পৃষ্ঠাসমূহ

শুক্রবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০১৫

সারমাদ দারদী আজাব সিকাস্তা কারদি তুনে-পর্ব দুই

(পূর্ব প্রকাশের পর)
মাহিন চলে যেতেই আমি আমার পূর্বের চিন্তায় বিভোর হতে চেষ্টা করলাম। কিন্ত্তু কি আশ্চর্য্য। সেটা আর আসছে না। আমাকে পেয়ে বসলো-আমি সুফী সাহেবের সাথে কি নিয়ে কথা বলবো? কোন টপিক নিয়ে কথা বলবো? মনের ভেতর থেকে সাজানোর চেষ্টা করলাম। কিন্ত্তু যতই চেষ্টা করতে লাগলাম ততই আমাকে বিরক্ত হতে হলো। আমি কিছুতেই আর আগের ধারণায় ফিরে যেতে পারছি না। তাহলে কি পরিবেশ পরিস্থিতি মানুষকে সময় সময় দার্শনিক বানিয়ে দেয়? মানুষের অবচেতন মন কি নিজের অজান্তেই দার্শনিক হয়ে পড়ে?

-দোস্ত আয়। তোরে ডাকছে

মাহিনের শব্দে আমার ঘোর কেটে গেল। অামি কল পাড়ে গিয়ে ভালো করে মুখ ধুয়ে পরিস্কার হয়ে নিলাম। তারপর মাহিনের সাথে সুফী সাহেবের সাথে দেখা করতে গেলাম

সুফী সাহেব তার খাস কামরায় একটি চেয়ারে আরাম করে বসে আছেন। সেই ঘরটা বেশ পরিপাট করে সাজানো। আগর বাতি আর আতরের গন্ধে ঘরটা মৌ মৌ করছে। সেখানে একটি আলমিরায় দেখলাম বেশ কিছু দামী দামী লেখকের বই সাজানো আছে। কোরআন শরীফের তফসীরের অনেকগুলো খন্ড টেবিলের একপাশটায় পড়ে আছে। আরেক কোণে দেখলাম একটি চকির উপর একটি জায়নামায পাতা। পাশেই রয়েছে তসবীহ। আর কোরআন শরীফ। পু্রো ঘরটায় কার্পেট দিয়ে মোড়া। তিনি আমাকে একটা চেয়ার দেখিয়ে সেটায় বসতে বললেন। আমি তাকে সালাম দিলাম। মাহিন বললো-

-বাবা, আমার বন্ধু। সোহেল। আমরা একসাথেই ঢাকা ইউনিভারসিটিতে পড়া শোনা করি

তিনি আমার দিকে তাকালেন। তার তাকানোর ভিতর কি ছিল কে জানে? তার সেই তাকানোর দৃষ্টিতে আমার ভেতরে কেমন যেন একটা  হিম শীতল ভাব চলে এল। অামি যেন সব ভুলে গেলাম। তাকে যেন কি জিগ্যাসা করতে এসেছিলাম? আমি মনে মনে প্রমাদ গুণলাম

-তা বাবা, আমার কাছে কি জিগ্যাসা করার আছে তোমার? আমিতো তেমন কিছুই জানি না। সব তিনিই জানান। আমি শুধু বলি। সবই তিনি। তা বাবা বলো

-হুজুর আমার তেমন জানার কিছুই নেই। আমি কেবল জানতে আসছি - এই যে আপনি বললেন তিনিই সব জানেন। আমি এই তিনির সর্ম্পকেই জানতে চেয়েছিলাম। ব্যাস। এটুকুই

আমি মনে মনে টের পেলাম। আমার ভেতরটা কেমন যেন গরম হয়ে যাচ্ছে। বুকের ভেতর হৃদপিন্ডটা হটাৎ দ্রুতগতিতে লাফাতে শুরু করেছে। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বললেন

-শোন। আল্লাহ পাক হাদিসে কুদসিতে বলেছেন-"কুনতু কানজান মুখফিয়ান ফা আহবাবতু আনউরাফা ফাখালাকতু খালকা।" আমি একটি গুপ্ত ধনাগারে গুপ্ত ছিলাম। নিজেকে প্রকাশের ইচ্ছায় প্রকাশিত হইলাম। তাছাড়া আবিদারা নামক এক সাহাবা একদিন রাসুলে পাক (সাঃ) কে প্রশ্ন করলেন-ইয়া রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সৃষ্টির প্রারম্ভে আল্লাহ পাক কিরুপ ছিলেন? তদুত্তোরে রাসুলে পাক (সাঃ) বলেছেন-" সৃষ্টির প্রারম্ভে আল্লাহ পাক আল-আমা নামক একটি কুপে কুছঝটিকা (কুয়াচ্ছন্ন) রুপে ছিলেন। সেই সময়তো কিছুই ছিল না। শুধু আল্লাহ পাক ছিলেন। তিনি নিজেকে প্রকাশের ইচ্ছায় প্রকাশিত হবেন বলেইতো আমরা আল্লাহ সর্ম্পকে জানতে পারছি। তা না হলে আমাদের জানার কোন উপায় ছিল না। তিনিই সৃষ্টি তিনিই স্রষ্টা। সৃষ্টি সর্ম্পকে জানা যায় কিন্ত্তু স্রষ্টা সর্ম্পকে পুরোপুরি জানা যায় না। আবার এটাও মিথ্যা। কেননা স্রষ্টা সৃষ্টিতেই আছেন বলেই তো আমরা কথা বলতে পারছি

-সেটা কি রকম?

-বলছি শোন। আল ইনসানু সিররি ওয়া আনা সিররুহি। ইনসান আমার রহস্য এবং আমি রুহের রহস্য। আবার অন্যত্র বলা হয়েছে-মান আরাফা নাফসাহু ফাক্কাদ আরাফা রাব্বাহু। যে তার নাফসকে চিনেছে সে তার রবকে চিনেছে। তোমাকে যদি পুরোপুরি জানতে হয় সে ক্ষেত্রে বিচার্য বিষয় হচ্ছে-ইনসান, রুহ, নফস এবং রব সর্ম্পকে ভালোভাবে জানা। যদি সে সর্ম্পকে তোমার পরিস্কার ধারণা জন্মায় তাহলে তুমি তোমাকে জানতে পারবে। সংক্ষেপে যদি বলি তাহলো -ইনসান উন্স শব্দ হতে এসেছে। উন্স অর্থ প্রেম। অর্থাৎ প্রেম থেকে যার সৃষ্টি সে হচ্ছে ইনসান। অন্য অর্থে গুরুভক্ত সাধককে ইনসান বলা হয়। যে মানুষ তার ত্রুটি সমন্ধে জাগ্রত; এবং একটি বাস্তব এবং সত্য মনোভাবের উপর দাঁড়ায়।  
ইনসান অলিক মনোভাবকে কোন গুরুত্বই দেয় না। ইনসানের মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে যাহা অন্যের নাই। ইনসান গুরুর গুরুত্ব বিষয়ে সম্পূর্ণ সচেতন এবং কম-বেশি গুরুর সাহচর্যে থাকে রহমান প্রভুগুরুরুপে জিনকে কোরান শিক্ষা দিয়া ইনসানে রুপান্তরিত করেন। তারপর তাহাকে সর্ববিষয়ের ব্যাখ্যা দান করেন (৫৫ঃ১-) গুরু এবং ইনসানের সর্ম্পক আন্তরিকভাবে ঘনিষ্ঠ এবং ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। গুরুর বাহিরে সে কোন আপন অস্তিত্ব মানে না। যদিও অতীত কর্মের কারণে গুরুকে পূর্ণভাবে অনুসরণ করিতে সক্ষম হয় না। এই সংজ্ঞার বর্হিভুত মন-সমুহ সবাই জিন। গুরুর বাইরে কোন ইনসান নাই। ইনসানের বহুবচন নাস। 
তাহলে প্রশ্ন হলো জিন কি?
জিন জাতি হিসাবে ইহারা মানুষ হইতে মর্যাদায় নিন্ম মানের। ইহারা সূক্ষ্ম চিন্তাশক্তি বিশিষ্ট আগুণের তৈয়ারী জীব। আদামের সন্তান হিসাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে ফেরেস্তা এবং জিনভাব উভয়ই বিদ্যমান। সুতরাং যাহাদের মধ্যে জিনভাব বেশিপ্রবল তাহাদিগকেও জিন বলা যাইতে পারে
এরপর আসো রুহ সর্ম্পকে। 
রুহ হইতেছে "সাধক-নফস" এর উপর মোহাম্মদী নুরের একটি বিকাশের অবতরণকে রুহ বলে। রুহ নাজেল হইলে উহা নফসের উপর কর্তা হইয়া যায়। রুহ সৃষ্টির অন্তর্গত নহে।  উহা সৃজনী শক্তির অধিকারী। রুহ রহস্যময়। উহার পরিচয় ভাষায় ব্যক্ত করা দুরুহ। রুহ প্রাপ্তি দ্বারা আত্মপরিচয়ের পূর্ণতা আসে। প্রভু গুরুর ভাবমুর্তি (Image of Lord Guru) সাধকের আপন চিত্তের উপর অধিষ্ঠানকে "রুহ নাযেল" বলে। 
আর নফস হইলো-চিত্তবৃত্তির সামগ্রিক অভিব্যক্তি। শ্রবণ, দর্শন ইত্যাদি ইন্দ্রিয়সমুহ এবং বুদ্ধি, স্বরণশক্তি ইত্যাদির গুণাগুণ নফসেরই এক একটি অভিব্যক্তি। শুদ্ধির পর্যায় অনুসারে নফস চার প্রকার। যদিও প্রধানত তিন প্রকারঃআম্মারা, লাউয়ামা এবং মোৎমায়েন্না। অর্থাৎ অশুদ্ধ, শুদ্ধি কর্মে ব্যস্ত এবং পরিশুদ্ধ। আপন বুদ্ধিতে চলিলে আম্মারা। মোমিন ব্যক্তির বা গুরুর নির্দেশিত পথে কর্মযোগে থাকিয়া চেষ্টা করিলে লাউয়ামা। ইহাদিগকে কোরানে আমানু বলিয়া সম্বোধন করিয়াছেন। শুদ্ধ হইয়া গেলে তাহারা মোৎমায়েন্না বা মোমিন। চতুর্থ এবং শেষ পর্যায় "নফসে ওহায়েদ" (In other words whatever you do is your Nafs. Allah does not do anything. He is above doing anything. Muhammad [A] in Nafs. or formed Muhammad, showed in his life how to do things without Nafs.) 
এবার আসো রব সর্ম্পকে। 
সৃষ্টির মুল উৎস নুরে মুহাম্মদী। আল্লাহর জাতিনুর, এই নুরে মোহাম্মদী, প্রতিটি সৃষ্টির মধ্যেই রবরুপে অনুপ্রবিষ্ট হইয়া উহার সৃষ্টিকারী, পালনকারী এবং ধ্বংসকারী রুপে আবর্তনশীল ক্রিয়া করিয়া চলিয়াছে। এইরুপে আপন সৃজিত বিবর্তনমুলক বিধান অনুযায়ী অর্থাৎ কেতাবের ধারা অনুযায়ী প্রতিটি সৃষ্টিতে অনুপ্রবিষ্ট থাকিয়া যিনি উহার সৃজন, পালন এবং বিলয় সাধন করিতেছেন তিনিই সেই সৃষ্টির রব। রবরুপে তিনি বিশ্ব ব্যাপ্ত হইয়া প্রেমময় রাব্বুল আলামিন থাকিতেছেন। তসবিহকারী জিন এবং তসবিহকারী মানুষের জন্য তাহাদের প্রত্যেকের আপন প্রেমময় রবের পরিচয়ের পথ তিনি খোলা রাখিয়াছেন
আল্লাহ মানুষের সংগে রবরুপে যে যোগসুত্র দান করেন তাহা দুই প্রকার অর্থাৎ মানুষের রবের দুইটি রুপ।একটি জাহের অপরটি বাতেন।তাহার জাহের রুপটি হইল-বিশ্বময় কামেল মুর্শেদরুপে তিনি হেদায়েতদাতা। বাতেনরুপটি হইল-মানুষের মধ্যে তাহার অদৃশ্য গোপন অবস্থান। তাহার জাহের অস্তিত্বের নিকট আত্মসমর্পণ না করিলে মানুষ তাহার আপন অস্তিত্বের মধ্যে অদৃশ্যভাবে অবস্থিত আপন রবের পরিচয় লাভ করিতে সক্ষম হয় না। আল্লাহর প্রশংসা জাহের রব হইতেই মানুষের নিকট প্রকাশিত হইয়া থাকে

সুফী সাহেবের কথা শুনে আমি মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝলাম না। তবে এটা বুঝলাম যে আমরা প্রচলিত ধারায় দেহতত্ত্ববাদ বলতে যা বুঝে থাকি সেক্ষেত্রে সুফীধারায় তা অন্যরুপ। নারী-পুরুষ মৈথুনাত্মক কোন তথ্য পেলাম না। তিনি বাউলদের মতো করে কোন কিছুই বলেননি। তিনি যে ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ দিয়েছেন তা নিতান্তই স্বজ্ঞাপ্রাপ্ত উচ্চ স্তরের জ্ঞান। যা আমার নেই। আমি সাধারণ মানুষ। স্বল্প জ্ঞানের মানুষের কাছে আল্লাহ কি বা কেমন? নবী-রাসুল কি? তাদের কাছে স্বরণীয় বরণীয় হচ্ছে অলি-আউলিয়াদের বাণী কিংবা কেরামত বিষয়ক কল্পকথা। এসব বিষয়ে তাদের আগ্রহ কম। বিপদে পড়লেই তারা আল্লাহ-ইল্লাহ বেশি করে থাকে। 
আমি সুফী সাহেবের দিকে তাকিয়ে আবারো বললাম-

-হুজুর, আপনি যে হাদিসের আলোকে অর্থাৎ মান আরাফা নাফসাহু ফাক্কাদ আরাফা রাব্বাহু এবং আল ইনসানু সিররি ওয়া আনা সিররুহ এর আলোকে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা বোঝা অনেকটা কঠিন। কিন্ত্তু আমি যদি আমার মতো করে বলি যেমন বাউল সম্প্রদায়ের সাধকরা বলে-আমি যে উপাদান দ্বারা সৃজিত হয়েছি বলতে আমার দেহের উপাদান সমুহ অর্থাৎ আপ, আতস, বাত, খাক, নুর পন্ঞ্চ উপাদান দ্বারা গঠিত হয়েছে। যার মুল উপাদান হচ্ছে হিউম্যান ফ্লুইড অর্থাৎ মণি

-বুঝেছি তুমি কি বলতে চাইছে। বাউল সাধকরা যে বিষয়ের সাধনা করেন সেটা তাদের কাছে সত্য। তারা কোরআনের আলোকেই তা ব্যাখ্যা করেন। কিন্ত্তু আমি মনে করি তারা একটা বিষয়ে ঈশ্বরকে সীমিত করে ফেলেছেন। উপাদান কারণ কখনো স্রষ্টা হতে পারে না। ওটা নিমিত্ত কারণ। কার্যকারণ মতবাদানুযায়ী কার্য দ্বারা কারণ নির্ণিত হয়। সে দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে গেলে দেখা যায় - নাফাকতু ফিহি মিররুহি অর্থাৎ আমার তরফ থেকে রুহ ফুঁকে দিলাম। সেই রুহের ছোঁয়া পেয়েই আদম জীবিত হয়ে উঠলো। এবং আদমকে শ্রেষ্ঠ দানের জন্য ফেরেস্তা দ্বারা স্বীকৃত আদায় করে নেয়া হলো সিজদাহ করার মাধ্যমে
এখানে রুহ্ ফুঁকে দেয়ার অর্থ করেন - রুহটাই হলো আল্লাহ বা রবরুপে স্বরুপ উপস্থিতি। আল্লাহ শব্দটির অর্থ হলোঃ আল+ইলাহ। আল অর্থ হলোঃ প্রতিষ্ঠিত আর ইলাহ অর্থ উপাস্য। সুতরাং আল্লাহ=প্রতিষ্ঠিত উপাস্য। এখানে উপাস্য রুপে যাকেই প্রতিষ্ঠিত করবে সেই আল্লাহরুপে স্বরুপ উপস্থিতি থাকবে। যেমনঃ ধর যে পন্ঞ্চ উপাদানের কথা তুমি একটু আগে বললে কুম্ভকার যখন মুর্তি গড়ে সেখানে কি এই পন্ঞ্চ উপাদানের উপস্থিতি থাকে না? যদি থাকে তাহলে সেই মুর্তি কিন্ত্তু জীবিত নয়। অর্থাৎ রুহ না থাকায় সে জীবিত থাকে না। অথচ দেখ যখন মুর্তি পুজক তাকে বোধন মন্ত্র দেয় তখন তাকে কিন্ত্তু পূর্ব থেকে পৃথক মনে হয়। কেন? কারণ যে মুর্তিটি গড়া হয়েছে সেটা একটা নিমিত্ত কারণ। সেই নিমিত্ত কারণেই যারা তাকে ভগবানরুপে কল্পনা করছে সে তার উপাসনা করছে সে সে রুপেই তাকে কৃপা দান করে যাচ্ছে। কারণ আল্লাহ=আর্দ + সামা অর্থাৎ আসমান এবং জমিনের প্রভু। সৃষ্টির মনের কেন্দ্রবিন্দুটি হইলেন আল্লাহ। অর্থাৎ একমাত্র উপাস্য। যে ব্যক্তি এই সত্যটি না জেনে তার উপাসনা করছে পরন্ত্তু সে তার মনের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা রবেরই কাছে প্রার্থনা করছে। কারণটি কি? কারণটি হচ্ছে মন্ত্র পাঠক ঠাকুর পুরোহিতরা মন্ত্র পাঠক পূর্বক তাতে ফুঁ দেয়। অর্থাৎ সে মনে করছে সে আত্মা প্রতিষ্ঠিত করছে। কারণ সে যে ফুঁ-টি দিল তার ভিতরও কিন্ত্তু রব রয়েছে। রবের ফুঁ তে সে আত্মার সন্ঞ্চারণ ঘটাতে চাইছে
এবার তুমি বিচার কর-আল্লাহ যখন আদম সৃষ্টি করলেন তখন তিনি রুহ ফুকেঁ দিলেন। এখানে ফুকেঁ দেয়ার অর্থ - হচ্ছে রব অর্থাৎ প্রতিপালক রুপে তাকে লালন পালন করা। মাটি দিয়ে যে মুর্তি গঠন করা হলো তাতে আত্মা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পুরোহিত যেমন করে ফুঁ দিয়ে ছিলেন আল্লাহও তেমনি আত্মাকে জাগ্রত করার জন্য ফুঁ দিয়ে ছিলেন। আর সেই ফুঁ-কে বলা হয়েছে রুহ। এখানেও কিন্ত্তু পুরোহিত যেমন তার স্বতন্ত্রতা বজায় রাখছেন ঠিক তদ্রুপ আল্লাহও তার স্বতন্ত্রতা বজায় রাখছেন। এজন্যই বলা হয় - সুফীবাদ যেখানে অনেক গভীরে যেতে পারে বাউলরা ঠিক ততটা গভীরে যেতে পারে না

সুফী সাহেবের কথা শুনে আমি একেবারেই মেরে গেলাম। ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না কি বলবো? কারণ আমি ধর্ম জ্ঞানে অভিজ্ঞ নই। আমরা মুখে বলি আমি মুসলমান। কিন্ত্তু নিজের ধর্ম পালন করা বিষয়ে আমাদের জ্ঞান সীমিত। আমরা আমাদের ধর্ম সর্ম্পকে তেমনভাবে পড়া-শোনা করি না। জানি না শুনি না। না বুঝেই জ্ঞানের ভাব ধরি। ভাবটা এমন যেন সব কিছুই জেনে গেছি। মনে মনে ভাবলাম-নাহ! আমাকে বিষয়ে আরো পড়া শোনা করা দরকার। আমি বললাম

-ঠিক আছে। আজকে সময়ের স্বল্পতার কারণে বসতে পারলাম না। আরেকদিন আসবো। 

আমি চলে যেতে চাইছি শুনে সুফী সাহেব বললেন

- ঠিক আছে। আরেকদিন আসবে। তখন আলাপ করা যাবে। চা খাও তো
 
তার কথা শুনে আমি মৃদু হাসলাম। তিনি ইশারা করতেই একজন উঠে চা আনতে চলে গেল। আর সেই ফাকে সুফী সাহেব বললেন

-তোমাকে একটা কথা বলি। ফরিদউদ্দিন আত্তার তাহার শেষ গ্রন্থ 'লিসানুল গায়িব' পুস্তকে বলেছেনঃ
আঁ খোদাওন্দ, কে দর আরদে অজুদ
হর যমাঁ খোদরা বা-নকশ ওয়া নমুদ;
জুমলা যাতে জাঁহানে মিরআতে উস্ত
হরচে বিনি মুসহাফে আয়াতে উস্ত;
"লাওহে-মাহফুয" আস্ত, দর মা'নী দিলাত
হরচে মি খাহী, শোদ যে হাসেলাত
উনচে মাতলুবে-জাঁহা শোদ দর জাহান
হাম তুরী, বায জো আজ খোদ নেশান।
অর্থাৎ তিনিই সেই আল্লাহ, যিনি শরীরী-জগতে প্রতি মুহুর্তে নব নব রুপে প্রকাশিত হইতেছেন। বিশ্বের সকল অস্তিত্বই তাহার মুকুর। যাহা কিছু দেখিতেছ সমস্তই তাহার প্রকাশ-চিন্হ। প্রকৃতপক্ষে তোমার অন্তরই "লওহে মাহফুয" যাহা কিছু চাও উহা হইতেই তাহার সিদ্ধিলাভ ঘটিবে। যিনি এই বিশ্বে সারা দুনিয়ার কাম্য, তুমিই তিনি। তোমার নিজের ভেতর তাহার সন্ধান কর

নেও বাবা চা খাও

আমি তার কথা শুনে তার চেহারার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তার দ্যুতিময় চেহারার প্রতিবিম্বিত রশ্মি যেন আরো বেশি আলোকিত হয়ে আমার সারা অংগে ছড়িয়ে যাচ্ছে। মনের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। আমি আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করলাম না। তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তার হাতের স্পর্শ পেয়ে যেন আমার মনের হিন্দোল বহুগুণে বেড়ে গেল।অামি তাড়াতাড়ি বের হয়ে এলাম।

-কি কেমন বুঝলি?

আমি কিছু না বলে কেবল মনে মনে বললাম

আঁ খোদাওন্দ, কে দর আরদে অজুদ....