পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৫

সারমাদ দারদী আজাব সিকাস্তা কারদি তুনে-পর্ব চার

( পূর্ব প্রকাশের পর)
রাতে ফিরতে ফিরতে অনেক দেরী হয়ে গেল। রুমে ঢুকেই আমার হটাৎ মনে পড়ে গেল - একটা মেইল পাঠানের কথা ছিল করিম সাহেবের কাছে। সেই মেইল পেলে করিম সাহেব সেটা দেখে একটা এসাইনমেন্ট তৈরী করবেন। এসাইনমেন্টটা অত্যন্ত জরুরী। কাল বোর্ড মিটিং আছে। আমার মাথা পুরোপুরি ঘুরতে লাগলো। কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না। ঘড়িতে চেয়ে দেখি রাত প্রায় একটা ছুঁই ছুঁই করছে। আমি দেরী না করে করিম সাহেবকে কল করলাম-

-হ্যালো করিম ভাই, আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। আসলে আমি এতো বিজি ছিলাম যে আপনাকে কল করবো সেটাও আমার মনে ছিল না?

-কি এমন বিজি ছিলেন আপনি? যে একটা কল করবেন সেই সময়টাও আপনার ছিলো না?

-ভাই আমার ছোট বোন হটাৎ অসুস্থ হওয়ায় তাকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে হয়েছিল।

- হুম। তো ভাই আমি এখন কি করতে পারি?

-ভাই, আপনি যদি সমস্ত ডকুমেন্টসগুলো জিপ করে মেইলে পাঠিয়ে দেন তাহলে আমি এসাইমেন্ট রেডি করে আপনাকে সকালের মধ্যেই আপনাকে হাতে হাতে দিয়ে দিতে পারবো? আই প্রমিজ...

-হা হা ... আপনি করবেন রেডি....

করিম ভাইয়ের কথা শুনে রাগে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে। কিন্ত্তু কিছুই করার নেই। দোষটাতো তারই। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটা করতেই ভুলে গিয়েছিলাম। সামান্য একটা মেইল করবো সেটাও মনে করতে পারছি না। সারাটা দিন শুধু শুধু সময় নষ্ট করলাম। আবার অনেকগুলো মিথ্যা কথার আশ্রয় নিতে হলো। এখন শুনতে হচ্ছে তার তাচ্ছিল্য পূর্ণ টিটকারী মারা কথা... কেন করিম ভাই কি জানে না আমি যে কাজটা করি সেটা সিরিয়াসলি করি...আর সেটা করি বলেই বস আমাকে তারচেয়েও অনেক বেশি পছন্দ করে...আমিই তাকে কতোবার বিপদ থেকে বাঁচিয়েছি..সে কি ভুলে গেছে..

-হ্যালো, কি ব্যাপার সোহেল সাহেব, আপনি কথা বলছেন না কেন?

-ভাই কি বলবো? আপনি যদি একটু কষ্ট করে পাঠিয়ে দিতেন তাহলে...

-শুনেন সোহেল সাহেব, আমি তো আপনাকে চিনি। আপনি খেয়ালী প্রকৃতির মানুষ।আপনার মেইল না পাওয়ায় আমি বসকে কল করেছিলাম। বস বলেছে মিটিংটা ক্যানসেল হয়ে গেছে। পার্টি এখন আসবে না। রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে তারা আসতে চাচ্ছে না। ডকুমেন্ট রেডি করে তাদের কাছে পাঠিয়ে দিতে বলেছে। প্রয়োজনে ব্যাংককে বস নিজে যেয়ে পার্টির সাথে ডিড করবে। বি সিওর। সো ডোন্ট ওরি এব্যাউন্ট ইস সাবজেক্ট। বসই আমাকে কল করে জানিয়ে দিয়েছে।

-তাই? সেটা আপনি আমাকে তো একটু জানাতে পারতেন? তাই না?

-অামিতো ভাবছি আপনাকে বুঝি বস জানিয়েছে। জরুরী হলে তো আমিই প্রয়োজনে আপনাকে কল করে জানিয়ে দিতাম। আপনার সাথে কথা বলতাম।

-ঠিক আছে। তো রাখি ভালো থাকবেন।

উফ! কি ভীষন বাঁচা বেঁচে গেলাম। না হলে এখন আবার কাজ নিয়ে বসতে হতো। যাক বাবা। বড্ডো বাঁচা বেঁচে গেছি। হে আল্লাহ তোমার কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া। মাথা থেকে একটা বোঝা নেমে যাওয়ায় অনেকটা হাল্কা লাগছে। ফ্রেস হয়ে নিলাম। একটা সিগারেট ধরালাম। পায়ের উপর পা তুলে আয়েশের ভংগিতে শুয়ে শুয়ে সিগারেট টানছি আর সেই মুহুর্তেই মনে পড়লো-
খন্ঞ্জন গমণ মৃগয়ালোচন ওরুপ রাশি লুকিবে কোথা
প্রেমিকও সুজন এহেনও রতন হারে কি কখন পাইলে দেখা।।
অামি কি আমার ভেতর যে রব রয়েছে তাকে কি কখনো দেখতে পাবো? পাবো কি সেই মৃগয়ালোচনের দেখা? কি করে পাবো? আমারতো সেই ঠিকানা জানা নেই। জানা নেই অনেক কিছু। আমি কে? কি আমার পরিচয়? আমি কোথা ছিলাম? কোথা হতে এলাম? আবার কোথা যাবো?.নাহ!...আমার অনেক কিছুই জানা নেই। আমাকে জানতে হবে ... আর সক্রেটিসের মতো সবাইকে বলতে হবে .....know thyself  নিজেকে জানো। 

সিগারেটটা শেষ করেই ঘুমাতে গেলাম। লাইটটা নিভিয়ে দিয়েই একটা চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। কিন্ত্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না। শুধু মনের মধ্যে ভাসছে তার চেহারাটা। কি দীপ্তিময় ! মনে হয় যেন স্বর্গীয়দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ছে চারদিক থেকে। তার হাসিটা যেন আরো চমৎকার। মানুষ এতো সুন্দর হয় কিভাবে? কতো সুন্দরভাবে কথা বলে...আর তার মতো একটা মানুষকে মাহিন বুঝতেই পারছে না... ঘড়ির দিকে তাকাতেই আমার চোখ ছানাবড়া..আড়াইটা বেজে গেছে...সকালে আবার অফিসে যেতে হবে...নাহ আর কিছু্ই ভাববো না। আমাকে এখন ঘুমাতে হবে।

আমি এপাশ ওপাশ করছি। ঘুম যেন উধাও হয়ে গেছে। আমি উঠে একটা সিগারেট ধরালাম। আর মনে মনে বললাম আমাকে সকালে অফিসে যেতে হবে। অফিসে অনেক কাজ... তাড়াতাড়ি সিগারেট শেষ করেই চাদর মুড়ি দিলাম...ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। চোখ দুটি বুঁজে থাকলাম...আর ঠিক তখনোই দেখতে পেলাম শাহ্ সাহেব..মুচকি হেসে আমাকে বলছেনঃ

-কি মিয়া? ঘুম আসছে না?

-না হুজুর। চেষ্টা করছি কিন্ত্তু আসছে না..

-আসবে। চেষ্টা কর। দেখবা ঘুম চলে আসছে..

-না হুজুর। অনেক চেষ্টা করেও পারছি না..

তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন

-কলেমার অর্থ জানো মিয়া?

-জ্বি হুজুর। লাইলাহা ইল্লাল্রাহু মুহাম্মাদুর রাসুলাল্রাহ। অাল্লাহ ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই। হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ। তিনি আল্লাহর রাসুল।

আমার কথা শুনে তিনি হাসিতে ফেটে পড়লেন। বললেনঃ

ওহে মুসলমান রহিলি হয়রান
কলেমা পড়িয়া তুই হইলি বেইমান।
যে কলেমা পড়ে মানুষ মুসলমান বলে দাবী করে সেই কলেমারই তাৎপর্যই অধিকাংশ মানুষ জানে না। দ্যাখো মিয়া..

লা+ইলাহা+ইল্লা+আল্লাহ+হু+মুহাম্মদ+রাসুল+আল্লাহ -> কলেমাটি বিশ্লেষণ করলে ঐ শব্দগুলো পাওয়া যায়। আর প্রত্যেকটি শব্দের অর্থপূর্ণ তাৎপর্য রয়েছে। ঐ শব্দের তাৎপর্য না জেনে কেবল মৌখিক স্বীকৃতি দিলেই কি মুসলমান বলে দাবী করা যায়?
আলমে আরওয়াহর জগতে (রুহের জগতে) যখন আমরা ছিলাম তখন তো আমাদের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায় করে নেয়া হয়েছে এই বলে-আলাস্তবি রাব্বিকুম (অামি কি তোমাদের প্রতিপালক নই?)? আমরা বলেছিলাম-ক্কালু বালা (হ্যাঁ আপনিই আমাদের প্রভু)। আমরা তো না দেখে  সাক্ষ্য দেই নাই? তাই না? না কি দিয়েছি? অবশ্যই তার স্বাকার রুপের স্বরুপ উপস্থিতিতেই তাকে দেখেই স্বাক্ষ্য দিয়েছিলাম। সেই রুপ, সেই স্বাকারটি কোথায়? সেটা কি ভেবে দেখেছো?
কলেমা অর্থ বাক্য। তায়্যিবা অর্থ পবিত্র। আর শাহাদাত অর্থ - স্বাক্ষ্য দেয়া। না দেখে স্বাক্ষ্য হয় না। যদি না দেখে স্বা্ক্ষ্য দাও তো সেটা মিথ্যা স্বাক্ষ্যরুপে প্রতিপন্ন হবে। তাই না?
আবার দেখ যখন তুমি মারা যাবে তখন তোমাকে তিনটি প্রশ্ন করা হবে। মান রাব্বুকা? মান দিনুকা? মানহাজা রাজুলু? এই মানহাজা রাজুলু - এই ব্যক্তি কে? তখন তুমি কি বলবে? যদি তাকে না দেখে থাকো? সে যে জান্নাতের আশা করে ইবাদাত করেছিল সে যদি ঐ ব্যক্তিকে না দেখে থাকে তো চিনবে কিভাবে? তার কি জান্নাতে যাওয়া হবে? না সে গ্রেফতার হবে? তার ঈমান কি থাকবে নাকি সে বেঈমান হবে? একবার ভেবে দেখেছো? কলেমা শুধু মৌখিকভাবে স্বীকৃতি দিলেই হবে না। তা অবশ্যই তাহকীক করে দেখাতে হবে। তবেই না সে মুসলমান। কি বুঝলা মিয়া.....

তার কথা শুনে আবার ঘুম ভেংগে গেল। ঘুমিয়েছিলাম না আমার জাগৃতি ছিল কিছুই বুঝতে পারছি না। দূর থেকে ফযরের আযানের শব্দ কানে আসছে...আস সালাতু খাইরুম মিনান নাউম..

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সোয়া পাঁচটা বাজে। আমি আর ঘুমালাম না। বারান্দায় দাঁড়ালাম। চারিদিকে কেমন যেন একটা আবছা আলো-আঁধারের খেলা চলছে। পাখিরা সব একটা একটা করে উড়ে যাচ্ছে। আমার বারান্দা দিয়ে যতটুকু দেখা যায় তাকিয়ে থাকলাম। সিগারেট ধরালাম। সিগারেট টেনে টেনে বারান্দায় বসে রইলাম সকাল হবার আশায়। দুর আকাশে আস্তে আস্তে আঁধার কেটে ভোরের আবহাওয়া আসতে শুরু করেছে। আর আমার মনের পর্দা সরে যাচ্ছে -এই আকাশের মতোই দুর কোন অতিইন্দ্রীয়ালোকের দীপ্তিলোকের ছোঁয়ায়..........