পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৫

মনা পাগলার খোঁজে - দশম পর্ব

(পুর্ব প্রকাশের পর)

আমি ভেবে পেলাম না। আমার চিন্তা-চেতনাগুলো কেমন যেন অনুভুতি শুন্য হয়ে যাচ্ছে। চিন্তার ক্ষেত্রগুলো কেমন যেন সংকুচিত হয়ে আসছে। কি করি আর কি ভাবি, কোন কিছুই ঠিক করতে পারছি না।তাই ঝিম মেরে রইলাম। আমার অবস্থা দেখে বোধ করি মনা কেমন যেন ভাবলেশহীন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। অনেকক্ষণ পর সে বললোঃ

-শোন বোকা। এই মহাবিশ্বের প্রতিটি ধুলি-কণা এমন কি মহাজগতের সমগ্র কিছুই তার মহান সত্তার অস্তিত্ব। তোর দেহের প্রতিটি লোমকুপ, অণুচক্রিকা, লোহিত কণিকা, শ্বেতকণিকা এমন কি মুলবস্ত্তু সবই কিছুই যেমন তোর অংশ-তদ্রুপ এই মহা জাগতিক প্রতিটি বস্তু কণা তারই অংশ। কাজেই তুই যে শেরেক করার কথা বললি, কোন্ অংশ দিয়ে কোনটি দিয়ে তার সাথে শেরেক তথা অংশীদার করবি? 

-যদি মহাবিশ্বের সবকিছুই তার অংশ হয়ে থাকে তাহলে তো আমিও স্বয়ং আল্লাহ পাক জাত সুবহানের উপাদানে তৈরী।

-অবশ্যই। এই যে তুই এখানে বসে আলো বাতাস নিচ্ছিস, কে দিচ্ছে? কোথা হতে কেমন করে তা তুই পাচ্ছিস? তোকে যদি তোর মহান প্রভু দয়া না করতো তাহলেতো তুই মৃত। তোর কোন অস্তিত্বই থাকতো না। তোর ভেতর তুই আছিস বলেইতো তুই বেঁচে আছিস।

-তাকে কি দেখা যায়? 

-কেন যাবে না? দেখার জন্য তো চোখ থাকা চাই। দৃষ্টির বাইরে দৃষ্টি সম্পুর্ণ ভিন্ন। দৃষ্টি মতিভ্রমের সৃষ্টি করে। কিন্ত্তু প্রকৃত দৃষ্টি তোকে কখনো বিভ্রান্ত করতে পারবে না। তুই আমার চোখের দিকে তাকা। কি দেখছিস? কাকে দেখছিস?

অামি মনার চোখের দিকে তাকিয়ে তার চোখের দৃষ্টির মধ্যে আমার প্রতিবিম্ব দেখতে পেলাম। দেখতে পেলাম আমি তার চোখের পুত্ততিতে যেভাবে আমি বসে আছি হুবহু সেইভাবেই আমাকে দেখলাম। আমি তাকে বললামঃ

-আমি আমাকে দেখছি। আমি আবার পাল্টা প্রশ্ন করলামঃ আপনি কাকে দেখছেন?

-আমি তোকে দেখছি। আমি তোর চোখের দৃষ্টির মধ্যে আমাকে দেখছি।

-এর মানে কি?

-খুবই সোজা। তুই আমাকে দেখছিস আমি তোকে দেখছি। তার মানে আমি ও তুমি। এই দুটোই সত্য। মুলে এক। পরম সত্ত্বাও এক। দুই দেখা আমি ছেড়ে দিয়েছি। দুই হচ্ছে জোড়া সংখ্যা যা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে।

আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে আবার বলা শুরু করলোঃ

-আমি ও তুমি হচ্ছে প্রেমিক-প্রেমিকা । যুগলবন্দী। আশেক - মাশুক। আশেক সব সময় তার মাশুকের দেখার জন্য পাগল প্রাণ থাকে। চায় মিলন ঘটাতে। মিলনের সফলতা আসে সৃষ্টির সুভাষিত উদ্ভাষিত আলোক ধারায়। স্রষ্টা কি নারী না পুরুষ? সেটা জানাও জরুরী। তোর স্রষ্টা যদি নারী হয় তাহলে তোকে হতে হবে পুরুষ। আর তোর স্রষ্টা যদি পুরুষ হয় তোকে হতে হবে নারী। এই নারী-পুরুষ জাগতিক কোন নারী-পুরুষ নয়। এই নারী-পুরুষ হচ্ছে সত্ত্বাগত ভাবধারা। যা নুরে মুহাম্মদীর মধ্যে সুপ্তাবস্থায় নিহিত থাকে। এই নুরে মুহাম্মদীর প্রাণ হচ্ছে স্বয়ং রবরুপে তার দয়া। তাই তিনি রব্বুল আলামিন। সমস্ত জগতের প্রতিপালক। যিনি প্রতিপালন করেন তিনি কি? তিনি হচ্ছেন উত্তম অভিভাবক। তার চেয়ে উত্তম কোন অভিভাবক জগতে তুই আর পাবি না। তিনি অন্য জগতের বাসিন্দা। তিনি যখন সেই জগত হতে এ জগতে আসেন তখন তার সম্মানে সকলে অবনত হয়ে যায়। যেটা কোরআনে বলা হয়েছেঃ "যখন আমি আদমকে স্বয়ং সম্পুর্ণ করবো তখন তোমরা তার সম্মানে সেজদায় অবনত হয়ে যেও।" তিনিই কেবল পারেন সেই অচেনা অজানা জগতের সাথে তোকে পরিচয় করিয়ে দিতে। এছাড়া আর কোন উপায়ই নেই। তার দয়া ছাড়া কিছুই হয় না। হবে না। সম্ভব নয়। 

-ঠিক বুঝলাম না।

-বোঝার কথা ও না। জাগতিক বিষয় চিন্তা কর। তোর প্রেমিকাকে দেখার জন্য তুই কি করিস? তাকে দেখার একটা প্রচেষ্টা সবসময় থাকে তাকে দেখার। কেন? দেখলে তোর প্রাণটা একটা স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে। তাই না? এখানে তুই হচ্ছিস প্রেমিক। তথা আশেক। এই আশেক তার মাশুকের দীদার লাভ করার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করে। ঠিক তদ্রুপ তোকেও সেই আশেক-মাশুকের খেলা খেলতে হবে। জগতে অনেক নামী দামী আধ্যাত্মিক সাধকগণ স্রষ্টাকে দেখেছেন তার মাশুক রুপে।
যেমনঃ

হে সুজনী গুলবদনি চন্দ্রাননী নয়নও বাঁকা
মুক্তাকেশী প্রাণ পিয়াসী চন্দ্র শশী চরণও ছায়া।।
তব কাননে ধীর গমণে কুসুম কলি ফোটাও চরণে 
বিহঙ্গ গগনে ললিত তানে প্রেম আলাপন করিবে সদা।।
উদিত শশী কিরণ রাশি দুরিবে ভাতি মেঘের কালা
তুমি যেখানে নাহি সেখানে সর্বস্ব তুমি কাহার ছায়া।।
উঠাও আবরণ দাও দরশন তোমার ও আমার রবে না চিনন
তুমি আসিলে রবো না আমি তোমার আমার হবে গো দেখা।। 
খন্ঞ্জন গমন মৃগয়ালোচন ও রুপ রাশি লুকিবে কোথা
প্রেমিকও সুজন এহেন ও রতন হারে কি কখন পাইলে দেখা।।
সর্বত্র তুমি কোথা লুকিবে আমাতে তোমার খোজ মিলিবে
তেরা শাহাপীর হবে না অস্থির তোমার আমার হবে গো দেখা।।
(হযরত খাজা শাহ্ পীর চিশতী কর্তৃক রচিত চিশতী উদ্যান হতে সংগৃহীত)

এখানে দ্যাখ, হে সুজনী অর্থ সুন্দর জন। স্ত্রী লিংগে প্রকাশিত ভাবধারা। গুলবদনি। গুল অর্থ ফুল আর বদনি অর্থ বদন মানে দেহ। তার মানে গুল বদনী বলতে ফুলের মতো দেহ যার। তার নয়ন চোখ বাঁকা। এখানে বাঁকা অর্থ বেকা-তেরা নয়। অর্থাৎ প্রচলিত অর্থে যাকে আমরা ট্যাগ্রা বলি সেরুপ কিছু নয়। এখানে বাকা অর্থ চিরস্থায়ী। মুক্তাকেশী অর্থ যার কেশ অর্থাৎ চুল মুক্তার মতো উদ্ভাষিত। প্রাণ পিয়াসী।  প্রাণ অর্থ চলৎ শক্তি। পিয়াসী। তথা আকষর্ণীয়। পিয়াস বলতে অামরা বুঝি তেষ্টা পাওয়া। তদ্রুপ প্রাণ পিয়াসী বলতে বুঝানো হয়েছেঃ যাকে দেখলে প্রাণের আকুলতা মিটে যায়। চন্দ্র শশী চরণও ছায়া। চন্দ্র-শশী বলতে বুঝানো হয়েছে-মণিকে। যা মহাদান স্রষ্টার পক্ষ থেকে। তার চরণের খেদমতে নিবেদিত প্রাণের আকুলতা নিয়ে পড়ে থাকাই স্বার্থকতা।
(চলবে)