পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ৯ মে, ২০১৫

হাঁস-মুরগীর ছাও

করিমবক্স সবেমাত্র সকালের নাস্তা সেরে উঠোনে এসে বসেছেন। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে তিনি একটি মোড়া পেতে বসে চা খাচ্ছেন আর খবরের কাগজ পড়ছেন। একটি খবরের দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে। সম্পাদকীয় কলামে সম্পাদক বলছেনঃ আমরা কি খাচ্ছি? ট্যানারির বর্জ্য পদার্থ দ্বারা তৈরী পোল্ট্রি ফার্মের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে আমরা আমাদের পুষ্টির জন্য যে মুরগী খাচ্ছি তা বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে। সাথে প্রোটিন জাতীয় খাদ্য হিসেবে যে ডিম আমরা খাই তাও বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে। বিষাক্ততার কারণে আমরা নানা প্রকার রোগে আক্রান্ত হচ্ছি। এতে করে বাড়ছে বুদ্ধির স্বল্পতা। বিকশিত হচ্ছে না মেধা। সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ফার্মেসীর সংখ্যা।... খবরটা পড়ে তিনি অত্যন্ত চিন্তিত হলেন। আমাদের দেহের মুল অংশ তথা সারবস্তু হচ্ছে-শুক্রানু। সেটাও কি বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে না? বিয়ে শাদী করে সন্তান ধারণ করলে মায়ের জন্য প্রয়োজন হচ্ছে বেশি করে ক্যালসিয়াম ও প্রোটিনের । সেই প্রোটিনের সিংহভাগ মেটায় এই পোল্ট্রিফার্ম। তার উপর আছে ফর্মালিনের উপদ্রব। কি যে হচ্ছে? কোথায় যাচ্ছি আমরা? কোথায় হারিয়ে গেল আমাদের নৈতিক শিক্ষা? তিনি চিন্তিত মুখে কাপটি রাখলেন। তারপর চোখের চশমাটা খুলে তা আবার পরিস্কার করে পড়লেন। 
এরই ফাঁকে তার দৃষ্টি গেল উঠোনের দিকে। তিনি দেখলেন একটি মা মুরগী তার বাচ্চাদের নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খাবার শেখাচ্ছে। কখনো কখনো পায়ের নখের আঁচর দিয়ে ঘেটে ঘুটে খাদ্য বের করছে। আর তার বাচ্চারা সেটা অনুসরণ করে একই কায়দায় খাদ্য বের করছে। দৃশ্যটি তার কাছে বেশ উপভোগ্য মনে হলো। তিনি তাকিয়ে তাকিয়ে সেটা দেখতে লাগলেন। কিন্ত্তু তার চিন্তার রেশ কাটলো না। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে পুকুর পাড়ে গেলেন। দেখলেন সেখানে একটি হাঁস তার বাচ্চাদের নিয়ে মনের আনন্দে সাঁতার কাটছে। বাচ্চাগুলো মাকে অনুসরণ করে ডুব দিচ্ছে আবার উঠছে। মা হাঁসটি পুকুর পাড়ে উঠে শরীরটাকে ঝাঁকালেন। সমস্ত পানি হাঁসটির শরীর থেকে ছিটিয়ে পড়ছে। সেটাকে দেখে বাচ্চাগুলোও মাকে অনুসরণ করে একই কায়দায় শরীরটাকে ঝাঁকাচ্ছে। তারপর ময়লা কাদা ঘাঁটাঘাঁটি করছে। সেটা দেখে তিনি বেশ গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন। মনে হলো তিনি কিছু একটা পেয়েছেন। তিনি আর দেরী করলেন না। সেখান থেকে চলে আসলেন। তাকে হন্ত দন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখে মিতু জিগ্যেস করলোঃ

-কি হয়েছে তোমার? ওমন করছো কেন? 

-ও তুমি বুঝবে না। তোমাকে আল্লাহ সে জ্ঞান দেয়নি। যে জ্ঞান হাঁস-মুরগিকে আল্লাহ দিয়েছেন, তার কিছুটা যদি তোমাকে দিত তাহলে কিছুটা হলেও ছেলে-মেয়েগুলো অত্যন্ত মানুষ হতো?

- কি বললে তুমি? আল্লাহ অামাকে হাঁস-মুরগীর জ্ঞানও দেয়নি। সব জ্ঞান আল্লাহ তোমাকে দিয়ে তাই না?

স্ত্রীর প্রতি এ আচরণ তিনি কখনো করেন না। কিন্ত্তু তিনি আজ কেন করলেন কে জানে? কিছুটা শান্ত হয়ে তিনি স্ত্রীকে বললেনঃ

-চলো আমার সাথে।

-কোথায় যাবো?

-আরে আসোতে? আসলেই দেখতে পাবে। আসো আমার সাথে। 
তিনি মিতুর হাত ধরে টেনে সাথে নিয়ে চললেন। উঠোনে যেখানে মা মুরগীটা তার বাচ্চাদের নিয়ে কিভাবে খেতে হবে, কিভাবে ঘুরে বেড়ায় কি করে সেটা দেখালেন। এরপর নিয়ে গেলেন পুকুর পাড়ে। সেখানে তিনি যা দেখে ছিলেন, তাই মিতুকে দেখালেন। মিতুর বিরক্তির সীমা রইলো না। সে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে হাত ঝাটকা মেরে সেখান থেকে চলে এলেন। স্ত্রীর এ আচরণে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হলেন। তিনি ভেবে ছিলেন পুরো বিষয়টি তাকে দেখিয়ে যে শিক্ষাটা সকালে পেয়েছেন সেটা বুঝিয়ে বলবেন। কিন্ত্তু উল্টা মিতুই তাকে শিক্ষা দিল। তার চোখের কোণে একটু জল জমে গিয়েছে। সেটা গড়িয়ে পড়ার অাগেই মুছে ফেললেন। সারাদিন কারো সাথে কিছু বললেন না। বিছানায় শুয়ে রইলেন।

দুপুর বেলা ঘুম হতে উঠলেন। গোসল সেরে নামায পড়ে খেতে বসলেন। দেখলেন তার ছেলে-মেয়েরাও খেতে বসছে। সবাই এক সাথে খেতে বসছেন। খেতে খেতে তার মনে পড়লো সেই হাঁস-মুরগীর কথা। তিনি হারিয়ে গেলেন সেই হাঁস-মুরগীর ভীড়ে। তিনি দেখলেন তিনি যেন সেই মা মুরগীটার একটা বাচ্চা। মা মুরগীটা বলছে - " বাছারা, আল্লাহ পাক আমাদের খাবার যেখানে রেখেছেন সেখান থেকেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খুঁজে বের করে খেতে হবে। তোমার রিজিক আল্লাহ জমিনের মাঝেই রেখেছেন। কাজেই হতাশ হবার কিছু নেই। এরপর মা মুরগীটা তার দিকে তাকিয়ে বলছে, দ্যাখো বাছারা, মানব সন্তানেরা কতো বেকুব। তারা আমাদের কাছ থেকে এই শিক্ষাটা নেয় না। আমরা মানব সন্তানদের মতো খাবারে ভেজাল দেই না। পরিশ্রম লব্দ হালাল খাবার খাই।"  কিভাবে খাবার খুঁজে খেতে হয়, আমার দিকে তাকাও। আমি দেখিয়ে দিচ্ছি। এই বলে সে তা দেখিয়ে দিল। সেটা অনুসরণ করে তিনিও খাবার খেতে লাগলেন।

- কি ব্যাপার, তুমি ওমন করে খাচ্ছ কেন? 

- সেটা তুমি বুঝবে না। তোমার কাজ তুমি করো।
স্ত্রীর প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করে আবার তিনি আপন মনে খেতে লাগলেন। সেই ফাঁকে আবার হারিয়ে গেলেন মা হাঁসটির কাছে। মা হাঁসটি তাকে বলছে - "বাছা, দেখ তোমরা মানুষেরা কতো অসহায়। দুনিয়াতে নানান রংয়ে ঢংয়ে চলা ফেরা করো। স্রষ্টার নিয়ামত খাচ্ছ তার প্রতি শুকরিয়া আদায়তো করোই না উল্টা তারই বিরোধিতা করো। অথচ আখিরাতের জন্য একটি মুল্যবান একটি শিক্ষা তোমরা আমাদের কাছ থেকে নিতে পারে। দ্যাখো, আমরা সারাদিন কাদা-পানিতে ময়লা আবর্জনা ঘাটাঘাটি করি। পানিতে ভাসি। ডুবি। মাছ-পোকা মাকড় খাই। পুরোটাই দুনিয়ার মতোই। কিন্ত্তু আমরা যখন ঘরে ফিরি আমাদের গায়ে কিন্ত্তু একটুও ময়লা আবর্জনা থাকে না। ঝাড়া দিয়ে সব ফেলে দেই। আবার পরের দিনের জন্য আবার প্রস্তুত হই। আর তোমরা করো উল্টাটা। তোমরা সত্যিই স্বার্থপর।"

হটাৎ প্লেট ভেংগে যাওয়ার শব্দে সবাই তার দিকে তাকায়। সারা ঘরময় ভাত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মিতু এবং তার ছানা-পোনারা সব হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।  তিনি  অস্বাভাবিক আচরণ করছেন। তার এ আচরণের হেতু তারা খুঁজে পেল না। করিম বক্স কেবল শুনতে পেল তারা বলছেঃ "আম্মু, বাবা হাঁসের মতো ওমন করছে কেন? কেমন যে গা ঝাড়া দিচ্ছে.....