পৃষ্ঠাসমূহ

বুধবার, ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

সারমাদ দারদী আজাব সিকাস্তা কারদী তুনে-পর্ব নয়

(অস্টম পর্বের পর)

-শোন তুই তো মাওলানা জালালউদ্দিন রুমির কথা শুনেছিস। মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমী একদিন তার পিতার সাথে বাজারে যাচ্ছিলেন। সেই সময় দামেস্ক ছিল অনেক সমৃদ্ধ। তো বাজারে যাওয়ার পথে ইবনুল আরাবী (রহঃ) দেখলেন - বালক জালালউদ্দিন রুমী তার পিতার পেছনে পেছনে যাচ্ছে। তিনি মন্তব্য করলেন-একটা পুকুরের পেছনে একটা সাগর হেঁটে যাচ্ছে। পরবর্তীতে দেখা গেল মাওলানা জালালউদ্দিন রুমী যখন বেশ সুনাম কুড়িয়ে দেশ বিদেশে খ্যাতি অর্জন করছেন তখন সামস তাব্রীজীর নাম গন্ধও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। একদিন  সামস তাব্রীজী (রহঃ) মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমীর সামনে দাঁড়ালেন। মাওলানা রুমী তখন ইসলামী ফিকাহ শাস্ত্র পড়াশোনা করছিলেন। তখন  সামস তাব্রীজী(রহঃ)  জিজ্ঞাসা করলেনঃ ই চিস্ত? (এটা কি পড়ছো?)
মাওলানা রুমী(রহঃ) বললেনঃ ইয়া ইলম মাসকে তু না দানা ( এটি এমন জ্ঞান যা তুমি বুঝবেনা)
একথা শুনে সামস তাব্রীজী(রহঃ) মাওলানার সমস্ত বই পাশের নদীতে ফেলে দিলেন। তারপর নদীর মাঝখানে পানির উপর দাঁড়িয়ে সব বই গুলোকে পানি ঝেরে ওঠাতে লাগলেন আর বললেনঃ মাওলানা দেখো, কোন বই আবার ভিজে গেলোনা তো?
এবার মাওলানা রুমী(রহঃ) সামস তাব্রীজী(রহঃ) কে জিজ্ঞাসা করলেনঃ ই চিস্ত? (এটা কিভাবে করলে ?)
উত্তরেসামস তাব্রীজী(রহঃ) বললেনঃ ইয়া ইলম মাসকে তু না দানা ( এটি এমন জ্ঞান যা তুমি বুঝবেনা)
মাওলানা রুমি তখনই সামস তাব্রীজী (রহঃ) এর কদম জড়িয়ে ধরলেন আর কান্না ভেজা গলা নিয়ে বললেনঃ "ও মুরশিদ, তোমার জানা মা'রিফাতের শিক্ষায় আমাকে সিক্ত করো।"
তার পরের ইতিহাস সবার জানা। মাওলানা রুমী(রহঃ) এতোদিন শুধু কিতাব পড়ে মাওলানা হতে পেরেছেন কিন্ত্তু যখনই তিনি সামস তাব্রীজী (রহঃ) এর কাছে আসলেন তিনি হয়ে গেলেন মাওলায়ে রুম। আজকে সমাজে যারা ইলমুল মারেফাত কে বাদ দিয়ে শুধু কিতাবী ইলমকেই আসল মনে করেন তাদেরকে এই ইতিহাসটি আবার স্মরন করিয়ে দিলাম।

-হুম। বুঝলাম। কিন্ত্তু মাওলানা রুমীতো অনেক জ্ঞানী ছিলেন। মাসনবী শরীফতো ওনারই রচনা। তাই না? তুই কি মাননবী শরীফ পড়েছিস? আমি মাহিনকে জিগ্যাসা করলাম। আমার কথা শুনে মাহিন বললো

- পড়েছি। হাল্কা পাতলা। ওটাকে পড়া বলে না।

-আরে ব্যাটা হাল্কা পাতলা আবার কি? জানিস কি না সেটা বল। আমিতো তোকে বলছি না, তুই কি সেটা মুখস্ত করেছিস কি-না?

-হ্যাঁ। তাতো কম বেশি জানি।

-একটা বিষয় বেশ লক্ষণীয়। সেটা হলো - মসনবী শুরু হয়েছে 'ব' তথা বাঁশি দিয়ে। আর  কোরআন শুরু করতে হয়ও 'ব' তথা বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম বলে। ব ( তথা বে ) অক্ষরটি বেশ রহস্যজনক। তাই না?

বিশনু আজ না এচুঁ হেকাইযে মিকুনাদ,
ওয়াজ জুদাই হা শিকাইয়েত মীকুনাদ।
(বাঁশের বাঁশি যখন বাজে, তখন তোমরা মন দিয়া শোন, সে কী বলে। সে তাহার বিরহ বেদনায় অনুতপ্ত হইয়া ক্রন্দন করিতেছে।)
আমার কথা শুনে মাহিনও বলে উঠলো

-কাজ নাইয়াছতান তা মরা ব বুরিদাহআন্দ,
আজ নফিরাম মরদো জন নালিদাহআন্দ।
(বাঁশি বলে আমি বাঁশের ঝাড়ের মধ্যে আপন জনের সাথে সুখে শান্তিতে বসবাস করিতেছিলাম। সেখান থেকে আমাকে কাটিয়া পৃথক করিয়া আনা হইয়াছে। সেই জুদাইর কারণে আমি ব্যথিত হইয়া বিরহ যন্ত্রণায় ক্রন্দন করিতেছি। আমার বিরহ ব্যথায় মানবজাতি সহানুভূতির ক্রন্দন করিতেছে।)
সুফীবাদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য কি জানিস? ভাববাদ। এর গভীরে অর্ন্তনিহিত ভাব। আমার কাছে বড় আশ্চর্য্য লাগে যে- রবের সাধনা সচরাচর করা হয় সেই রব আর  হযরত খাজা বায়জীদ বুস্তামী (রহঃ) কথা শুনে। " রব জিজ্ঞাসা করিলেন,"বায়েজীদ,কী চাও" ? নিবেদন করিলামঃ "যাহা তুমি চাও তাহা চাহি । তিনি আজ্ঞা করিলেনঃ" আমি তোমার যেমন তুমি আমার"। আমি রবকে জিজ্ঞাসা করিলামঃ "তোমার দিকে পথ কী রুপ ? তিনি বলিলেনঃ " আপনার আমিত্ব ভাব ছাড়িয়া দাও আমার নিকটে পৌঁচ্ছাইবে "। একবার এক দরবেশ রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আর বলছেঃ " ওগো আ্ল্লাহ ! তুমি আমার দাস আর আমি তোমার প্রভু।" এই কথা শুনে তো সেই দরবেশকে কতল করার জন্য লোকজন ছুটে এল। কিন্ত্তু দ্যাখ, চিন্তা কর। ব্যাপারটা কি? সে নিজেকেই আল্লাহ বলে দাবী করছে। আর বলছে ওগো আল্লাহ তুমি আমার দাস আর আমি তোমার প্রভু। কেন? কারণটা হলো-আল্লাহ বলেছেনঃ তোমরা আল্লাহর রংয়ে রন্ঞ্জিত হও। অাল্লাহর রং হতে কার রং উত্তম?" অথবা তাখাল্লাখু বি আখিল্লাহ। অর্থাৎ আল্লাহর গুণে গুণাম্বিত হও। তার মানে তুই যদি আল্লাহর রং ধারণ করিস তাহলে আল্লাহ আর তোর মধ্যে কোন পার্থক্য থাকবে না। কারণ পানি কেবল পানিতেই মিশে। আগুন আগুণের সাথে। ধর তোকে একগ্লাস পানি দেয়া হলো এবং এপানি দিয়ে তোকে বলা হল - পরিস্কার রাখার জন্য। যতক্ষণ এ পানি পরিস্কার থাকবে ততক্ষণ ঐ স্বত্ত্বার গুণ ধরে রাখবে। কিন্ত্তু তুই যদি ঐ পানিকে ময়লা করিস,তাহলে পানি শুকিয়ে গেলে ময়লা-আবর্জনা স্তুপীকৃত দেখা যাবে।

-তুই কি ফানার কথা বলছিস?

-শালা। এটা বুঝতে তোমার এতক্ষণ লাগলো? আরো কিছু বললে তো তোকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ভাবছিলাম তোকে আজকে আরো কিছু বলবো?

-বলিস। চায়ের কাপটা দে। রেখে আসি। ভাংলে আবার কিনতে হবে।

মাহিন চায়ের কাপ দেয়ার পর আমি রুমে গিয়ে সেটা টেবিলের উপর রাখলাম। সিগারেটের প্যাকেট আর ম্যাচটা নিয়ে আবার বারান্দায় গেলাম। দেখলাম মাহিন কি যেন চিন্তা করছে। ওকে কেমন যেন অচেনা মনে হচ্ছে। সুফী সাহেবের কাছে যাবার পথে রিক্সায় দেখেছিলাম একরুপ আর আজকে দেখছি আরেক রুপ। কারণটা কি? দুজনেইতো একই সাথে লেখা পড়া করছি আর পার্টটাইম চাকুরি করছি। মোটামুটি স্বচ্ছল না হলেও চলেতো যায়, নেহাৎ সেটাই বা কম কিসের? আমি মাহিন কে জিগ্যেস করলাম

-কিরে কি ভাবছিস?

-কি ভাবছি শুনবি? হযরত খাজা মনসুর হাল্লাজ যখন আয়নাল হ্ক্ক (আমিই সত্য )বলেছিল, সেই সময় খলিফা মুক্কাতাদিরবিল্লাহ মনসুর হাল্লাজের প্রাণদন্ডাদেশ ষষ্ঠবার স্থগিত রাখেন। শেষবারে তিনি এই শর্তে রাযী হন যে, প্রাণদন্ডাদেশের ফতওয়া যদি জুনাইদ বোগদাদী স্বাক্ষর করেন, তবে তা কার্যকর হবে। জুনাইদ বোগদাদী মনসুর হাল্লাজের প্রাণদন্ডাদেশে এরুপ লেখেনঃ শরীয়তের দৃষ্টিতে মনসুরের মৃত্যূদন্ড হওয়া বান্ঞ্চনীয় কিন্ত্তু মারিফতের ভেদ আল্লাহই জানেন। এর পর তার প্রাণদন্ড প্রদান করা হয়। তিনি ধারণা করতেনঃ হযরত মুহাম্মদ (দঃ) নবীদের মুহর;হযরত ঈসা (আঃ) মানব আকারে আল্লাহর প্রকাশ। 'নাসুত ও লাহুত ' মোকাম হযরত ঈসার(আঃ) চরিত্রের দুইরুপ।

-তার মানে কি? হাল্লায কি মিথ্যা বলেছিল? হাল্লায সত্যিই বলেছিল। তিনিই হক্ক তথা সত্য। আর এ ব্যাপারে তো হযরত খাজা গাউছে আযম পীরানে পীর দস্তগীর (রহঃ) বলেছেনঃ আমার ভাই হযরত মুনসুর হুসাইন হিল্লাজের পা পিছলে গিয়েছিল ( পদঙ্খলন হয়েছিল)। কিন্ত্তু সে যুগে তাকে সহায়তা করার মতো কোন কামিল ব্যক্তি ছিল না। আমি যদি তার যুগে যাহির থাকতাম, নিশ্চয়ই আমি তাকে সাহায্য করতাম (আমি তার হাত ধরে ফেলতাম)।

-অামি ভাবছি অন্য কথা। হযরত জুনাইদ বোগদাদীকে সৈয়দুত্তাইফা (দলের নেতা) এবং 'তাউসুল উলামা'(জ্ঞানীদের ময়ুর) বলা হইতো। তো সে কিভাবে হযরত খাজা মানসুর হাল্লাযের প্রাণদন্ডাদেশের রায় লিখলেন?

-কেন সেই রায়ের মধ্যেইতো বলা হয়েছে-"মারিফতের ভেদ আল্লাহই জানেন"। 

-অথচ আশ্চর্য্যের বিষয় কি জানিস? একবার হযরত জুনাইদ বোগদাদীর সাথে 'সুকর ও শওফ প্রসংগ নিয়ে মানসুরের সাথে বচসা হয়। হযরত জুনাইদ তাকে জিগ্যাসা করেনঃ পুনরায় কেন আমার নিকট এসছো? উত্তরে মানসুর বলেনঃ আপনার সান্নিধ্যে থাকতে। জুনাইদ বোগদাদী (রঃ) বলেনঃ পাগলের সাথে আমার কোনই সর্ম্পক নেই। সংযম ও জ্ঞানের অভাবে তুমি উমার ইবন-ই-উসমান, সহল তসতুরী ও আমর মক্কীর সাথে যে ব্যবহার তুমি করেছো তারই কি পুনরাবৃত্তি করতে আমার কাছে এসছো? হে মনসুর, "আনাল হাক্ক" শরীয়াত বিরুদ্ধ কথা। এর জন্য শীঘ্রই তোমার রক্তে কাষ্ঠ খন্ড রন্ঞ্জিত হবে। তদুত্তরে মানসুর বলেছিলেনঃ" হে শায়খ! তখন আপনাকেও সুফীর পোষাক পরিবর্তন করে মৌলভীর পোষাক পরতে হবে। পরবর্তীতে দেখা গেছে ঐ ঘটনা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে।

কথা বলতে বলতে কখন যে দুপুর হয়ে গেছে তা টেরই পাইনি। মাহিনের সাথে কথা বলতে বলতে সেটাও ধরাতে ভুলে গেছি। সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললামঃ

-শোন দুপুরে দুই জনে একসাথেই খাব। তুই আমার এখানেই খাবি । যা আছে দুজনে ভাগযোগ করে খেয়ে নেব।

-যথা আজ্ঞা। এখন সিগারেট দে। আগে খাই তারপর ভাবা যাবে কি করা যায়?

আমিও মনে মনে চাইছিলাম ওর সাথে কথা বলে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে। যতটুকু জেনেছি তাই কম কিসে? প্রশ্নটা হলো লেখা গুলো প্রকাশ করা যাবে না। মোল্লারা যদি শোনে তাহলে তিলকে তাল করা কোন ব্যাপারই না। জ্ঞানের ব্যাপারে যদি স্বাধীনতা না থাকে তাহলে প্রাণ খুলে কথা বলা যায়? আমার কথা হলো - তোর ভাল লাগলে মান না লাগলে ফট। খালি খালি ভেজাল বাড়িয়েতো লাভ নেই। 

-তুই আমার লেখাটা কি করেছিস?

-আছে আমার কাছে। 

-ওটা দে।

-কেন কি করবি? 

-রেখে দেব।

-কেন? আমিতো ভেবেছি সেটা প্রকাশ করে দেব। মামুনকে বললো। ফেসবুকে কিংবা ইন্টারনেটে দিয়ে দেয়ার জন্য। দেখবি মজ।

-আরে ফাজলামি রাখ। কাগজটা দে। আরো কিছু লেখার বাকী আছে।

-আচ্ছা নিস। খাবার পর আবার বসবো। তারপর মাগরিবের পর সুফী সাহেবের সাথে দেখা করবো। তুই কি বলিস?

-যেটা ভাল মনে করিস। 

(চলবে)