পৃষ্ঠাসমূহ

মঙ্গলবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৫

মনা পাগলার খোঁজে-পন্ঞ্চম পর্ব

(পুর্ব প্রকাশের পর)
ছান্দোগ্য উপনিষদে বর্ণিত সমস্ত ঘটনাসমুহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে উপনিষদ হতে কিছু কিছু বিষয় মুসলিম সাহিত্যে তথা সুফী সমাজে প্রচলিত হয়ে আছে। বিষয়টি অত্যন্ত রহস্যজনক। তাছাড়া বৌদ্ধ সহজিয়াদের ধ্যান-ধারণাও সুফীবাদের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করেছে। বৌদ্ধদের চর্যাপদ বিশ্লেষণ করলে এ বিষয়টি আরো প্রকট আকার ধারণ করে। তাছাড়া হিন্দুদের প্রভাব এ উপমহাদেশে বেশি থাকার সুবাদে মুসলিমরা যখন এদেশে ইসলাম প্রচার করতে আসেন তখন মুসলমানগণ হিন্দু-সাধু সন্ন্যাসীদের দ্বারাও প্রভাবিত হন। মুঘল শাসনামলে সম্রাট আকবর যে দ্বীন-এ-এলাহি নামক ধর্ম প্রচার করার অভিপ্রায় নিয়ে ছিলেন-তাতেই বুঝা যায় সে আমলে হিন্দু-মুসলিমরা সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য শাসক যন্ত্রের খড়গের নিচে ছিলেন। যা আমরা পরবর্তীতে মুজাদ্দেদ-আল-ফেসানী(রহঃ) এর তুমুল আন্দোলনের মুখে পরাভুত হতে দেখি। মুজাদ্দেদ-আল-ফে'সানী (রহঃ) মুঘল শাসকের এ আদেশ সর্বোপরি প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ শাসক সম্রাট আকবর যে কলেমা মুসলমানদেরকে পড়ার জন্য আদেশ দিয়েছিলেন তা ছিলঃ "লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুল্লাহ ওয়া জালালউদ্দিন মুহাম্মদ আকবর খলিফাতুল্লাহ।" কিন্ত্তু মুজাদ্দেদ আল-ফেসানী (রহঃ) এ কলেমাকে বর্জন করার জন্য সব মুসলমানদের আহব্বান জানান। তীব্র আন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত তা ব্যর্থতায় পর্যভুষিত হয়। 

ভাবতে ভাবতে পথ চলছি। ফুটপাত ধরে হেঁটে চলছি। অনেকটা জীবনানন্দ দাসের কবিতার মতোঃ

হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে আরো দূর অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকার বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।

জীবনানন্দ দাসকে দুদন্ড শান্তি দিয়েছিল বনলতা সেন। সে এক রহস্যজনক চরিত্র। আমাকে দু'দন্ড প্রেরণার বাতি জ্বালিয়েছিল মনা পাগলা নামক এক অখ্যাত অজাত শ্রেণীর জাত পাগল। লোকে শুনলে হাসবে। তারাও আমাকে পাগল ভাববে। ভাববে বৈকি। অনেকেই ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন। হাটতে হাটতে ক্লান্ত হয়ে একটা টং দোকানে এসে থামলাম। পেট ভরে পানি খেলাম। তারপর শান্ত হয়ে চায়ের অর্ডার দিলাম। চা খেয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। সেটা টানতে টানতে আবার পথ চলা শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছিলাম শ্যামলীর সামনে। তারপর আবার হাঁটা। 

মনা একবার দুষ্টামী করে বলেছিলঃ 

-দ্যাখ আমরা যে কলেমা পাঠ করি, তার মধ্যে দুটি অংশ রয়েছে। সে দুটি অংশ কি, জানিস?

-নাহ। আমি বললাম।

-পুরো কলেমার প্রথম অংশঃ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এবং দ্বিতীয় অংশঃ মুহাম্মাদুর রাসুল আল্লাহ। প্রথম অংশ দ্বারা আল্লাহ পাকের শান-মান এবং সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করা হচ্ছে। লা অর্থ নেই তথা শুন্য। ইলাহা অর্থ উপাস্য। ইল্লা অর্থ ব্যতীত। আল্লাহ। নেই উপাস্য ব্যতীত আল্লাহ। তার মানে আল্লাহ ছাড়া কিছুরই অস্তিত্ব নেই। লা মৌজুদা ইল্লাল্লাহ। সর্বশ্বেরবাদ। প্যাইনথেইজম। 
দ্বিতীয় অংশঃ মুহাম্মাদুর রাসুল আল্লাহ। মুহাম্মদ আল্লাহর রাসুল। তথা আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ। কেউ যদি এ কলেমার দ্বিতীয় অংশ অস্বীকার করে তাহলে সে হিন্দুধর্মের "একমবেদ্বিতীয়মঃ" তথা এক ঈশ্বর ব্যতীত দ্বিতীয় কিছু্‌ই নেই - এ বাণীর অনুসারীদের পর্যায়ভুক্ত হয়ে যায়।হিন্দু ধর্মে পৌত্তলিকতাকে তামসিক জ্ঞান তথা অজ্ঞানদের বুঝানোর জন্য মুর্তির ধারণা বদ্ধমুল করে দেয়া হয়েছে। যেমন আমরা ছোট ছেলে-মেয়েদেরকে বুঝানোর জন্য উপমাকে টেনে আনি তদ্রুপ অজ্ঞান হিন্দুধর্মানুসারীদেরকে দেব-দেবীর মাহাত্ম্য বুঝানোর জন্য মুর্তির সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্ত্তু জ্ঞানীদের জন্য মুর্তির ধারণা অপ্রয়োজন। 

মনার এ চিন্তা-ধারা আমাকে পেয়ে বসেছিল ভালোভাবেই। আমি অনেক চিন্তা-ভাবনা করে দেখলাম যে ওহাবীদের সাথে এর কিছুটা হলেও সায়ুজ্য আছে। কারণ তারা মহানবীকে মানতে চায় না। কিন্ত্তু ছুন্নী আলেমগণ দুটো অংশই মানে। তারা কলেমাকে সর্বতোভাবে গুরুত্ব দেয়। মোল্লা-পুরোহিতরা যে ধর্মের মুল অংশ মেনে নিজের ধন্য মনে করছে আর দ্বিতীয় অংশকে অস্বীকার করছে তারাও ভুলে গেছে যে, স্বয়ং আল্লাহপাক বলছেনঃ "হুয়াল্লাজি বা'ছাফিল উম্মিইনা রাছুলাম মিনহুম ইয়াত্ লু আলায়হিম আইয়াতিহী ওয়া ইউ জাক্কিহুম ওয়া ইউয়াল্লিমুহুমুল কিতাবা ওয়াল--হিকমাতা ওয়া ইনকানু মিন কাবলূ লাফি দালালিম মুবিন [সুরা-জুমু'আ আয়াত-২]"। অর্থঃ তিনি তাদের অর্ন্তগত নিরক্ষরগণের মধ্য হতে এক রছুল প্রেরণ করেছেন, যে তাদের সম্মুখে তাঁর নির্দেশনাবলী পাঠ করে ও তাঁদের নির্মল করে এবং তাদেরকে গ্রন্থ ও আধ্যাত্মবিজ্ঞান (মারেফাত) শিক্ষা প্রদান করে। এবং নিশ্চয়ই ইতিপুর্বে তারা প্রকাশ্য ভ্রান্তির মধ্যে ছিল।" উক্ত বাণী হতে আমরা  এই শিক্ষা নিতে পারি যে, রাসুল মানুষের আত্মিক বিশুদ্ধতা আনয়নের জন্য গ্রন্থ অর্থাৎ ধর্মবিধি (শরীয়ত) ও আধ্যাত্ম বিজ্ঞান বা ধর্মের নিগুঢ় তত্ত্ব (মারেফাত) উভয়ই শিক্ষা দিতেন। রছুল করিম (সাঃ) নিজেই বলেছেনঃ অাশ শারিয়াতু আক্কওয়ালী.............আল মারিফাতু আসরার।" অর্থাৎ শরিয়ত আমার বাক্যসমুহ এবং মারেফাত আমার নিগুঢ় তত্ত্ব। হেকমত বা আধ্যাত্ম বিজ্ঞানের মধ্যে আল্লাহ পরিচিতির বিষ্ময়কর রহস্য নিহিত রয়েছে।
(চলবে)