পৃষ্ঠাসমূহ

বুধবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৫

শ্বেতার ডায়রী-পর্ব ষষ্ঠ

(পন্ঞ্চম পর্বের পর)

আমি যে বইটি তুলে নিলাম সেটা ছিল সুলতানুল হিন্দ শাহেন শাহে আওলিয়া হযরত খাজা গরীব নেওয়াজ (রহঃ) কর্তৃক লিখিত কিছু মকতুবাদ। যা তিনি লিখেছিলেন তাঁর প্রিয় মুরিদ এবং খলিফা হযরত খাজা কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী (রহঃ)-কে উদ্দেশ্য করে। সেই মকতুবাদের প্রথমটি হচ্ছেঃ

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।
মেরে দেলী মোহেব্ব । মেরে কালবী দোস্ত। মেরে ভাই খাজা কুতুবউদ্দিন দেহলবী - আল্লাহ তায়ালা আপনাকে দোজাহানের ছায়াদাত বখশেষ করুন।

বান্দা মিছকিন মঈনউদ্দিনের ছালাম জানিবা। পর সমাচার এই যে, আছরারে এলাহী (খোদাতত্ত্ব) সমন্ধে যাহা কিছু লিখিতেছি তাহা স্বীয় সত্যিকার মুরিদগণকে এবং সত্যপথের অনুসন্ধানকারীগণকে বেশ ভালভাবে বুঝাইয়া দিবা। তাহারা যেন ভুল পথে না যায়।

আজীজে মান ! যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালাকে চিনিতে সক্ষম হইয়াছে সে ব্যক্তি কখনও কোন ছোওয়াল, খায়েশ বা আরজু করিবে না। যে ব্যক্তি এ পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালাকে জানিতে সক্ষম হয় নাই, সে ব্যক্তি ইহার ভেদ উপলব্দি করিতে পারিবে না। দ্বিতীয়তঃ হেরেছ ও হাওয়া সম্পুর্ণরুপে দুরীভুত কর। যে ব্যক্তি স্বীয় হেরেছ ও হাওয়াকে দুরীভুত করিতে সফলকাম হইয়াছে সে ব্যক্তি মন্ঞ্জিলে মকসুদে পৌছিঁয়াছে। এইরুপ ব্যক্তিগণের উদ্দেশ্যে আল্লাহ তায়ালা কোরআন মজিদে এরশাদ ফরমাইয়াছেন - "যে ব্যক্তি স্বীয় নফছকে যাবতীয় খাহেশাত হইতে নির্লিপ্ত করিয়াছে-সে তাহার স্থান বেহেস্তে করিয়া লইয়াছে "। যাহার দিলকে আল্লাহ তায়ালা স্বীয় তরফ হইতে বিমুখ করিয়াছেন তাহাকে খাহেশে শাহওয়াতের নর্দমায় চির নিমজ্জিত করিয়াছেন। ছুলতানুল আরেফিন খাজা বায়েজীদ বোস্তামী (রঃ) বর্ণনা করিয়াছেন যে তিনি একদা রজনীতে স্বপ্নযোগে আল্লাহ তায়ালার দীদার লাভ করিয়াছিলেন। আল্লাহ তায়ালা তখন জিগ্যাসা করিয়াছিলেন " আয় বায়েজীদ ! তুমি কি চাও ? বায়েজীদ তখন উত্তর করিয়াছিলেন, "যাহা তুমি চাও হে খোদা।" তখন আল্লাহ তায়ালা বায়েজীদের কথায় সন্ত্তুষ্ট হইয়া বলিলেন, আচ্ছা বায়েজীদ ! যেরুপভাবে তুমি আমার হইয়া গিয়াছ, আমিও তদ্রুপ তোমার হইয়া গেলাম।
যদি তাছাওয়াফের মহাজ্ঞানে জ্ঞানী হইতে চাও, তবে যাবতীয় বাহ্যিক সুখ-সম্পদের আশা পরিত্যাগ কর। সেই মহাসম্পদশালী চিরশান্তি ও আরাম প্রদাতা পরমসৃষ্টিকর্তার মোহব্বত লাভ করিবার উদ্দেশ্যে একাগ্রচিত্ত হইয়া অবিশ্রান্ত কোশেশ কর। যদি তুমি ইহা প্রতিপালন করিতে সমর্থ হও, তবে জানিও যে, তুমি তাছাওয়াফ বিদ্যায় আলেম হইয়াছ (সংক্ষিপ্ত)।

আমি যখন গভীর মনোযোগ সহকারে আমার মনের বাড়ীতে মকতুবাদে খাজা পড়ছিলাম তখন হটাৎ একটা বিকট ধাক্কায় আমার মনোযোগে বিঘ্ন ঘটলো। আমি তাকিয়ে দেখলাম - পুলিশের ভ্যানটি একটি কাভার্ড ভ্যানকে সাইট দিতে গিয়ে একেবারে ফুটপাতের সাথে লেগে একধরণের ঘ্যষ ঘ্যষ শব্দ করে হার্ডব্রেক কষলো। তারপর ভ্যান হতে নেমে কাভার্ডভ্যান চালকের লাইসেন্স চাইলো এবং সেই ড্রাইভারের সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ পর আবারো গাড়ী ছেড়ে দিল। আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখতে চাইলাম-কোথায় আসছি? দেখলাম হাইকোর্ট মাজারের কাছ দিয়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটির দিকে যাচ্ছে। গাড়িটি যখন যাচ্ছে তখন হাইকোর্ট মাজারের সদর গেইটটি দেখতে পেলাম।

আমার তখনই একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। সেইটা হলো কিছুক্ষণ আগে যে সুলতানুল হিন্দ খাজা গরীর নেওয়াজের মকতুবাদ পড়ছিলাম, সেই খাজা গরীব নেওয়াজের দ্বিতীয় পুত্র যে, এ মাজারে শুয়ে আছে, সেটা কি সবাই জানে? তারা কি জানে - তার প্রকৃত নাম কি? কেন তাকে শরফ উদ্দিন চিশতী (রহঃ) বলা হয়? তিনি সুলতানুল হিন্দ হযরত খাজা গরীব উন নেওয়াজ (রহঃ) এর দ্বিতীয় স্ত্রী হযরত ইসমত (রহঃ) -এর ঔরসে ৬২৮ হিজরী মোতাবেক ১২৩০ খ্রীস্টাব্দে আজমীরে জন্মগ্রহণ করেন। ওলী-এ-বাংলার পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল হযরত খাজা হুশামউদ্দিন আবু সালেহ চিশতী (রহঃ) এবং তিনি হযরত খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়া (রহঃ) এর হস্তে মুরিদ হন। তিনি হযরত খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়া হতে অশেষ ফয়েজ বরকত লাভ করেন এবং হযরত শাহ্ জালাল (রহঃ)-এর সাথে বঙ্গে আসেন। সেই সময় তিনি তাঁর প্রকৃত পরিচয় গোপন করেছিলেন। পরবর্তীতে যখন তার প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ পেয়ে যায়-তখন হযরত খাজা শাহ্ জালাল (রহঃ) তাকে "শরফ উদ্দিন" নামে ভুষিত করেন। যার আরবী অর্থ হয়- পাল্টানো বা বদলানো। তিনি হযরত শাহ্ জালাল (রহঃ)-এর সাথে দুই বছর অবস্থান করেন। পরবর্তীতে হযরত শাহ্ জালাল (রহঃ)-এর আদেশক্রমে তিনি বর্তমান হাইকোর্ট যা রমনা গ্রাম নামে পরিচিত ছিল, সেইখানে তার আস্তানা গাড়েন এবং ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। এই মহান অলী যিনি ওলী-এ-বাংলা নামে পরিচিত ছিলেন তিনি হিজরী ৭৩৮ মোতাবেক ১৩৪০ খ্রীষ্টাব্দে ১১০ বৎসর বয়সে আল্লাহ পাকের সান্নিধ্যে গমণ করেন (ইন্নানিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)।

আমি আবার চেষ্টা করলাম সেই মকতুবাদটি পড়ার জন্য। মনের বাড়ীতে যাবার চেষ্টা করলাম। কিন্ত্তু পারলাম কোথায়? গাড়ীটি থামলো শাহবাগের মোড়ের দিকে পুলিশ ক্যাম্প-এর সামনে। আকাশ ততক্ষণে পরিস্কার হতে শুরু করেছে। আমাকে নামানো হলো। সাত্তার নামক পুলিশটি আমাকে ইশারা দিল তাকে অনুসরণ করার জন্য। আমি তার পিছু নিলাম।
(চলবে)