা খাল মাতিয়ে তুলতাম। কাঁদা মাটি দিয়ে ছোঁড়াছুঁড়ি খেলতাম। সারাটা দিন কেটে যেত কতো আনন্দে। গোছল শেষ করেই কখনো মুন্নিকে কখনো তিন্নিকে বলতাম

-বউ ভাত দেও। 

-এই নেও। কচুরি পাতার উপর ধুলো দিয়ে রাধা ভাত আর তরকারী দিত। কপ কপ করে মিথ্যে খাওয়ার অভিনয় করে বলতাম

-তরকারীটা স্বাদ হইছে। আরেকটু দেও...

পুরোনো সেই স্মৃতিটা যেন ভাসছে চোখের সামনে। চোখের সামনে এমন একটি ঘটনায় তার চোখ দুটো জলে ঝাপসা হয়ে এল। আজ কোথায় মুন্নি আর কোথায় তিন্নি? কোথায় মুনির, সাদেক? দেখতে দেখতে সেই সোনালী অতীতগুলো কালের স্রোতে হারিয়ে গেল।

তিনি তাকিয়ে দেখলেন - সেই পথ শিশুরাও তেমনিভাবে সেই খেলাটাই খেলছে। তিনি তাদের ডাকলেন। সেই ডাকে সারা দিয়ে একটি ছোট্র মেয়ে এসে বললোঃ

-ডাকছেন ক্যান?

-এম্মনি। কি নাম তোমার?

-সালেহা। আর ওর নাম? আমি হাত দিয়ে ইশারা করে দেখালাম

-অর নাম মায়া।

শফিক সাহেব তাদের সবাইকে ডাকলেন। তারা সবাই আসতেই একশো টাকার একটি নোট ধরিয়ে দিয়ে বললেন-এই টাকা দিয়ে কিছু কিনে খাও। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বাড়ীর পথ ধরলেন। পথে হাঁটতে হাঁটতে আবৃত্তি করছেনঃ

আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা একা কথা কয়।
-জীবনানন্দ দাস

[বিঃদ্রঃ # ব্যাখ্যাঃ জীবন+আনন্দ=জীবনানন্দ। আনন্দময় জীবনের অংশ যিনি তিনিইতো জীবননান্দ। দাস কথাটির অর্থ গোলামী করা। অর্থাৎ মহান সৃষ্টিকর্তার আনন্দময় কৃতির যিনি দাস হইয়া থাকিবার যোগ্য হন তিনিই হন জীবনানন্দ দাস।
প্রভুর বিভুতির স্থান হচ্ছে হৃদদেশে। সেই স্থানে আসন করিবার যোগ্য হলেই কেবল উপাসনার বিষয়ে পরিণত হন। তিনি কে? তিনিই হচ্ছেন- " আমি "। পন্ঞ্চভুতের পন্ঞ্চ দেবতার চেয়েও তিনিই বড়ো। তিনি না থাকিলে জীব চৈতন্যপ্রাপ্ত হন না। সেটা কে? সেই উত্তর জানিতে হইলে ঐ পন্ঞ্চভুতের পন্ঞ্চদেবতাদেরকে জিগ্যাসা করা হইলে তাহারাও নিঃসন্দেহে বলিবে-"আমি"। তাহার পরিচয় কি? তাহার পরিচয় হইল - সে সমস্তদেবতাদেরও দেবতা। তাই তিনি মহাদেব। সেই মহাদেবের অন্য নাম - আমি।
আলোচ্য অংশে - " অামি সব দেবতাকে ছেড়ে আমার প্রাণের কাছে চলে আসি " কথাটির সারমর্ম হইতেছে - তিনি তাহার নিজ স্থানে স্বমহিমায় উদ্ভাষিত হইয়া থাকিতে চাহেন। যখন উদ্ভাষিত হন তখনই তিনি আবার তাহাকেই প্রশ্ন করিয়া থাকেন - " বলি আমি এই হৃদয়েরে; সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা একা কথা কয়।"]