পৃষ্ঠাসমূহ

বুধবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৫

শ্বেতার ডায়রী-প্রথম পর্ব

মনটা বিশেষ ভালো নেই। শীতের আবহাওয়া জানান দিচ্ছে - দেহ মনে পরিবর্তন আনার জন্য। আমার দেহ ও মন সেই প্রকৃতির অংশ হিসেবে তার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। মাথার কোণে কেমন যেন ভোঁতা ধরণের ব্যাথা হচ্ছে। শিরা উপশিরাগুলো ব্যাথার চোটে ফেটে যেতে চাইছে। আমি মাথার কোণে ঠিক সেই ব্যাথার স্থানে আমার বৃদ্ধা অঙ্গুলি দ্বারা চেপে ধরছি। কিন্ত্তু ব্যাথা কমার কোন লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না। ভাবলাম বাইরে গিয়ে এককাপ আদা চা খেলে হয়তো ব্যাথাটা কমতে পারে? রুম থেকে বের হলাম।

বাইরের আবহাওয়াটা দারুণ। হাল্কা শীতের আমেজ আর বাহারী রংয়ের পোষাকের আদলে বদলে গেছে মানুষজন। সবাই কেমন যেন স্মার্টভাবে চলাফেরা করছে। অামি যে রাস্তাটাতে দাঁড়িয়ে আছি তার পাশেই নিয়ন লাইটের আলো জ্বলছে। লাইটের হলদে আলোয় চলাফেরারত মানব-মানবীকে কেমন যেন বদলে যেতে দেখছি। মনে হচ্ছে অন্যজগতের কোন বাসিন্দা। হাল্কা কুয়াশায় ঢেকে আছে ঢাকার রাজপথ। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। এতো রাতে চা পাবো কি-না কে জানে? যদিও ঢাকায় সাড়ে দশটা মানে সন্ধ্যা হওয়া। কিন্ত্তু শীতের কারণে অনেকেই বাড়ী তাড়াতাড়ি চলে যায়। অযথা কেউ দাঁড়িয়ে আড্ডা মারে না। আমি আশে পাশে তাকিয়ে দেখি কোন চায়ের দোকান খোলা আছে কি-না? 

ভাগ্য ভালো বলতে হবে। মোবারক মামার চায়ের দোকানটা খোলা আছে। আমি যে স্থানে থাকি সেখানটায় ছেলে-বুড়ো সকলেই মোবারক মামাকে ভালোই চেনে। তার চায়ের আদর সর্বত্রই। চায়ের কারণেই লোকটি অত্র এলাকায় বেশ জনপ্রিয়। সে তার দোকানে একটি সাইনবোর্ডও লাগিয়েছে। মোবারক টি স্টল। সেই টি স্টলটিতে বিভিন্ন ধরনের চায়ের লিষ্ট ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। হেন চা নেই যা মোবারক মামা বানাতে পারে না। গোলমরিচের চা, আদা চা, লেবু চা, তুলসিপাতার চা, পদিনা পাতার চা..আর দুধ চাতো আছেই। সেই দুধের মধ্যেও ভাগ করেছে। গুড়া দুধের চা..গরুর দুধের চা...কনডেন্সমিল্ক এ চা..ইত্যাদি। সব সময় পান মুখে আছেই। কাষ্টমার দেখলেই মোবারক মামা তার স্বভাবসুলভ লাল দাঁত বের করে হেসে জিগ্যেস করে- মামা কি চা দিমু?

আমাকে দেখেই মোবারক মামা তার স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে জিগ্যাসা করলোঃ

-মামা, এই রাইতে?

-বাহির হইলাম আর কি? মাথাটা ভীষণ যন্ত্রণা করছে..

-বহেন মামা...গরম গরম আদা চা কইর‌্যা দিতাছি..চুমুক দেওনের সাথে সাথেই দেখবেন ব্যাতা নাই হইয়্যা গেছে গা..টেরও পাইবেন না

কিন্ত্তু মোবারকের চায়ে চুমুক দেয়ার পরও ব্যাথা কমার কোন লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না। ব্যাথাটা কেমন যেন বাড়ছে..আবার কমছে...

-কি মামা? ব্যতা কমছে...কইলাম না আমার চা চুমুক দেওনের লগে লগে ব্যাতা বাপ বাপ কইর‌্যা পলাইয়্যা যাইবো গা...

-না মামা। ব্যাথা যায় নাই। ব্যাথা আছে...

-কন কি মামা...আমার চায়ে আপনের মাথা ব্যাথা কমতাছে না....
মোবারক বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লো। আমার ব্যাথায় সে বেশ কাতর। অথচ আমি সেই কাতর যন্ত্রণাটা নিয়ে ঘুরছি। আমার যন্ত্রণা বুঝতে পেরে মোবারক মামা বললোঃ

-মামা আমার মনে হইতাছে আপনের এই ব্যাথাটা খুব খারাপ ধরণের ব্যাতা। একটা ডাক্তার দেহান।

-তা দেখাবো। তবে এই সময় ব্যাথা কমার জন্য ঔষধ আনার জন্য কোন ডিসপেন্সারী খোলা পাবো?

-কি যে কন না মামা? আরে আপনে ডাক্তারের দোকান খোলা না পাইলে সোজা মেডিকেলের সামনে ইর্মাজেন্সীতে চইল্যা যাইবেন গা। হেইহানে সারা রাইত ওষুধ বিক্রি অয়।

-কথাটা মন্দ বলো নি। কিন্ত্তু অত জরুরী না। সেইরকম মাথা ব্যাথা না..

আমি মোবারক মামার দোকান হতে একটা সিগারেট নিয়ে সেটা ধরিয়ে টানতে টানতে আবার হাঁটা শুরু করলাম। আশ্চর্য্য মাথার যন্ত্রণাটা কম মনে হচ্ছে। ভাবছি সারারাত রাস্তায় হেঁটে কাটিয়ে দিলে কেমন হয়? মাথার যন্ত্রণাটাও কমবে আবার নতুন একটা অভিজ্ঞতাও হবে..

অামি হাঁটছি আনমনে। অনেকটা টালমাটাল ভংগীতে। আমার হাঁটার ধরণে কি-না জানি না ..নাকি অন্য কোন কারণে টহলরত পুলিশ আমাকে দেখে ডাকলোঃ

-এই যে ভাই...এই দিকে আসেন?
হাত দিয়ে ইশারা করে ডাকছে। আমি চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম...আমাকে ডাকছে না-কি অন্য কাউকে ডাকছে..কাউকেই ডাকছে বলে মনে হলো না। অগ্যতা আমি নিজেই সেই ডাকে সাড়া দিয়ে পুলিশের কাছে গেলাম। আমাকে দেখেই সেই পুলিশটা খ্যাক খ্যাকে গলায় বললোঃ

-কই জান...কি করেন..আর এতো রাইতে এই শীতের মধ্যে রাস্তায় কি? চামড়া খোঁজতে বাইর হইছেন?

অনেকগুলো প্রশ্ন একসাথে করায় আমি কোনটার উত্তর দেব ভাবছিলাম। আর সেই ভাবাটাই আমার কাল হলো। হেড়ে গলায় বেশ জোর দিয়ে পুলিশটা আমাকে বললোঃ

-কি রে ? তোরে কি জিগাইতাছি..কথা কানে যায় না? এই লাঠিটা দেখছস...এইডা তোর জায়গা দিয়া ভইর‌্যা দিলেই দেখবি ভর ভর কইর‌্যা কতা বাহির হইবো...

আমি কি বলবো? বেশ ভড়কে গেলাম। আমি আমতা আমতা করে বললামঃ

-মাথাটা ব্যাথা করছে। তাই ঔষধ কেনার জন্য বাহির হইছি...

-শীতের রাইতে তোর মাথা ব্যাথা করতাছে আর সেই ব্যাথার লিগা ওষুদ কিনতে বাইর হইছস? আমাগো ভোদাই পাইছস? সত্য কথা ক...ছিনতাই করতে বাইর হস নাইতো? নাকি গরম চামড়া খোঁজতে বাইর হইছস?

গরম চামড়া কি জিনিস, তা আমার বোধগম্য হলো না। সে গরম চামড়া দ্বারা কি ইশারা করতে চাইছে? আমি বেশ ভাবনায় পড়ে গেলাম...কথাটা নতুন শোনলাম...মানেটা কি? 

-উঠ। গাড়িতে ওঠ। 

এই কথা বলেই আমার কলার ধরে হড় হড় করে টানতে টানতে নিয়ে গেল। কলার ধরে ধাক্কা ধাক্কি করতে করতেই আমার কোমর হতে একটা ডায়রী মাটিতে পড়ে গেল। সেই ডায়রীটা হাতে নিয়ে পুলিশটা খুলে দেখলো, কি লেখা আছে সেই ডায়রীতে...কিন্ত্তু আমি অবাক হয়ে ভাবছি এই ডায়রীতো আমি সাথে আনিনি। তাহলে এই ডায়রীটা কোথ্থথেকে এলো...এটাতো আজ সকালে শ্বেতা আমাকে দিয়ে ছিল। শ্বেতা সেই ডায়রীতে আমাদের প্রেম-ভালোবাসার দিনলিপিগুলো  খুব গুছিয়ে লিখে রেখেছিল। 

(চলবে)