পৃষ্ঠাসমূহ

বৃহস্পতিবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৫

মনা পাগলার খোঁজে -শেষ পর্ব

(পুর্ব প্রকাশের পর)

তব কাননে ধীর গমণে কুসুম কলি ফোটাও চরণে
বিহঙ্গ গণে ললিত তানে প্রেম আলাপন করিবে সদা।

তব কাকনে তব মানে তুমি বা তোমার। কাকনে মানে বাগান, গালিচা। ধীর অর্থ অর্থ আস্তে আস্তে। অর্থাৎ স্লেথগতি। মন্থর গতি। গমণে অর্থ যাওয়া। ধীর গমণে অর্থ-মন্হর গতিতে যাওয়া। কুসুম কলি - কুসুম মানে ফুল। কলি অর্থ কিশোরী। সদ্য প্রসুত নয় এমন। অর্থাৎ নব যৌবন প্রাপ্ত কোন কিশোরী। ফোটাও চরণে। চরণ বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে। এখানে চরণ বলতে গুরুর পদতলে আশ্রয় লাভ করাকে বোঝানো হয়েছে। গুরু তার বিশ্ব বাগানে ধীরে ধীরে প্রেমিকগণকে আকৃষ্ট করার জন্য সদ্য যৌবনা প্রাপ্ত কিশোরীর মতো প্রেমিকগণকে তার চরণে সমর্পিত করেন। অর্থাৎ তার চরণে ঠাই দিয়ে থাকেন। চরণে ফোটা অর্থ গুরুর চরণ তলে আশ্রয় লাভ করা। 
বিহঙ্গ গণে  অর্থ বিহঙ্গ মানে পাখি। এখানে বিহঙ্গ  অর্থ হচ্ছে প্রাণরুপ পাখি। ললিত তানে  অর্থ সুমধুর কণ্ঠে ধ্বনি তোলা। প্রেম আলাপন করিবে সদা  মানে হলো সর্বদা গুরুর স্বরণে থাকা। গুরু তার প্রেমিককে অর্থাৎ আশেককে সর্বদাই তারই চিন্তা চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। গুরুর শরণ নিলে তাদের মধ্যে কথোপকথন হয় ধীরগতিতে। তাই প্রেমিক সেই আলাপন শোনার জন্য সর্বদা জাগ্রত থাকার চেষ্টা করেন। গুরুর সংযোগ হলে তাদের মধ্যে কথোপকথনকেই প্রেম আলাপন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

উদিত শশী কিরণরাশি দুরিবে ভাতি মেঘের কালা
তুমি যেখানে নাহি সেখানে সর্বস্ব তুমি কাহার ছায়া।

উদিত শশী  মানে উদিত অর্থ উরুয হওয়া। উর্ধ্বগামী হওয়া। প্রস্ফুটিত হওয়া। আলোকিত হওয়া। শশী মানে চাঁদ। যার অন্য অর্থ হয় চন্দ্র তথা মণি। যাকে হাকিকাতে নুরে মুহাম্মদী বলা হয়। নুরে মুহম্মদীর উদয় হওয়াকেই উদিত শশী বলা হয়েছে। সাধকের সাথে যখন সাধনার স্তরে গমণ করেন তখন তাকে বিভ্রান্ত করার জন্য যে ধর্মরাশি উদয় হয় তম্মধ্যে নারীমোহ হচ্ছে সবচেয়ে বড়ো বাঁধা। চন্দ্রকে জাগ্রত করতে হলে এ মোহ মায়া ত্যাগ করে তাকে সঞ্চয় করার মানসিকতা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। নয়তো মণি কখনো উর্ধ্বগামী হয় না। এজন্যই বলা হয় - আগে বিন্দু সাধন পরে পতন। এই বিন্দু যখন সাধনার  দ্বারা  স্বচ্ছ হয়ে যায় তখন সেই বিন্দুতেই সৃষ্টি হয় গুরুর পুত্র। জগত পিতার জগত পুত্র। তিনিই হন  নুরের মানুষ।  কিরণ রাশি  মানে হলো কিরণ মানে আলো। কিরণ রাশি মানে আলোকিত। দুরিবে ভাতি অর্থ দুর হয়ে যাবে সমস্ত কলুষতা, কালিমা। মেঘের কালা  মানে এখানে উপমা দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে আকাশ অন্ধাকারাচ্ছন্ন হয়ে যখন মেঘমালা পুঞ্জিভুত হয় তখন সমস্ত কিছু অন্ধাকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়। আবার যখন মেঘ সরে যায় তখন সমস্ত আকাশ স্বর্ণোজ্জ্বল আলোকে ঝলমল করতে থাকে।

মনা পাগলা যেভাবে গজলটির ব্যাখ্যা দিয়ে যাচ্ছে তাতে আমার কাছে তা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে আমি যেন সবকিছু দেখতে পাচ্ছি। আমি তম্ময় হয়ে শুনতে থাকলাম মনার সেই ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ। শুরুতে যেটাকে শ্রেফ একটা গান বলে মনে হয়েছিল তা আর এখন মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে হযরত খাজা শাহ্ পীর চিশতী (রহঃ) তাঁর ধ্যান জ্ঞান তার সাধনার ফসল রেখে গেছেন তার ভক্তবৃন্দের কাছে। চিশতী উদ্যান নামক পুস্তকটি কেবল একটা গজলের পুস্তকই না। এটা জ্ঞানীদের কাছে রেখে যাওয়া একটা সমুদ্র বিশেষ। যারা এর গভীরে প্রবেশ করে হাবুডুবু খাচ্ছেন কেবল তারাই তার জ্ঞানের গভীরতা পরিমাপ করতে পারবেন। হযরত খাজা শাহ্ পীর চিশতীকে বুঝতে হলে তার সহজ মাধ্যম হচ্ছে তার রচিত পুস্তক তথা কেতাবটি। এটিই তার নিবেদিত প্রাণ যা তাকে অমর করে রেখেছে। শত শত আশেক গণের হৃদমন্দিরে প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছে।

আমার দিকে তাকিয়ে মনা বললোঃ

-কিরে কি ভাবচ্ছিস?

-নাহ্ তেমন কিছু না। ভাবছিলাম আপনি যার গজলটির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দিচ্ছিলেন সেই মহা প্রাণের কথা।

-আরে পাগল, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ না। ভাব উদ্ধার বলতে পারিস।

-ভাব উদ্ধার বলতে তো তিনি যে ভাব নিয়ে বিরাজিত ছিলেন সেই ভাব নিজের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সেই ভাব নিজের মধ্যে বিরাজ না করলে সেটাকে কিভাবে আপনি তাঁর ভাব উদ্ধার করবেন? তাছাড়া আপনি যে ভাব নিজের মধ্যে নিয়ে তাঁর রচিত গজলের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন সেটাতো তার ভাব নাও হতে পারে?

আমার কথা শুনে মনা যেন কেমন থ মেরে গেল। সে কিছুক্ষণ আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার তীক্ষ্ম দৃষ্টি আমার মর্মভেদ করলো। আমিও মনার দিকে তাকিয়ে আছি। কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম জানি না। নীরবতা ভংগ করে মনা বললোঃ

পড় পড় আলেম ফাযেল হোয়া
কাদি আপনে আপ নু পড়হেয়ায়ে নই।

জা জা ওয়ার্দা মন্দর মসীতা
কাদি মন আপনে ভিচ ওয়ারিয়ায়ি নই।

আইওয়ায়েঁ রুয শয়তান নাল লাড়দাঁ
কারদী নফস আপনে নাল লাড়িয়ায়ে নই।

বুল্লে শাহ আসমানী উড়দিয়া ফারদা
যায়রা ঘর ব্যায়ঠা ওহনুঁ ফারিয়ায়ে নই।

[হযরত খাজা বুল্লে শাহ-এর কালাম] 

পড়ে পড়ে আলেম হয়েছো। ফাজেল হয়েছো। তুমি তোমাকে পড়ো নাই। প্রতিদিন মন্দির মসজিদে যাও। তোমার মন মন্দিরে যাও নাই। প্রতিদিন শয়তানের সাথে লড়াই করো। কখনো নিজের নফসের সাথে লড়াই করো নাই। তোর কথা শুনে আমার কেন যেন বুল্লে শাহর এই কালামের কথা মনে পড়লো। তাই বললাম। তবে তোর চিন্তা ভাবনার উন্নতি হয়েছে জেনে ভালো লাগলো। তুই বই পুস্তক পাঠ করে বিদ্বান হতে পারবি। বড়ো বড়ো ডিগ্রী নিতে পারবি। কিন্ত্তু তাকে তুই কখনো কিতাবে পুস্তকে পাবি না। তাকে পেতে হলে তোকে অবশ্যই তোর মন মন্দিরে ঢুকতে হবে। কেন শুনিস নি-

কেনো খুঁজে ফের দেবতা ঠাকুর মৃত পুঁথি কংকালে
হাসিছেন তিনি অমৃত হিয়ার নিভৃত অন্তরালে।
বন্ধু, বলিনি ঝুট।
এই খানে এসে লুটায়ে পড়ে সকল রাজ মুকুট।

নজরুলের বাণী আর বুল্লে শাহর বাণী অভিন্ন বাণী। তৌহিদ সাগরে যারা ডুবারু তাদের মধ্যে দুই নেই। তুই সেই সাগরে ডুব দে। ডুব দিয়ে তুলে নিয়ে আয় মণি মুক্তা। নজরুলের মতো করে-

থাকবো নাকো বদ্ধঘরে, দেখবো এবার জগৎটাকে
কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘুর্ণিপাকে।
কেমন করে বীর ডুবুরী সিন্ধু সেঁচে মুক্তা আনে

কিংবা ধর রবীন্দ্রনাথের কথা। আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি।

অামি যখন তন্ময় হয়ে মনা পাগলার কথা শুনছি, ঠিক তক্ষুণি টের পেলাম-আমার বাঁ দিকটা হটাৎ ব্যাথা করছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন বেত দিয়ে আঘাত করছে। ব্যাথার সেই স্থানটিতে হাত বুলাতে বুলাতে শুনতে পেলাম কে যেন চিৎকার দিয়ে বলছেঃ

-ঐ ব্যাটা কতক্ষণ ধইর‌্যা দেখতাছি বক্কর বক্কর করতাচ্ছস। ব্যাপারটা কি? মাল খাইছোস? ডোসটা কি কড়া হইয়্যা গেছে? ওস্তাদ হালায় মনে হয় গাঞ্জা খাইছে। মাতাটা উডাইতে পারতে আছে না। দিমুনি হালার হোগা দিয়া লাডিডা ঢুকাইয়্যা...

আমি তাকিয়ে দেখি কোথায় কি? আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইয়া মুছুয়া টাইপের একটা দাড়োয়ান। হাতে লাঠি। লাঠি দিয়ে আমাকে খোঁচা দিচ্ছে। আর খিস্তি খেউড় করছে। তাহলে যার সাথে এতক্ষণ কথা বললাম সেটা কে ছিল? সেটা কি আমার মনের ভুল? নাকি পাগলের প্রলাপ। আমার দিকে তাকিয়ে যে দাড়োয়ানটি তার ওস্তাদকে ডাকছিলো সেই লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে বললোঃ

-দেকতো তো ভদ্দ লোকের পোলা মনে অয়। ওয় পোলা, কবে থিক্ক্যা এই লাইনে আইছস? আ্যায়...নাম কি তর..

-ওস্তাদ অত কতা দিয়্যা কাম কি? হোগার মইধ্যে দুইড্ড্যা বারি দিয়া ছাইর‌্যা দেই...হালারপো ডলতে ডলতে বাইত যাইবো গা নে...

কথা বলা শেষ হতে না হতেই আমার পেছনে বেত দিয়ে দুইটা বারি দিল। ব্যাথার চোটে মুখ লাল হয়ে উঠলো। সেই ব্যাথা নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। হাঁটতে শুরু করেছি..আর কানে বাজছে...  

জা জা ওয়ার্দা মন্দর মসীতা
অর্থঃপ্রতিদিন তুমি মন্দির মসজিদে যাও 

কাদি মন আপনে ভিচ ওয়ারিয়ায়ি নই 
অর্থঃকিন্ত্তু তুমি তোমার মন মন্দিরে যাও নাই। 

আইওয়ায়েঁ রুয শয়তান নাল লাড়দাঁ 
অর্থঃ প্রতিদিন তুমি শয়তানের সাথে লড়াই করো

কারদী নফস আপনে নাল লাড়িয়ায়ে নই
অর্থঃকখনো তুমি তোমার নফসের সাথে লড়াই করো নাই


বিঃদ্রঃ মনা পাগলা বস্তুজগতের কেউ নয়। এটি অবচেতন মনের কল্পনা। পুরো গল্পটিই কাল্পনিক। বাস্তবতার সাথে মিল অনেকটা কাকতালীয়। তাই দয়া করে কেউ এর মধ্যে দর্শন খোঁজার চেষ্টা করবেন না। দর্শন যার যার বিশ্বাস ভক্তির ব্যাপার। জোড় করে কিংবা প্ররোচিত করে ধর্ম দর্শন পরিচালিত হয় না। কারণ মনের ঐকান্তিক চেতনার ফসল হলো ধর্ম বিশ্বাসের মুল ভিত্তি।