পৃষ্ঠাসমূহ

শুক্রবার, ১৫ মে, ২০১৫

কাউসারের মৎস শিকার


নদী এখন পুর্ণ যৌবনা নয়া পানির নয়া ডাকে সারা না দিয়ে পারলো না কাউসার তার একটাই চিন্তা পোনা মাছ শিকার করা সে একটা ঠেলা জাল বানিয়েছে আন্ঞলিক ভাষায় সেটাকে বলা হয় খোঁচাইল সেইটা দিয়েই সে ঠেলে ঠেলে মাছ শিকার করে ত্রিভুজাকৃতির খোঁচাইল দেখতে অনেকটা স্ত্রীজনন ইন্দ্রিয়ের মতো তিন টুকরো বাঁশের কন্ঞি দিয়ে তৈরী মাঝখানে জাল পাতা
বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসে আষাঢ়ের প্রথমভাগে গাঙ্গে নতুন পানি আসে। সেই পানিতে মা মাছ ডিম পাড়ে। সেই ডিম ফুটে বের হয় মাছের পোনা। কাউসার সেই পোনা মাছ ধরায় ব্যস্ত। সে দেখলো নদীর কাছাকাছি পাড়ের ধারে গুড়া চিংড়ি মাছই বেশি ধরা পড়ছে। ছোট ছোট চিংড়ি মাছের পোনা জালে পড়তেই সেগুলো কেচে তুলছে পাত্রে। সাথে আসছে নানান ময়লা আবর্জনা। আবর্জনা পরিস্কার করেই সে পোনা মাছগুলো তুলছে। দেখতে দেখতে বেশ মাছ ধরে ফেলেছে। একটু বিরতি দিয়ে সে পাড়ে এসে বসলো। তারপর একটা বিড়ি ধরিয়ে আপন মনে টানতে লাগলো। বিড়ি টানছে আর চিন্তা করছে আরো কিছু মাছ ধরবে। আজকে জালে বেশ মাছ ধরা পড়ছে। বিড়ি টানার ফাঁকে সে দেখতে পেল রহিম ভাই আসছে। রহিমকে সবাই তত্ত্বজ্ঞানী হিসেবেই জানে। বেশ রসিক। অনেক জ্ঞান রাখেন। লালনের ভক্ত রহিম ফকির এলাকায় পরিচিত বাউল রহিম হিসেবে। সেই রহিম বাউল হাতে একতারা নিয়ে গান গাইতে গাইতে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। কাউসারের দিকে তাকিয়ে রহিম ফকির বললোঃ

-
কি মিয়া কি মাছ ধরছো?

-
পোনা। পোনা মাছ ধরছি। এই শুমায় পোনা মাছই বেশি আহে গাঙ্গে.. কাউসার বললো।

-
গাঙ্গে তো পোনা মাছ আইবোই। নতুন জোয়ারে নতুন বানে পোনা আইবোই তো ... ত্রিবেণীতে ত্রিধারায় তিন রংয়ে পানি আহে। সেই পানিতে কেউ কুড়ায় মণি মাণিক্য। রসিক ডুবারুরা ডুব দিয়া আনে অমুল্যধন।

-
তোমার কথার আগা মাথা কিছুই বুঝি না। কি কও ত্রিবেণী রসিক ডুবারু হ্যান ত্যান...খুইল্যা কও

-
আরে মিয়া খুইল্ল্যা কওন যাইবো না রাইতে বাইত্তে আইও। পালা গানের আসর আছে। হেই সুময় কমুনে।
কাউসার আর দেরী করে না। তাড়াতাড়ি নদীতে নেমে পড়ে মাছ ধরা শুরু করে। মাছ ধরা শেষ করে দ্রুত বাড়ি চলে যায়। খাওয়া দাওয়া শেষ করে রাতে রহিম ফকিরের বাড়ীতে যায়। রহিম ফকিরের বাড়ী কবুতরখোলায়। বাড়ির চারধারে বেশ খোলা মেলা। সেই স্থানে একটি খাট দিয়ে স্টেজ তৈরী করা হয়েছে। সেখানে বসে আছে জনা কয়েক বাউল শিল্পী আর বসির মাওলানা। তাদের মধ্যে একজন বেশ কেতাদুরস্ত। চাল চলনে বেশ। গায়ে সাদা পান্ঞ্জাবী সাদা চাদর। পরণে সাদা লুংগি। নাম সোলেমান ভান্ডারী। তার সাথে বসির মাওলানার কথা কাটাকাটি চলছে। বেশ উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হচ্ছে। বসির মাওলানা বলছেঃ

-
সুরা কাউসারে বলা হয়েছে - " ইন্না আতায়না কাল কাউসার। ফা সাল্লিলিরাব্বিকা ওয়ানহার। ইন্না শানিয়াকা হুয়াল আবতার।" অর্থঃ নিশ্চয়ই আমি আপনাকে দান করিয়াছি হাউসে কাউসার। সুতরাং আপনি আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে সালাত করুন এবং কুরবাণী করুন। যে আপনার শত্রু, সেই তো লেজকাটা, নির্বংশ।" সুরার শানে নযুলে বলা হয়েছে " পুত্রসন্তান না থাকার কারণে কাফেররা রসূলুল্লাহ্‌ (সাঃ)-এর প্রতি দোষরোপ করত আথবা অন্যান্য কারণে তাঁর প্রতি ধৃষ্টতা প্রদর্শন করত। এরই প্রেহ্মাপটে সূরা কাউসার অবতীর্ণ হয়। এতে দোষরোপের জওয়াব দেয়া হয়েছে যে, শুধু পুত্রসন্তান না থাকার কারণে যারা রসূলুল্লাহ্‌ (সাঃ)-কে নির্বংশ বলে, তারা তাঁর প্রকৃত মর্যাদা সম্পর্কে বে-খবর। রসূলুল্লাহ্‌ (সাঃ)-এর বংশগত সন্তান-সন্ততিও কেয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে, যদিও তা কন্যা-সন্তানের তরফ থেকে হয়। অনন্তর নবী আধ্যাত্নিক সন্তান অথাৎ, উম্মত তো এত অধিকসংখ্যক হবে যে, পূর্ববর্তী সকল নবীর উম্মতের সমষ্টি অপেহ্মাও বেশী হবে। এছাড়া সূরায় রসূলুল্লাহ্‌ (সাঃ) যে আল্লাহ্তা'আলার কাছে প্রিয় সম্মানিত তাও তৃতীয় আয়াতে বিবৃত হয়েছে।"

-
আরে ভাই আপনে তো সুরা কাউসারের বাহ্যিক ব্যাখ্যা দিলেন। বাতেনী ব্যাখ্যা তো দিলেন না? সোলেমান ভান্ডারী বললেন।

-
বাতেনী ব্যাখ্যা আবার কি?

-
ভাই শোনেন। আপনি অযথা রেগে যাচ্ছেন। প্রত্যেকটি বিষয়েরই একটি জাহের আরেকটি বাতেন তথা গোপন বিষয় থাকে। জাহেরটি সবার কাছেই বলা যায়। কিন্ত্তু বাতেনী ভেদতত্ত্ব সর্ব সমাজে বলা যায় না। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। দেখেন কাউসার অর্থ হচ্ছে প্রাচুর্য্য। আর হাউস বলতে পাত্র বিশেষ বা আবাসস্থল বুঝায়। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসসাল্লাম এর বাহ্যিক অবস্থা তথা বাশারিয়াত সুরত মানবরুপ। আর হাকিকি হচ্ছে নুরে মুহাম্মদ। এই নুরে মুহাম্মদীই হচ্ছে সৃষ্টিজগতের নুরস্বরুপ এই জগত নুরে মুহাম্মদীই প্রকাশ এবং বিকাশ। নুরে মুহাম্মদীর মধ্যে উনিশটি গুণ বিদ্যমান থাকে যাকে তাসাউফের ভাষায় বলা হয় বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। এই বিসমিল্লাহ দ্বারাই জগত সৃজন।

-
তাই নাকি? পবিত্র কোরআনে আছেঃ "কুল ইন্না মা আনা বাশারুম মিস্ লুকুম ইউহা ইলাইয়া আননামা ইলাইকুম ইলাহুন ওয়াহিদুন।" [সুরা কাহাফ আয়াতঃ১১০] এইখানেই তো বলা হয়েছে -আনা বাশার অর্থ মাটির তৈরী। তোমাদের মতো। মানে আপনার আমার মতো মাটির মানুষ। আমরা যদি আপনার কথা ধরি তাহলে তো সেও সেই নুরে মুহাম্মদীতে তৈয়ারী। কি কন ভ্যান্ডারী সাব? ঠিক কইছি নি?

-
আপনারে মাওলানা কয় কোন হালায়? মাওলানা অর্থ জানেন মিয়া? মাওলা অর্থ প্রভু আনা অর্থ আমার। মাওলানা অর্থ আমার প্রভু। তাই বইল্যাা কি আপনে আমাগো প্রভু মানে আল্লাহ হইয়্যা গেছেন গা? যে আয়াতের অর্থ করলেন সেইটার প্রকৃত অর্থ হইলোঃ কুল-বলুন, ইন্না-নিশ্চয়ই, মা -(কি,না), আনা বাশারুম - আমি বাশার(মানুষ), মিস্ লুকুম-তোমাদের মতো, ইউহা -ওহি করা হয়, ইলাইয়া-আমার দিকে, আননামা-যে, ইলাইকুম-তোমাদের ইলাহা, ইলাহুন-ইলাহা, ওয়াহিদুন -এক। সম্পুর্ণ অর্থ হলো- বলুন, নিশ্চয়ই আমি কি বাশার(মানুষ) তোমাদের মতো ? আমার দিকে ওহি করা হয় যে তোমাদের ইলাহাই একই ইলাহা

উপরোক্ত আয়াতে  কোথাও বলা হয়নি -আদম সন্তান যে উপাদানে সৃষ্টি , তিনি সে উপাদানে সৃষ্টি উপরোক্ত আয়াতের প্রথম অংশ প্রশ্ন বোধক (?) ব্যাকরণ (ট্যাক কোসশেন) অনুসারে না-বোধক (Negative) হলে সে বাক্য হ্যাঁ-বোধক (Affermative) বাক্য আর হ্যাঁ-বোধক (Affermative) হলে সে বাক্য না-বোধক (Negative) হয় প্রথম অংশ- নিশ্চয়ই আমি কি বাশার (মানুষ) তোমাদের মতো? যেহেতু বাক্যংশটুকু হ্যাঁ-বোধক তাই এর মিনিং হবে না-বোধক অর্থাৎ অংশই বলে দিচ্ছে তিনি আমাদের মতো নন এর পরের অংশে বলা হচ্ছে- আমার দিকে ওহি করা হয় অংশই বলে দিচ্ছে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর কাছে ওহি আসত সুতরাং আয়াত থেকেই বোঝা গেল তিনি আমাদের মতো নন এবং তার কাছে ওহি আসত যে মহামানব অতি মানব এর কাছে আল্লাহ পাক এর তরফ হতে ওহি আসত তিনি আমাদের মতো কি করে হন ?

কোরআন পাকের একটি আয়াত উল্লেখ করছি যা থেকে আমরা জানতে পারবো রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম আল্লাহ পাকের জাতি নূর হতে সৃষ্টি। আল্লাহ পাক বলেন- কাদ্ জায়াকুম মিনাল্লাহে নূরি ওয়া কিতাবুম মুবিন
অর্থঃ আমি তোমাদের নিকট আল্লাহর নূর এবং একটি স্পষ্ট কিতাব পাঠিয়েছি (সুরা মায়েদা,আয়াত-১৫)

আয়াতে 'ওয়া' অর্থাৎ এবং ব্যবহার হয়েছে আরবী বা বাংলা বা ইংরেজী যে ব্যাকারণ বলুন না কেন 'ওয়া(এবং)' ব্যবহার হয় -দুটি বাক্যের পৃথকতা বুঝাতে সুতরাং মিনাল্লাহে নূরি(আল্লাহর নূর) কিতাবুম মুবিন(স্পষ্ট কিতাব ) দুটি পৃথক বিষয় সুতরাং আল্লাহ পাঠিয়েছেন নূর তথা মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এবং স্পষ্ট কিতাব তথা আল কোরআন আল্লাহ পাক নূরে তাজাল্লী তাই তার বাণী(আল কোরআন) নূরে মোহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর কাছে পাঠাবেন এটাই তো ঠিক কেননা আল্লাহর বাণী ধারণ করার ক্ষমতা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় তাই আল্লাহ তার প্রেরিত নবী-রাসূলদের কাছে পাঠিয়েছেন।(তাফসীরে ইবনে কাসীর, তাফসীরে রুহুল রয়ান, তাফসীরে রুহুল মা'আনী, তাফসীরে কানযুল ইমান)

বসির মাওলানা এবং সোলেমান ভান্ডারীর মধ্যে তুমুল তর্ক-বিতর্ক চললো নিয়ে। সেই সময় রহিম ফকির এসে দুজনকে থামতে অনুরোধ করেন। তারা থেমে গেলেও দুজনের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে দুজনই চরম বিরক্ত। এরপর শুরু হলো গানের আসর। শরীফ বাউল গাইলেনঃ

লয়ে গুরুর মন্ত্র ছাড় যন্ত্র
ঠিক হইয়া বও তরীর পর
প্রেমের বড়শি ফেলবি জলে খবরদার।
পাকাও এক রাগের সুতা
ছয় তারে করে একেস্তার।
ভাবের একটি টোম লাগাইয়া
গেঁথে দাও সুতায়।
নিচে সাড়া পেলে ভেসে উঠবে
আর ব্রক্ষ্মকোরা একস্তার।
নদীতে সদায় উঠে জল
সে করছে টলমল
রাগের ছড়ি, ছিপের বাড়ি খেলে বেটা
শুকনায় হবি তল।
কত রসিক জেলে জাল ফেলে
প্রাণ নিয়ে দিচ্ছে সাঁতার।।
আবার দেখে নদীর কূল
তোর লাগবে মহাভুল
টেপায় নিবে আধার কেটে
বেটা হবি নামাক্কুল।
ফকির লালনের হয় এমনি দশা রে
যেমন ভেদায় রুই করছে আহার।।

কাউসার বসির মাওলানা আর সোলেমান ভান্ডারীর কথার আগা-মাথা কিছুই বুঝে নাই। কিন্ত্তু গানটির অর্থ যেন সে বুঝতে পারছে।  নদীতে সদায় ওঠে জল সে করছে টলমল। সেটা কোন্ নদীর কথা বলছে সেটা সে ধরতে পারছে। কত রসিক জেলে জাল ফেলে প্রাণ নিয়ে দিচ্ছে সাঁতার। পু্রো বিষয়টি তার কাছে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। আর হাউসে কাউসার বলতে কি বুঝাতে চেয়েছে সোলেমান ভান্ডারী তাও সে ধরতে পারছে। কিন্ত্তু বসির মাওলানার কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারেনি