পৃষ্ঠাসমূহ

বুধবার, ২৮ জানুয়ারী, ২০১৫

সেকরার দোকান

 কইগো রহিমের বাপ...কই গেলা...

বাড়ির ভেতর থেকে করিমননেচ্ছার গলা শোনা গেল। তার ডাক চিৎকারে গোয়াল ঘর থেকে রহিমের বাবা সোলাইমান বেপারী সেই ডাকে সাড়া দিয়ে বললো

- কি অইলো। অত চিল্লাচিল্লি করতাছো ক্যা..

-তুমারে না কইলাম একটা বটি আনার লাইগ্যা। হেই কবে খিক্কা কইতাছি বটির কতা। এইডা দিয়া কি তরিতরকারি কাটন যায়?

-কইছিতো বইকালে হাটের থিক্কা আইন্যা দিমুনে। এহন এই দুতটা রাহো। আমি আবার ক্ষেতে যামু। আইজ চারা লাগান লাগবো। যাইয়্যা দেহিগা পুলাডা কি করতাছে...আমার গামছাডা দেও

করিমননেচ্ছা দুধটা একটি পাতিলে ঢেলে রেখে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো গামছা আনার জন্য। অন্যদিকে সোলাইমান বেপারী বাড়ির দাওয়ার বসে রইল। তার গায়ে একটি গেন্ঞ্জী আর পরনে ময়লা একটা লুঙ্গি। দুইটাই তার ঔজ্জ্বল্য হারিয়েছে অনেক আগেই। তার ইচ্ছা ধান বিক্রির টাকা দিয়ে একটা ভালো দেখে লুঙ্গি আর একটা ফতুয়া কিনবে। আর তার বউয়ের জন্য একটা ভালো দেখে তাতের শাড়ি কিনে দেবে। করিম বক্স তার বন্ধু মানুষ। তার দোকান থেকেই কিনার ইচ্ছা। তাছাড়া ছেলেটার জন্যও বই কেনা দরকার। রহিম সবে মাত্র অষ্টম শ্রেণীতে পড়া শোনা করে। হাবিবপুর স্কুলের রহমান স্যার বলেছে - সোলাইমান তোমার পুলাডা মারশাল্লাহ লেহা পড়ায় ভালো। তার দিকে একটু যত্ন নিও মিয়া। পুলাডারে ক্ষেতে খামারে বেগার খাডাইও না। কিন্ত্তু সোলাইমানের যে অবস্থা তাতে বদলা রেখে কাজ করানো সম্ভব নয়। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ছেলেটারে বড় পাশ করায়। কিন্ত্তু আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে সম্ভব হচ্ছে না। হাত দিয়ে চুলগুলো আলগোছে আচড়াতে থাকে আর ভাবতে থাকে কি করবে সে...

- এই নেও গামছা। পুলাডারে পাডাইয়া দিও। অর স্কুলে যাওনের সময় হইছে...

সোলেমান কোন কিছু না বলে বাড়ি হতে বের হয়ে গেল। সে যেয়ে দেখে রহিম সব বীজ তলা থেকে চাড়া তুলে জড়ো করে রেখেছে। সে  আগেই সুমনকে বলে রেখেছে তাকে নিয়ে আজকে এই চাড়াগুলো জমিতে লাগাতে হবে। সুমন এখনো আসেনি দেখে তার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। সে একাই বীজতলা থেকে চাড়াগুলো নিয়ে জমির দিকে যায় আর রহিমকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।

-কি ভাই, এহন আইলা? পাশের ক্ষেত থেকে আফজাল মৃধা বলে।

-কি করমুরে ভাই? সুমন্যারে কইছিলাম আহনের লিগা। ওতো আইলো না।

-তোমার তো যেই জমি হেইডাতো তুমি একলাই লাগাইতে পারো।

-তা পারি। কিন্ত্তু দুই জনে লাগাইলে তাড়াতাড়ি লাগান যায়। হেরলাইগ্যাইতো ওরে কইছিলাম।

সোলাইমান বেপারি আর দেরি না করে জমিতে চাড়াগুলো লাগাতে শুরু করে। সে আগেই জমিতে আল দিয়ে রেখেছিল। পানিতে দিয়ে জমি ভিজিয়ে রেখেছে। বাকী ছিল শুধুমাত্র চারারোপন করা। সেটাই সে করছে আর ফাঁকে ফাঁকে আফজাল ভাইয়ের সাথে আলাপচারিতা করছে। আফজাল ভাই ফকিরি লাইনে আছে। ফকিরি লাইনের কথা বার্তা সে কিছুই বুঝে না। তার ইচ্ছা সে আফজাল ভাইয়ের সাথে তার আখড়ায় যাবে।

- কি ভাই কতা কও না ক্যা। চুপ মাইর‌্যা গেলা...

- আফজাল ভাই তুমি আবার কবে যাইব্যা?

-কই যামু?

-তোমার হুজুরের বাড়িতে?

-ক্যা মিয়া? তুমি যাইবানি?

-যামু।

সোলাইমানের চাড়া লাগাতে লাগাতে প্রায় বিকেল হয়ে এলো। গায়ে কাদা মাটি মাখানো। সে তাড়াতাড়ি বাড়িতে যেয়ে গোছল সেরে খাওয়া দাওয়া করে। বিকেলে হারতার হাটে যায়। হারতার হাট প্রতি সপ্তাহে বুধবার হয়। আশে পাশে থেকে অনেক লোকের সমাগম হয়। নানা রকম পশরা সাজিয়ে লোকেরা বিকিকিনি করে। পুরো হাটটা অনেক বড়। সব ধরণের জিনিস পত্র পাওয়া যায়। সপ্তাহে একদিন হওয়ার জন্য লোকজন সপ্তাহের বাজার করে নিয়ে যায়। লোকজনের আনাগোনা বেড়ে যায়। কুলি-মজুররা দম ফালানোর সময় পায় না। সবাই খুব ব্যাস্ত সময় কাটায়। চায়ের দোকানগুলোতে টুং টুং শব্দে কান পাতা দায়। সোলাইমান একটি কামারের দোকানে ঢুকে। ট্যাং ট্যাং শব্দে  পুরো দোকানটা ঘরময় শব্দ ছন্দে ভরপুর। আনিস কর্মকারের দোকান। দোকানময় কেমন যেন একটা পোড়া গন্ধ। কয়লায় পোড়া গন্ধে দম আটকে যায়।

- আনিস ভাই কেমন আছো?

-আর আছি ভাই? দেহো না কাম কইর‌্যা কুলাইতে পারি না...

-হ। তাতো দেকতাছি।

সোলাইমান দেখে একটি আট-দশ বছরের ছেলে ভেলুতে চাপ দিচ্ছে। আর আগুণের ফুলকিগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে উপরের দিকে উঠছে। কয়লার মধ্যে একটি লোহা রাখা। আগুণের তাপে সেই লোহাটা লালে লাল হয়ে যাচ্ছে। সেটাকে একটা চিমটা দিয়ে ধরে দমাদম বারি দিয়ে ছুরি, কাঁচির, দায়ের, কিবাং বটির আকার দেয়া হচ্ছে। সে অবাক হয়ে ভাবতে থাকে....

গত শীতের মধ্যে তার বাড়িতে আফজাল ভাইয়ের হুজুরকে খবর দিয়ে নিয়ে আসছিল। তিনি ও তার সাথে আরো দুইজন। করিমননেচ্ছা হুজুর আসবে শুনে পিঠা বানিয়ে রেখেছিল। সেই পিঠা তাদের খেতে দেয়া হলো। খাওয়ার ফাঁকে হুজুর বললেন

- তিনার খেলা বুঝা ভার মিয়া। তিনিই রিজিকের মালিক। আমি কি ভাবছিলাম আমার রিজিক এইহানে আছে?

-হ হুজুর ঠিক কইছেন।

-পিঠাডা খুব সোয়াদ হইছে। কে বানাইছে?

-রহিমের মায় বানাইছে। আপনে আইবেন শুন্যাইতো গরুর দুত দিয়া এই পিডা বানাইছে।

 গরুর কথা শুনে হুজুর বললেন

-শুন মিয়া। আল্লাহ পাক গরুর শানে সুরা বাকারা নাযিল করছে। বাকারা মানে অইলো গিয়া গাভী। হেই সুরার মধ্যে মারফতের অনেক কতা আছে। কেমনে জমিতে বীজ দেওন লাগে। কেমনে জমি চাষ করন লাগে। সবই ঐ সুরার মধ্যে আছে। যারা ঐ ভাবে থাকে তারা পায় ঐ ভাবের ধারা।
লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাতে
বীজ ফেলা তুই বিধিমতে
পাবি ঈমান ফসল তা'তে
আর রইবি সুখেতে।
নজরুলের কতা। নজরুল (কাজী নজরুল ইসলাম) এই গানডা বুইজ্যাই লেকছে। হে জানতো মিয়া সুরা বাকারার মানে।

-হুজুর আমাগো কি কওন যায় না হেই ভাবের কতা?

-আরে মিয়া হেইডা বোজবার লিগা তোমাগো গুরু ধরন লাগবো। গুরুর কাছে মুরিদ অইলেই সে তুমারে বাতাইয়া দিব। তহন তুমি নিজেই বুজবার পারবা।

-হুজুর আমারে কি কওন যাইবো না? আমিতো মুরিদ অইছি। আফজাল ভাই বললো।

-মিয়া। সব কতা সব জায়গায় কওন যায় না। তোমারে যেই তালিম দিছি হেইডাইতো ঠিক মতো করবার পারো নাই মিয়া। তোমারে যে হাওয়ার ঘরের দম দিছি হেইডা কি ঠিক মতো পালন করছো নি মিয়া?

-সব সুময়তো পারি না। যহন সুময় পাই তহনই করি।

-শুন মিয়া। এইডার মধ্যে একখান ইন্ঞ্জিন আছে। দিবারাত্রি ২১,৬০০ বার হেই ইন্ঞ্জিনে হাওয়া দেওন লাগে। জনমের পর হেইডা শুরু অয়। আর শেষ হয় মইর‌্যা গেলে। হেই ইন্ঞ্জিনের মইধ্যে আল্লাহ-রসুলের আনা-জানা। কামারের দোকানে গেলে দেকবা সেকরায় ফুঁ দিয়া কয়লা গরম করতাছে। আর একটা হাপারের মধ্যে লোহা রাইক্যা হেইডারে গরম কইর‌্যা পিডান দিয়া কামারে নানান জিনিস বানায়। বুকের মইধ্যে হেই সেকরা বইয়্যা দমের ঘরে ইসকের আগুন দিয়া পুরাইয়া দেওয়ানা বানায়। বুজবার পারছোনি মিয়া। শুন মিয়া এই দেহডা অইলো জমি। কোরআনে গাভী কয় স্ত্রী লোকরে। আর হেই জমিতে বীজ ফালানের লিগা কি করন লাগে.....আগে বীজের বিচার করন লাগে...

সোলাইমান অবাক হয়ে শুনতে থাকে হুজুরের কথা। আর ভাবতে থাকে ২১,৬০০ বার এই দেহের ভেতর তার আনা-জানা। দম দিয়া যে দয়াময় ছাইর‌্যা দিল হেই দয়াময় কতোই না লীলাময়। লীলাময়ের লীলা বোঝা ভার। নিজের জমি চাষ করছি। গরু আছে। জমি আছে। সবইতো আছে । কিন্ত্তু হুজুর যে সুরা বাকারার কতা কইলো হেইডা তো বুঝবার পারলাম না। সে আবার মনোযোগ দিল হুজুরের কথায়

-এমনে কইর‌্যা উপরের দিকে টান দিয়া উডাইয়া আবার হেইডারে ছাইর‌্যা দেওন লাগে নাভী বরাবর। এইডারে কয় পাস-অানফাস যিকির। এই হাওয়ায় দম দিয়াই জীবন শেষ করন লাগে। আর বরযোকে মুর্শিদরে ধ্যান করন লাগে। সব সময় মুর্শিদের ধ্যানে থাকবা মিয়া....


-কি ভাই? কই আরাইয়্যা গেলেন? আনিসের কথায় চমকে ওঠে সোলাইমান।

-কই আর আরামু। যাউক গা। আমাকে একটা বটি বানাইয়া দেওন লাগবো।

-বটিতো বানাইন্না আছে। এইডা লইয়া যাও। ধার আছে।

সোলাইমান বটি হাতে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। আর ভাবতে থাকে  সেই কবে তার বাড়িতে হুজুরকে নিয়া আফজাল ভাই আসছিল। তার কল্যাণেই সে জানতে পারছে মারফতের গোপন কথা। বটি কিনতে যেয়ে আজ তার সেই কথা মনে পড়ায় মনের মধ্যে কেমন যেন করছে। আর মনে মনে বলছে... হা দয়াময় তোমার লীলা বোঝা দায়....