পৃষ্ঠাসমূহ

বৃহস্পতিবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

সারমাদ দারদী আজাব সিকাস্তা কারদী-এগারো পর্ব

(পূর্ব প্রকাশের পর)

-তো এই চর্যাপদ ভাষাগত জটিলতার কারণে খুব বেশি জনপ্রিয়তা পায়নি। অথচ পাল আমলে বৌদ্ধ অবলম্বী কবিরাই রাজ সভার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থান করতো। অবশ্য অন্য আরেকটি কারণ হলো গুহ্য সাধন। তাদের সাধন পদ্ধতি বহিরাগতদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। সেকারণেই বোধকরি জনসাধারণ তা জানতে পারেনি। বা গ্রহণ করতে পারেনি।

-অথচ দেখ, বাংলার গৌরব মহাত্ম্য লালন শাহ বাংলার পথে প্রান্তরে তার দর্শন সবার মাঝে অকাতরে বিলিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন।

-কারণটা সম্ভব হয়েছিল ভাষাগত কারণে। লালন শাহ সহজেই পদ রচনা করার ক্ষমতা ছিল। তিনি অতি সহজেই অনেক জটিল এবং তত্ত্বপূর্ণ কথা অতি সহজেই প্রকাশ করতে পারতেন। যেটা চর্যাগীতিতে সম্ভব ছিল না।

-হুম। আমার কাছে আশ্চর্য্য লাগে মুঘল সম্রাজ্যে হিন্দুমতবাদের প্রভাব দেখে।

-সেটা কি রকম? মাহিন জানতে চাইল। আমি বললাম

-কেন তুই জানিস না? জালালউদ্দিন মুহাম্মদ আকবর হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য আনয়নের জন্য দ্বীন-ই-এলাহী নামক একটি ধর্ম প্রচার করার আদেশ দিয়েছিলেন। সে মুসলমানদের কলেমার মধ্যে তার নাম ঢুকিয়ে দিয়েছিল। যে কলেমা পাঠ করা হতো সেটা ছিল-"লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ ওয়া জালালউদ্দিন মুহাম্মদ আকবর খলিফাতুল্লাহ।" অবশ্য সে সময় মুজাদ্দেদ আল-ফেসানী (রহঃ) এর ঘোর বিরোধীতা করে তা রদ করতে বাধ্য করেন।

তাছাড়া সম্রাট শাহজাহানের জেষ্ঠ্যপুত্র দারাশিকো ইসলাম ও হিন্দুধর্মের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য "মাজমাউল-বাহরাইন"(দুই মহাসাগরের মিলন) নামক একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। তিনি সংস্কৃত হইতে রামায়ন, উপনিষদ,গীতা ও যোগাবশিস্ট ফার্সি ভাষায় অনুবাদ করেন। তিনি উপনিষদকে 'সিররে আকবর (শ্রেষ্ঠ গুপ্তভেদ) বলিয়া আখ্যা দেন এবং এর ভুমিকার শিরোনামায় 'ওম শ্রীগণেশ নমঃ' লেখেন। তিনি ধারণা করিতেন 'উম্মুল-কিতাব' সুরা ফাতেহাই হিন্দুধর্মের 'ওম' এর বিশদ ভাষ্য। তাওরাত,যাবুর,ইন্জিল প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থ পাঠ করিয়াও উহাদের ভাব তার বোধগম্য হয় নাই বলিয়া তিনি স্বীকার করেন। তিনি বলিয়াছেন যে, ধর্মগ্রন্থের মর্ম তিনি একমাত্র বেদ ও উপনিষদেই খুজিয়া পাইয়াছেন। উপনিষদকে তিনি আদি স্বর্গীয়-গ্রন্থ মনে করিতেন। তিনি ইহাকে একশ্বরবাদরুপ স্রোতস্বিনীর ঝর্ণাধারা বলিয়া আখ্যায়িত করেন। কোরআন শরীফের আয়াতঃ ইন্নাহু লাক্কোরআনুন কারিম ফী কিতাবিম মাকনুনিল লা ইয়ামাসসুহু ইল্লাল মুতাহ হারুন (অর্থাৎ অবশ্যই ইহা মহাসম্মানিত ক্কোরআন, যাহা সুরক্ষিত গ্রন্থে রহিয়াছে; পবিত্রগণ ব্যতীত কেহই ইহা স্পর্শ করে না।) মধ্যে 'সুরক্ষিত গ্রন্থ' বলিতে দারাশিকো উপনিষদকেই মনে করিতেন। মাজমাউল-বাহরাইন গ্রন্থে তিনি প্রমাণ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন যে, মৌখিক পার্থক্য ছাড়া হিন্দু ও মুসলীম আধ্যাত্মবাদে অন্য কোনই পার্থক্য নাই। ফলতঃ এই গ্রন্থের কারণেই তাকে প্রাণদন্ড দেয়া হয়।

-শুধু সম্রাট আকবর ও দারাশিকোর মধ্যেই যে হিন্দুধর্মের প্রতি উদার মনোভাব পরিলক্ষিত হতো নয়। ভারত উপমহাদেশের অনেক বিখ্যাত সুফীদের মধ্যেও এই প্রভাব দেখা গেছে।

-তুই কার কথা বলছিস? খাজা গরীব নাওয়াজ (রহঃ) এর কথা?

-আরে নাহ। মীর্যা জান-ই-জাহান মযহার (রহঃ) এর কথা বলছি। কেন তুই কি তার নাম শুনিসনি?

-নাহ্।

-তিনি হিন্দুধর্ম সমন্ধে তার এক শিষ্যের নিকট পত্রে এইরুপ মতামত প্রকাশ করিয়াছেনঃ ক্কোরআন শরীফের আয়াতঃ "ওয়া ইমমিন উম্মাতিন ইল্লা খালাফীহা নাযীর অর্থাৎ একটি জাতিও নাই যাহাদের মধ্যে আমি একজন সাবধানকারী পাঠাই নাই। সে অনুসারে ভাতর উপমহাদেশেও নবী প্রেরিত হইয়াছিল। অন্য এক আয়াতঃ "ওয়া লাক্কাদ আরসালনা রাসুলাম মিন ক্কাবলিকা, মিনহুম মান ক্কাসাসনা আলাইকা ওয়া মিনহুম মাল্লাম নাক্কাসুস আলাইকা।" নিশ্চয়ই অামি তোমর(রাসুলুল্লাহর) পূর্বে নবী পাঠাইয়াছি-তাহাদের মধ্যে আমি কাহারো কাহারো নাম উল্লেখ করিয়াছি এবং কাহারো নাম উল্লেখ করি নাই। সে অনুযায়ী রামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ন্ঞ প্রভৃতি নবী ছিলেন এবং এই পরিপ্রেক্ষিতে 'বেদ' ঐশ্বরিক গ্রন্থ যা 'ব্রক্ষ' নামধারী এক ফেরেস্তা মারফৎ নাযিল হয়।

-এটাতো আশ্চয্যজনক কথা !

-এতে অবাক হবার কি আছে?

-কি আছে মানে? তুই রামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ঞকে নবী বলে প্রমান করার চেষ্টা করছিস।

-আমি না ব্যাটা। মীর্যা জান-ই-জাহান। সেতো কোরআনের আলোকেই তা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। ক্কোরআনে মাত্র তেইশজন নবীর নাম উল্লেখ আছে। বাকীগুলো গেল কই? তাছাড়া সংষ্কৃত শব্দে রাম 'র' ও 'ম'। এ দুটো শব্দের অর্থ জানা থাকলে তুই এ কথা বলতি না। সংস্ষ্কৃত 'র' অর্থ আত্মা এবং 'ম' দ্বারা বিশ্ব বুঝায়। সুতরাং রাম শব্দের অর্থ হচ্ছে বিশ্ব আত্মা। শোন তোকে মীর্যা জান-ই-জাহানের একটি ঘটনা বলিঃ

একদা তার পীর হাজী মুহাম্মদ আফদালের নিকট এক ব্যক্তি এক স্বপ্নের বৃ্ত্তান্ত পেশ করেন। স্বপ্নে উক্ত ব্যক্তি এক অগ্নিময় মাঠ দেখেন, যাহার মধ্যস্থলে শ্রীকৃষ্ন্ঞ এবং এক প্রান্তে রামচন্দ্র বিরাজ করিতেছিলেন। তিনি ঐ স্বপ্নের ব্যাখ্যা করেন এইরুপঃ ক্কোরআন শরীফের আয়াত দৃষ্টে সকল জাতির মধ্যেই "বশীর" (সুসংবাদদাতা) ও "নাযির" (সাবধানকারী) আসিয়াছিলেন। তদনুসারে রামচন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ন্ঞ  হয় ধর্মপ্রচারক না হয় সাধক ছিলেন। প্রথম যুগে মানুষকে 'নিসবাত-ই-সুলুক'(সত্যপথ) দেখাইবার জন্য রামচন্দ্র আসেন এবং পরবর্তীযুগে মানুষ আধ্যাত্মিকতায় অধিকতর উন্নত ছিল বলিয়া তাহাদিগকে 'নসবাতে-ই-জযাবী' (ভাবাবেগ) শিখাইবার জন্য শ্রীকৃষ্ন্ঞ আগমণ করেন। নৃত্যগীতের প্রতি শ্রীকৃষ্ন্ঞের অনুরাগ তাহার ঐশ্বরিক প্রেমেরই প্রকাশ। তাহার প্রবল আবেগ, উল্লাস ও প্রেমাগুণ স্বপ্নে-দৃষ্ট মাঠের আগুণ সদৃশ্য যাহার মধ্যস্থলে তিনি বিরাজ করিতেছিলেন। ঐশ্বরিক-পথ-পরিক্রমণ পর্যায়ে রামচন্দ্র শিক্ষানবিশতুল্য বলিয়া তিনি স্বপ্নে-দৃষ্ট অগ্নিময় মাঠের এক প্রান্তে অবস্থান করিতেছিলেন। ইন্টারেষ্টিং না?

-বাহ! সুন্দর ব্যাখা দিয়েছেন।

কথা বলতে বলতে যে কখন চারটা বেজে গেল টেরই পাইনি। অনেকক্ষণ ধরে কথা বলছি। পানির তৃষ্ঞা পেয়ে গেল। সাথে চায়েরও কেমন যেন তৃষ্ঞা পেয়ে গেল। আমি মাহিনকে বললাম

-দোস্ত চারটা বাজে। একটু চা খেয়ে নেই। কি বলিস তুই?

-খারাপ হয় না। তুই চায়ের পানি চুলায় দে। আমি একটু ওয়াসরুম থেকে আসি।

মাহিন আসলে জিগ্যেস করবো- কখন যাবে সুফী সাহেবের খানকায়।

(চলবে)