পৃষ্ঠাসমূহ

বৃহস্পতিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৫

শ্বেতার ডায়রী-দ্বিতীয় পর্ব

(প্রথম পর্বের পর)
ডায়রীটা হাতে পাওয়ার পর পুলিশটা সেটা উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখছিল। কি লেখা আছে সেই ডায়রীতে। ডায়রীটা আহামরি কিছু নয়। দেখতেও খুব যে ভালো তাও নয়। কিন্ত্তু সেই ডায়রীতে জড়িয়ে আছে আমার আর শ্বেতার স্মৃতিবিজড়িতজড়িত বেশ কিছু দিনলিপি। আমার ভালোলাগা মন্দলাগা সমস্ত ঘটনাই শ্বেতা তুলে ধরেছিল। আমি জানতাম না। শ্বেতার ডায়রি লেখার অভ্যাস আছে। পুলিশটা ব্যাঙ্গাত্মক ভাষা নিয়ে পড়া শুরু করলোঃ

তারিখঃ পহেলা জানুয়ারী ২০১৪
বারঃ বৃহসপতিবার

আজকে একটা মজার ঘটনা ঘটেছে। আমি ও আমার বান্ধবীরা সবাই এক সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। সেই সময় আমার চোখ যায় দোতালার বারান্দায়। দেখি একটি সুদর্শন দাঁড়িয়ে আছে। কথা বলছে বেশ ধীরে সুস্থে। কি বলছে কে জানে? তার বন্ধুরা বেশ আগ্রহ নিয়ে তার কথা শুনছে। মিলা আমাকে আড়চোখে দেখছিল। আমি খেয়ালই করিনি। আমি কি দেখছি, তা দেখার জন্য সেও সেই দিকে তাকিয়ে রইল। দেখলো সেই সুদর্শনকে। মিলা আমার থুতনিতে হাত দিয়ে বললোঃ
 
কার মুখ? —আমলকী শাখার পিছনে
শিঙের মত বাঁকা নীল চাঁদ একদিন দেখেছিলো তাহা;
এ-ধূসর পান্ডুলিপি একদিন দেখেছিলো, আহা,
সে-মুখ ধূসরতম আজ এই পৃথিবীর মনে।

তবু এই পৃথিবীর সব আলো একদিন নিভে গেলে পরে,
পৃথিবীর সব গল্প একদিন ফুরাবে যখন,
মানুষ র'বে না আর, র'বে শুধু মানুষের স্বপ্ন তখনঃ
সেই মুখ আর আমি র'বো সেই স্বপ্নের ভিতরে। 
-জীবনানন্দ দাশ

কবিতাটি আবৃত্তি করেই মিলা হাসতে হাসতে বললো-ওর নাম সাজিদ। আর ওর পাশে দাঁড়ানো ঐ যে ছেলেটিকে দেখছিস? ওর নাম মাহিন। সেই প্রথমই আমি তোমার নাম জানতে পারি। তখনো তোমাকে বলিনি যে - আমি তোমার প্রেমে পড়ে গেছি। যাকে লাভ এট ফাস্ট সাইট...

ঘটনাটা পড়ে পুলিশটা আমার দিকে আড়চোখে তাকালো। দেখলো আমি সুদর্শন কি-না? কিন্ত্তু আমি জানি আমি সুদর্শন নই। সিগারেটে পোড়া কালো দুটি ঠোট। লম্বাটে ধরণের মুখ। নাকটাও বেশ সুঁচালো। প্রশস্ত ললাট। কেশগুলো হাল্কা-পাতলা। রেশমের মতো। এ সবই শ্বেতার বর্ণনা। কাজেই শ্বেতার কাছে আমাকে ভালো লাগতে পারে। কিন্ত্তু নির্দয় ঐ পুলিশটার কাছে নয়। পুলিশটা আবারো পাতা উল্টিয়ে পড়া শুরু করেছেঃ

তারিখঃ ১৩/০১/২০১৪ইং
বারঃ সোমবার

আজকে ক্লাসে কুদ্দুস স্যার আমাদের হৈমন্তী পড়াচ্ছিল। স্যারের পড়ার ধরণ বেশ। স্মার্ট উচ্চারণ। কোন জড়তা নেই। গলার স্বর বেশ ভালো। এত সুন্দর করে কেউ পড়াতে পারে-আমার জানা ছিল না। আমরা মন্ত্র-মুগ্ধ হয়ে স্যারের পড়া শুনছিলাম। কিন্ত্তু দেখলাম সাজিদ লাষ্ট বেন্ঞ্চে মাথা নুয়িয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। আমার ইচ্ছে করছিল ওর গালে কষে একটা চড় বসিয়ে দেই। কিন্ত্তু আমারতো সেই অধিকার নেই।

-কিরে পড়া বাদ দিয়ে খালি ঘুমাস না-কি? 

পুলিশটা আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে জিগ্যাসা করছিল আর মিটি মিটি হাসছিল। দেখে আমার এমন রাগ লাগছিল যে বলে বোঝাতে পারবো না। আমি পুলিশের গাড়ির বেন্ঞ্চিতে কুঁজো হয়ে বসে আছি। সামনের দিকে ঝুঁকে বসে থাকায় হাত দুটো সামনের দিকে ছিল। আমার পাশেই আরো দু'জন পুলিশ আছে। দুজনই হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে। আমি মনে মনে বললামঃ এই সময় যদি কোন দুর্ধর্ষ খুনি কেউ আসে কিংবা কোন দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে এই দু,জন কিভাবে সামাল দেবে? ভাগ্যিস আমি দুর্ধর্ষ কেউ নই। তাদের সৌভাগ্য বলতে হবে। আমি আবার তাকালাম সেই পুলিশটার দিকে। দেখলাম, সে ডায়রী পড়া বাদ দিয়ে একটা সিগারেট ধরালো। তারপর আবার পড়া শুরু করলোঃ

তারিখঃ ১৫/০১/২০১৪ ইং
বারঃ বুধবার

তোমার কিসের এতো অভিমান? কেন তুমি আমাকে এত কষ্ট দাও...বলোতো....

-কিরে... কি করছিলি...বলতো? খামাখা মেয়েটাকে কষ্ট দিছস...

আমার বিরক্তের সীমা রইল না। কি যে করবো? বুঝতে পারছি না...এই নাছোড়বান্দা পুলিশটাতো দেখি আমাকে জ্বালিয়ে মারবে...ডায়রীটার মাঝখান হতে একটা করে পেইজ বের করে আর ব্যাঙ্গাত্মক ভাষায় জোরে জোরে শব্দ করে পড়ে। সিগারেটে টান দেয় আর ফুঁস করে ধোঁয়া ছাড়ে। কি যে করি...আমি আলগোছে আমার মাথার চুলগুলো দু'হাত দিয়ে ওঠানামা করছি...হটাৎ মনে হলো..আমার এই মুহুর্তে কোন সুখের স্মৃতিতে হারিয়ে যাওয়া উচিত। আমি চোখ বুঁজে মনে মনে হাতড়ে বেড়াচ্ছি আমার স্মৃতির জানালায়। দেখি সেখান থেকে কোন সুখ স্মৃতি খুঁজে পাই কি-না?
(চলবে)