পৃষ্ঠাসমূহ

শুক্রবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৫

হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা

শীতের প্রকোপ মনে হয় কিছুটা বেড়েছে। গাছ-পালাগুলো কেমন যেন থুম ধরে বসে আছে। নড়া-চড়া নেই। গাছের পাতাগুলোতে শিশির জমে জমে কেমন যেন ভারী হয়ে গ্যাছে। টিনের চালায় শিশির বিন্দু জমে জমে এখন নামতে শুরু করেছে। ফোঁটা ফোঁটা শিশিরবিন্দু কেমন যেন বৃষ্টির ঝড়া পানির মতো পড়ছে। চারদিকে কেমন যেন নিঃস্তব্ধতা। কিন্ত্তু সেই নিঃস্তদ্ধতা ভেদ করে শওকতের বাঁশি বেজে চলেছে একটানা। বাঁশির সুরের মধ্যে যেন একটা মমত্ববোধ থাকায় তা প্রাণের গভীরে আঘাত করছে। মনের ভেতর কেমন যেন একটা ছেদ পড়ছে। বিস্বাদ ও বিষন্নতা একসাথে ভর করছে।

-মামা কিছু খাইবেন? চা দিমু?

মোবারক মামার কথা শুনে চমকে উঠলাম। মোবারক মামার ফান্টুস চায়ের কদর দিনকে দিন বেড়ে চলেছে। আর এই শীতের মধ্যেতো বাম্পার ব্যবসা হয়। চায়ের মধ্যে বিশেষ কায়দায় মেশানো হয় ফেন্সি। চায়ের মধ্যে বেশি করে দুধ চিনি দিয়ে চায়ের স্বাদটাকে বদলে দেয়া হয়। গরম গরম চায়ে চুমুক দিতেই সমস্ত শরীরে মনে কেমন যেন একটা ঘোর কাজ করে। বললাম

-দেন।

মোবারক ভাই চা বানাতে ব্যস্ত। অার আমার মন ব্যস্ত হয়েছে শওকতের বাঁশির সুর শুনে। শওকতের সাথে পরিচয়টা অদ্ভুত। সে একটি আস্তানায় বসে বাঁশি বাজাচ্ছিল। বাঁশিতে দরুদ শরীফ। কি যে দারুণ আর মনোমুগ্ধকর লেগেছিল তা বলাই বাহুল্য। আমরা অনেক আগে একটা গল্প পড়েছিলাম । জার্মান দেশের এক বাঁশিওয়ালা। যার নাম হ্যামিলন। যে শহর থেকে অনেক ছেলে-মেয়েকে নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল। আর আমাদের হ্যামিলন হচ্ছে শওকত ভাই। যার বাঁশির সুর শুনলে মনটাই হারিয়ে যায়। তাকে আমরা ঠাট্টা করে হ্যামিলন বলেই ডাকি। ওর সাথে দেখা করার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়। তাই মনে মনে ঠিক করলাম। আজকে যতরাতই হোক ওর সাথে দেখা করেই যাব। কথা বলবো ওর সাথে।

-মামা চা নেন। আর কিছু দিমু? মোবারক জিগ্যেস করলো।

-না।

-মামা কি কিছু ভাবতেছিলেন? কেমুন জানি আনমনা দেখলাম।

-আরে না। তেমন কিছুই না। বাঁশির সুর শুনে কেমন যেন মনটা আনচান করছে। বাঁশি বাজাচ্ছে কে? শওকত না?

আমি জানতে চাইলাম।

-ও ছাড়া এমুন কইরা আর কেউ বাঁশি বাজাইতে পারে? কেমতে যে পারে..হেই যে ধরছে আর ছারার নাম নাই।

-এটা অবশ্য ঠিকই বলেছো। অনুষ্ঠান শেষ হয় কয়টায়?

-রাইত দুইটাতো বাজেই। তয় আইজগো কতক্ষুণ বাজায় কে জানে?

মোবাইল বের করে দেখলাম। রাত প্রায় একটা বাজে। আরো প্রায় এক ঘন্টা। এই একটা ঘন্টা কিভাবে যে কাটাবো সে চিন্তাটাই এখন পেয়ে বসলো। শীতের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় উঠতেও ইচ্ছে করছে না। কেমন যেন ঘুম ঘুম পাচ্ছে। মাথাটা কেমন যেন ঝিম ধরে গেল। বাঁশির সুর যেন কাঁটা হয়ে বিঁধতে লাগলো। পুরো দুনিয়াটাই যেন মুহুর্তের মধ্যে পাল্টে গেল। ভাবলাম উঠে বাড়ি চলে যাই। কিন্ত্তু কিভাবে যাবো? সবইতো বন্ধ করে যে যার মতো চলে গেছে। আমি হাত-পা গুটিয়ে চোখ বন্ধ করে ঝিম মেরে বসে রইলাম রাত দুটোর আশায়। শওকতের সাথে কথা বলবো বলে।

-ভাই একটু চাইপ্যা বসেন।

আজিজ ভাই একবোঝা পাটের খড়ি মাথায় করে নিয়ে এসে বসলেন আমার পাশে। পাট খড়ি পাশে রেখেই মোবারক ভাইয়ের সাথে আলাপ জুড়িয়ে দিল। অামি ঝিম মেরে পড়ে রইলাম।

শীতের মৌসুমে আমাদের এই বিক্রমপুরে পালা গানের কদর বেশ বেড়ে যায়। দুর দুরান্ত থেকে অনেক পালা গানের দল আসে। সারা রাত চলে পালা গান। যে এলাকায় এ গানের আসর বসে সেখানে একটা ছোট খাটো মেলার মতো হয়। দোকান-পাট সারা রাতই খোলা থাকে। মোবারক মামার দোকানটা একপাশে বলেই মোবারককে সবাই পছন্দ করে। তাছাড়া ফান্টুস চায়ের জন্য সবাই তাকে মামা বলে ডাকে। মোবারকও তাদের কল্যাণে বেশ ভালো রকমেরই পসরা সাজিয়ে বসেছে। তাছাড়া রাজনৈতিক একটা ফায়দা লুটারও একটা প্রচেষ্টাও আছে তার মধ্যে। সেসুবাদে তাকে কেউ কিছু বলে না।

- কি রে ব্যাটা কি চিন্তা করছিস?

- ভাবছি।

-কি ভাবছিস বাঁশির কথা?

-হ্যাঁ। আপনি জানলেন কি করে?

-আমি সব জানি। তুই কি ভাবছিস। কেন তোর মন খারাপ? কেন তুই শওকতের সাথে দেখা করতে চাস?

লোকটির কথা শুনে আমি তার দিকে তাকালাম। মাঝারি গোছের লোকটি। স্বাস্থ্য ভালো। চারদিকে চাপ দাঁড়ি। সবগুলোই পাকা। চেহারার মধ্যে একটা নুরানী ভাব বিদ্যমান। সাম্য কান্ত চেহারা। সাদা ধবধবে একটা চাদর গায়ে। দেখলেই কেমন যেন ভক্তি করতে ইচ্ছে করে। মনটা কেমন যেন নরোম হয়ে যায়।

-শোন। তুইতো বাঁশির কথা জানতে চাইছিস। তাই না? বাঁশি হচ্ছে - মানব দেহেরই অংশ বিশেষ। বাঁশির মধ্যে সাতটা ছিদ্র রয়েছে। যার এক প্রান্ত বন্ধ থাকে। সেই সাতটি ছিদ্র হচ্ছে সপ্ত ইন্দ্রিয় বিশিষ্টরুপ। সাত সুরে বাঁজে মোহন বাঁশি। সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি। এরপর আবার সা। গানের স্কেল তিনটি। উদারা-মুদারা-তারা। তার মানে বুঝিস?

-না। আমি সম্মোহিত হয়ে বললাম। তিনি আবার বলা শুরু করেছেন

-বাঁশির মধ্যে সাতটি ছিদ্র হলো সাতটি ইন্দ্রিয়। আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআন শরীফে  [সুরা হিজর আয়াত -৮৭] বলেছেনঃ "ওয়া লাক্বাদ আতায়নাকা সাবআম্মিনাল মাসানী ওয়াল কুরআনাল আযিম"। অর্থ-নিশ্চয় আমরা তোমাকে দিয়েছি মাসানী হতে সাতটি এবং আল-আজমতওয়ালা আল-কোরান. (দ্রষ্টব্যঃ সুরা যুমার আয়াত নং ২৩ঃ ’সানী’অর্থ দ্বিতীয়,Second Repeat,Repeated for once more) মাসানী হচ্ছে সাতটি । এই সাতটি হল শুদ্ধ মানুষের ইন্দ্রিয় সমুহ । জীবরুপে প্রত্যেক মানুষ সাতটি ইন্দ্রিয় লাভ করেছে। কিন্ত্তু  মাসানীরুপে অর্থাৎ উহাদের দ্বিতীয় সংস্করণরুপে লাভ করেনি। ইন্দ্রিয়গুলির সঠিক ব্যবহার দ্বারা সাধক প্রত্যেকটি ইন্দ্রিয়ের নবসংস্করণ সিদ্ধগুরু হতে লাভ করে থাকেন। যেহেতু এই সাতটি ইন্দ্রিয় নবরুপে এবং দ্বিতীয়রুপে লাভ করে থাকেন। সেইহেতু এদেরকে মাসানী বা দ্বিতীয়ত্বপ্রাপ্ত হওয়া বলা হয়েছে । ইন্দ্রিয় সাতটি হইলঃ চক্ষু,কর্ণ, নাসিকা,জিহ্বা,দেহ,কথা,মন । আজমতওয়ালা কোরান তথা গৌরাম্বিত কোরান সেই ব্যক্তির মধ্য হতে নাজেল হয় যারা সপ্ত ইন্দ্রিয়ত্বপ্রাপ্ত হয়েছে । এই শ্রেণীর ব্যক্তিগণই কেবল গৌরাম্বিত ব্যক্তিত্ব । কোরান নাজেল হওয়া বিষযটি সর্বজনীন এবং সর্বকালীন একটি বিষয় ।এই কথাটিও কোরানে এবং হাদীসে বহুবার ব্যক্ত হইয়াছে ।[সুত্র: কোরান দর্শন(২য় খন্ড) মহাত্মা সূফী সদর উদ্দীন চিশতী]।

আর সাতটি সুর সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি হচ্ছে স্বরজ-বিষব-গান্ধার-মধ্যম-পন্ঞ্চম-ধৈবত ও নিশাত। শিশুর দেহেতে প্রথম সহস্রার পদ্মে "সোহ হং" শব্দ হতে ভাসে রাগিনী "সা" দ্বিতীয়ায়  রিতুযুক্তা হলে ভাসে "রি" এবং তৃতীয়াতে রসে ভরপুর অবস্থায় গম্ভীর ভাব হলে উৎপন্ন হয় "গা"। এতে যখন প্রাণ মোহিত হয় তখন চতুর্থি মিলনাকাংখায় ভাসে " মা" । মন যখন রতিরস আশে উন্মত্ত পাগলপ্রায় সম হয় তখন পন্ঞ্চমীর ভাসে "পা"। অতঃপর পীরিতি বিলাসে ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলার কালে ষষ্ঠি রাগ "ধা" এবং নিশাদে অন্তর জ্বালা নিবৃতি করে নিলে ভাসতে থাকে সপ্তমীর "নি"। সর্বশেষ সবগুলোর নীরবতায় প্রাণ বিদেহ কালে সপ্তরন্ধ একত্র সপ্তরস মিশ্রিত "সা" শব্দ পুনরায় ভেসে ওঠে আমিত্ব বিলীন হয় ও কৃষ্ঞ ব্রক্ষের হংসমুখর বাঁশি আর বাজে না। শেষের সুর "সা" বলে কোমল "সা"। বুঝা গেল কিছু?

তিনি প্রশ্ন করলেন। আমি বোকার মত ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। কি জিগ্যেস করবো ভেবে পেলাম না। তিনি আবার বলা শুরু করলেন

- শোন। নাদ বিন্দু প্রথমে থাকে পিতার মস্তকে। দ্বিতীয়ায় খায়েশ। তৃতীয়ায় মিলন। চতুর্থীতে মণি। পন্ঞ্চমে মাতৃ উদর।ষষ্ঠ দুনিয়া। সপ্তমে আখের। এই সাতটি মন্ঞ্জিলে দুনিয়াতে আসা যাওয়া উরুজ-নুযুল রুপ দেয়া হয়েছে।

-কিন্ত্তু উদারা-মুদারা-তারা? এটাতো ব্যাখ্যা করলেন না?

-উদারা-মুদারা-তারা হচ্ছে মানবদেহের তিনটি প্রধান অংশ। বাম পাশের অংশ উদারা মধ্যের অংশ অর্থাৎ মেরুদন্ড এবং ডান পাশের অংশ হচ্ছে তারা। পুরো দেহটাকে তিনভাগে ভাগ করে এই নাদ বিন্দুর সাধনা করতে হয়।


-জ্বি। এবার বুঝতে পারছি। সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি এরপর কোমল সা। আর উদারা-মুদারা-তারা?


-ঐ মামা কি সব উল্টা-পাল্টা বকতাছেন? হেই কহন থেইক্কাই দেকতাছি খালি বিড় বিড় কইর‌্যা কি জানি কইতাছেন?


মোবারক মামার চিল্লাচিল্লিতে আর আজিজ ভাইয়ের গুতানিতে আমার ঘোর কেটে গেল। আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম আজিজ ভাইয়ের দিকে। আরেকবার মোবারক ভাইয়ের দিকে। আর আমার চোখ খুঁজতে চেষ্টা করছে সেই সাম্য-কান্তির মানুষটিকে যে আমাকে শিখিয়েছিল উদারা-মুদারা-তারা। সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি।