পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০১৫

নৌকা ও মাছ শিকার

চারদিকে শীতের তীব্র প্রকোপ। কুয়াশার চাদরে ঢাকা। গাছের পাতায় শিশির বিন্দু জমে জমে টিনের চালে পড়ছে। টুপ টুপ শব্দ হচ্ছে। নিশুঁতি রাতের আঁধারভেদ করে জমির মিয়ার ঘরে জ্বলছে মিটি মিটি হারিকেনের আলো। জমির মিয়া দেখলেন কাঁথা মুড়ি দিয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন শহিদা। তিনি আস্তে আস্তে শহিদাকে ডাকলেন

-ও শহিদা, শহিদা..


শহিদা তার স্ত্রী। গ্রামের বাড়ী মান্ডা। তাদের পাশের গ্রাম। তার বাবা মজিদ ভান্ডারী। বেশ নাম ডাক রয়েছে লোকটার। শক্ত পোক্ত দেহের গঠন। দেখলেই বোঝা যায় কঠোর পরিশ্রমী একজন মানুষ। শখ করে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন জমিরের সাথে। জমিরের বাবা মোসলেম ফকিরের সাথে তার অনেক মিল। দুজনেই যেন দু'জনার। সময় সুযোগ পেলেই খোশ গল্পে মেতে ওঠেন। প্রায়ই তাদের মধ্যে দেহতত্ত্ব নিয়ে কথা হয়। বিনিময় হয় ভাবের। কিন্ত্তু এসব ব্যাপারে জমিরের তেমন কোন আগ্রহ নেই। সে জানে নৌকা বাইতে আর মাছ শিকার করতে। আজো যাবার জন্য তিনি ব্যস্ত হয়েছেন। সারা শরীরে সরিষার তেল মালিশ করেেছন। বুকে ভালো করে মালিশ করেছেন।যাতে ঠান্ডা বসে না যায়। ভালো করে মাথায় উলের টুপি পড়েছেন। গায়ে দিয়েছেন সোয়েটার আর চাদর। চাদর ভালো করে পেঁচিয়ে হাতে মাছ ধরার জালটা নিয়ে বের হবেন ঠিক তক্ষুণিই মনে পড়লো বৈঠার কথা। তিনি আবারো শহিদাকে ডাকলেন-

-শহিদা ও শহিদা....

শহিদা কাঁথার ভেতর থেকে মাথা বের করে বললো-

-কি হইছে? এমুন রাইত দুপুরে চিল্লাইতাছো ক্যা?

-আরে বৈঠাটা কই রাকছো?

-বৈঠাতো দাওয়ায় আছে। ভালো কইর‌্যা খু্‌ইঁজ্যা দেহো?

জমির আর দেরী না করে তাড়াতাড়ি দাওয়ায় যায়। যেয়ে দেখে বৈঠাটা একটা কোণের কাছে রাখা। বৈঠা হাতে নিয়েই জমির রওনা দেয় মাছ ধরতে। বাড়ীর দরজাটা আস্তে করে ভিড়িয়ে দিয়েই সে হাঁটা শুরু করলো।

জমিরের অপেক্ষায় থাকা হরিধর পাল তখন নৌকার সামনে ঘাটে অপেক্ষা করছে।জমিরের আসতে দেরী দেখে সে ম্লান মুখে বসে রইল। তার সাথে আসা কিষান বললো

-শালার পুতে কি করে এতক্ষণ ধইর‌্যা? হেই কহন থিক্যা বইয়্যা রইছি?

-কে জানে? মরছে নি? হরিধর পালের জবাব।

-কি যে কওনা দাদা...ঐ হালায় মরলে ওর বউয়ের কি অইবো?

-হেইডা লইয়া তর চিন্তা করা লাগবো না?

হরি আর কিষাণের কথোপকথনের মাঝে জমির এসে উপস্থিত হয়। জমিরকে দেখেই হরিধর পাল বলে ওঠে

- কি রে আ্যতো দেরী করলি ক্যা।

- কি আর কমু দাদা বৈঠা পাইতাছিলাম না। খুঁজতে যাইয়্যাইতো দেরী অইয়্যা গেল।

-অইছে। আর কওন লাগবো না। নে তাড়াতাড়ি নৌকা ছাড়। আরে ঐ কিষাইন্ন্যা কই গেলি? তাড়াতাড়ি আয়।

হরিধর পালের গলার আওয়াজ পেয়ে কিষাণ তাড়াতাড়ি প্রসাবের কাজ সেরে নৌকায় ওঠে।

-নে নৌকা ছাড়...

হরিধর আর কিষাণ মাছের জাল গুছিয়ে নিচ্ছে। জালের ভাঁজগুলো ঠিক মতো পড়লে মাছ ধরে বেশি। ঠিক মতো না পড়লে ফাঁকে ফোঁকে মাছ বেড়িয়ে যায়। জমির নৌকা বাইতে বাইতে পদ্মার মাঝ বরাবর চলে গেল। পদ্মায় শীত কালে তেমন তেজ থাকে না। কিন্ত্তু তারপরও পদ্মা বলে কথা। শীতের কুয়াশায় পুরো গাঙ্গে তখন চাদর মুড়ি দেয়া। ঢেউ নেই বললেই চলে। তারপরও হাল্কা ঢেউ এসে নৌকাটা দেলাচ্ছে। ঢেউয়ের স্রোতে যখন নৌকায় এসে বারি খাচ্ছে তখন ছপাৎ ছপাৎ করে শব্দ হচ্ছে। সেই শব্দে কেমন যেন মনটা চনমন করে ওঠে।

আকাশে আধো জোস্নায় ভরা পুরো পদ্মা তখন এক মায়াজাল তৈরী করেছে। জমির নৌকার হাল ধরে আছে শক্ত করে। বৈঠাটা তখন তার হাতের মুঠোয় থাকে। সে যেদিকে বৈঠা ঘোরায় নৌকাটা সেদিকেই মোড় নেয়। জমির মুগ্ধ হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জোস্না দেখছিল। চারদিকটায় ভালো করে তাকিয়ে দেখে তার মনটা কেমন যেন করে উঠলো। হরিধর পাল আর কিষাণ কাছা মেরে নদীতে জাল ফেলতে লাগলো। জমির তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলো তাদের দুজনকেই। কেমন যেন অপরিচিত লাগছে। কিষাণ গুণ গুণ করে গান গাইছে.....তোমারও লাগিয়ারে সদাই প্রাণ আমার কান্দে বন্ধুরে প্রাণ বন্ধু কালিয়ারে.... কিষাণের গানের গলা খারাপ না। কিন্ত্তু সেই গানটায় যেন প্রাণ পেয়েছে....সেই প্রাণের ছোঁয়ায় জমির হারিয়ে যায় তার অতীত স্মৃতিতে...

জমিরের বাবা মোসলেম ফকির আর শহিদার বাবা মজিদ ভান্ডারীর সাথে বেশ মিল ছিল। তারা প্রায়ই একে অপরকে পেলে হারিয়ে যেত গভীর তত্ত্ব কথায়। তাদের কথা জমির প্রায়ই শুনতো কিন্ত্তু কিছুই বুঝতো না। তার এখনো মনে আছে মজিদ ভান্ডারী যখন কথা বলতো তখন মনে হতো সে যেন কোথায় হারিয়ে যেত। বুজলেন বিয়াই...মরা গাঙ্গে মিন থাকে না। জোয়ারের টানে মিন আসে। সেই মিন ধরতে অয় বরশি দিয়া। বরশি দিয়া মিন শিকার করতে পারলেই কেল্লা ফতে...যখন নদীতে বান ডাকে তখন নৌকা চালাইলে ডুইব্যা যাইবার ভয় থাকে। নৌকা তখন তীরে ভিরাইয়্যা রাখতে হয়। কি বুঝলেন বিয়াই সাহেব? হুনেন বিয়াই সাব...নৌকা হইলো এই দেহটা আর বরশি হইলো পুরুষের বিশেষ অংগ। হেই বরশি দিয়া মিন শিকার করা লাগে.....আরেকটা কথা। আপনে যখন বরশি দিয়া মাছ ধরতে যান, তার আগে কি করেন? পরথমে বরশিতে আদার দেন। তারপর বরশি ফালান। বরশিতে যে টুনি থাকে হেডার দিকে চাইয়্যা থাকেন। যেই টুনি তলার দিকে যায় অম্মনিই আপনে বরশি টান দেন। আর টানের চোটে আদার খাওয়া মিন উইঠ্যা আহে। এইহানে এই যে আপনে টুনির দিকে তাকাইয়্যা রইলেন এইডাই অইলো মুরশিদের বরযোখ। মুরশিদের বরযোক বিনা মিন ওডে না। মুরশিদের বরযোক দিয়াই মাছ শিকার করা লাগে...টুনিডাই অইলো মুরশিদ....

জমির যেন সেই কথার মানে খুঁজে পাচ্ছে আজ। এই পরিবেশে তার কাছে তখন স্পষ্ট হতে শুরু করছে নৌকা, মাছ ধরা আর মাঝি মাল্লাদের, জাল দ্বারা মাছ শিকার করার তাৎপর্য।