পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

সারমাদ দারদী আজাব সিকাস্তা কারদি তুনে-পর্ব চৌদ্দ

(পূর্ব প্রকাশের পর)
মাহিনের চুপচাপ অবস্থা দেখে আমার মন খারাপ হয়ে গেল। আমি মাহিনকে জিগ্যাসা করলাম

-এ্যাই মাহিন তোর কি হয়েছে?

মাহিন মনে হয় যেন ঘুম থেকে জেগে ওঠার  মতো চমকে উঠলো

-এ্যাঁ... কি যেন বলছিলি তুই

-বললাম কি হয়েছে তোর?

-আরে তেমন কিছু না। ভাবছিলাম কতো উচ্চ স্তরে বা কোন্ স্তরে গেলে এ ধরণের কথা বলা যেতে পারে? শুনেছি লাহুত মোকামের পর হাহুত মোকাম আছে। তিনি কি সেই স্তরে গিয়ে এ কথা বলেছিলেন কি-না?

-কি লাহুত  ফাহুত মোকাম বলছিস কিছুইতো বুঝছি না।

-তোর বুঝার কথা না। বায়াত নেয়ার পর বুঝতে পারবি। এর আগে এ স্তরের কথা বুঝা সম্ভব নয়। কেননা কোন সাধক কোন স্তরে আছে তার কথার উপর ভিত্তি করেই বোঝা যায়।

আমার আর মাহিনের কথার মাঝে হঠাৎ দরজায় টোকা পড়লো...বাহির থেকে মামুন ভাইয়ের গলা শোনা গেল মাহিন ভাই দরজাটা খোলেন। আমি উঠে দরজাটা খুলতেই মামুন ভাই বললেন

- কি ব্যাপার...দুই বন্ধু বসে কি কথা বলছিলেন?

-তেমন কিছুই না। জাষ্ট ইকবালের সিকোয়া নিয়ে কথা হচ্ছিল। মাহিন বললো।

-তাই? আমিতো আল্লামা ইকবালের সিকোয়াট পড়েছি। সে তো খুবই বাস্তব কথাটাই বলেছে। কেন আপনি রাসুল(সাঃ) এর হাদিসটি শোনেননি?কাল্লিমান নাসা আলা উকুলিহিম... যে যেরকম বুঝে তার সাথে সেরুপ বাক্যালাপ করো। জ্ঞানের কথা অজ্ঞানীর কাছে বললে আপনাকে হয় পাগল নয়তো বদ্ধ উম্মাদ বলবে। কোন কোন ক্ষেত্রে আপনাকে কাফের অথবা মুরতাদ ফতুয়া দিতে পারে। আমাদের সুফী কবি কাজী নজরুল ইসলামকেও তো মোল্লারা কাফের ফতুয়া দিয়েছিল।

-তাই? আমি অবাক হয়ে জিগ্যাসা করলাম। আমার কথা শুনে মামুন ভাই বললেন

-মোল্লারা পারেই কেবল মাথা গরম করতে। তারা মাথা খাটিয়ে কোন কিছু চিন্তা করে না। কারণ তাদের কাছ থেকে দর্শন উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। আঠারো শতকের দিকে বাংলায় প্রতিটি মাদ্রাসায় দর্শন ছিল বাধ্যতামুলক। তাছাড়া অন্যান্য ধর্মও পাঠ্যসুচীর অন্তভুর্ক্ত ছিল। সে সময় একে অন্যের ধর্ম সর্ম্পকে জানতে পারতো। ফলে তাদের মধ্যে ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় থাকতো। তারা একে অন্যের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগদান করতো। সেই সম্প্রীতি ব্রিটিশরা আসার পর নষ্ট করে দেয়। উদ্দেশ্য একটাই। ধর্ম সর্ম্পকে অজ্ঞ করে রাখা। আর এ নিয়ে কোলাহল লেগে থাকলে বড়ো ধরণের ক্ষতি হবে। পারস্পরিক সম্প্রীতি নষ্ট হবে। আর সেটাতে তারা সফল হয়েছিল। আর এর গুরু ঠাকুর ব্রিটিশ গোয়েন্দা হামফ্রে সফল হয়েছিলেন।

-তাই? এ তথ্য আপনি কোথায় পেলেন?

- কোথায়  পেলাম? আপনি ডঃ আহমদ শরীফের বাংলার বাউল এবং ডঃ এনামুল হকের বংগে সুফী প্রভাব বইটাতে পাবেন। শুনেন একটা মজার কথা বলি।হযরত খাজা সামস তাব্রিজী(রহঃ) বলেছেনঃ

হাজার বার বি সায়াম দাহানচে মুশকে গোলাপ
হনুজে নাজ গুফতাম কামালে  বেআদবি।
অর্থঃ হাজার বার কি সায়াম = হাজার স্মরণ করা। দাহানচে মুশকে গোলাপ= ফুটন্ত গোলাপ। হনুজে=দুর হতে। নাজ= সৌন্দর্য। গুফতাম কামালে বেআদবী = যে কামেল হয়ে গেছে।

-অর্থ কি? আমি জানতে চাইলাম।

-মানে হলো যে লোক কামেল হয়ে গেছে সে যদি আপনাকে (হযরত মুহাম্মদ সাঃ) না দেখে ইয়া নবী সালা মালাইকা বলে তবে তার নাম বেয়াদবীর খাতায় উঠিয়ে নিন।

-কারণ কি?

-কারণ জানতে হলে আপনাকে কলেমা তৈয়ব্যার রহস্য জানতে হবে। আপনি দেখেন কলেমা " লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলাল্লাহ "। আপনি যদি প্রথম অংশ  স্বীকার করেনঃ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আর দ্বিতীয় অংশঃ মুহাম্মাদুর রাসুলাল্লাহ" কে অস্বীকার করেন তাহলে আপনি  মৌলবাদী। কারণ আপনি মৌলিক অংশ স্বীকার করে আল্লাহকেই স্বীকার করে নিয়ে মুসলমান বলে দাবী করছেন। অথচ দ্বিতীয় অংশ অর্থাৎ মুহাম্মদীর প্রকাশ ও বিকাশকে অস্বীকার করেছন। তাতে আপনি কি করলেন? আল্লাহর অস্তিত্বকে স্বীকারের পাশাপাশি তার অন্য অংশকে অস্বীকার করছেন। যেটা "লাওলাকালামা খালাকতুল আফলাক" অর্থাৎ আপনাকে সৃষ্টি না করলে কিছুই সৃষ্টি করতাম না। আউয়ালু মা খালাকাল্লাহু নুরী  অর্থাৎ আল্লাহ পাক সর্বপ্রথম আমার নুর সৃষ্টি করেছেন। ওয়া খালাকাল্লাহু নুরী আনামিন নুরিল্লাহে কুল্লু শাইয়েম মিন নুরী। আমি(নবীজি (দঃ)) আল্লাহ পাকের নুর হতে সৃষ্টি আর সমগ্র মাখলুক আমার নুর হতে সৃষ্টি। "ওয়ামা আরছাল নাকা ইল্লা রাহমাতাললিল আলামিন [সুরা আম্বিয়া অায়াত-১০৭]"। আমি আপনাকে সমস্ত জগতের রহমত স্বরুপ সৃষ্টি করেছি। "কুলইন কুনতুম তুহিবুন্নাল্লাহে ফাত্তাবেউনী ইউহাবিকুমুল্লাহ [সুরা আলে ইমরান আয়াত-৩১]" তোমরা যদি আমাকে ভালবাসতে চাও তবে আমার নবীকে ভালবাস। "ইয়া আয়ুহাল্লাযিনা আমানু লা তারফাউ আছওয়াতাকুম ফাইকা ছাওয়াতুন নবী ওয়ালা তাজরুল্লাহুল বিল কাউলে কাজাহারে বাইদেকুম লে বাইদেন আনতা বাদতা আমালুকুম ওয়া আনতুম লা তাশউরুন [সুরা হুজরাত আয়াত-২]"। হে ঈমানদারগণ তোমরা কখনো নবীর কন্ঠস্বরের চেয়ে তোমাদের কন্ঠস্বর উঁচু করিও না এবং তোমরা একে অপরকে যেভাবে ডাকো সেভাবে নবীকে ডেকো না যদি তোমরা তা করো তবে তোমাদের আমলগুলি বরবাদ হয়ে যাবে। "ওয়ামা আতাকুমুর রাসুলা ফা খুজুহু ওয়ামা নাহাকুম আনহু ফানতাহু [সুরা হাসর আয়াত-৭]"। নবী তোমাদেরকে যা দেয় তা তোমরা গ্রহণ কর যা থেকে নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক। তারা তা অস্বীকার করে থাকে। যেখানে আল্লাহ পাক বলেনঃ নবীকে ভালবাস সেখানে আপনি তার ভালোবাসাকে অস্বীকার করছেন। এখন আপনিই বলেন - যারা নবীকে স্বীকার করতে চায় না তাদেরকে কি বলা যায়? তারা যদি প্রথম অংশ স্বীকার করে দ্বিতীয় অংশ গ্রহণ না করে ফলতঃ তারা সৃষ্টির বিকাশকেই অস্বীকার করে থাকে। ফলে তাদেরকে মুসলমান হিসেবে মেনে নেয়া যায় না। কারণ মুহাম্মদকে আপনার স্বীকার করতেই হবে। আপনাকে মুসলমান হতে হলে ঐপুরো কলেমাই পড়তে হবে এবং তাকে মানা ফরজ তথা অবশ্য কর্তব্য। তাকে অস্বীকার করার অর্থ হলো আপনি ইসলামের মৌলিক অংশকেই অস্বীকার করছেন পাশাপাশি আল্লাহর কালামকেও অস্বীকার করছেন।

মামুন ভাইয়ের কথা শুনে আমি জাষ্ট হা হয়ে গেলাম। বলা হয় ইসলাম হচ্ছে - সিরাতুল মুসতাকীম। আমিতো দেখছি সেখানে ইসলাম মানাটা সত্যিই কঠিন কাজ। যেভাবে পালন করা উচিত আমরা কি আদৌ সেভাবে পালন করছি কি-না তা আল্লাহই মালুম।

মামুন ভাইয়ের কথা শেষ হতেই মাহিন বললো

-মামুন ভাই মাহফিল কখন শুরু হবে?

-এইতো দশটার দিকে। আপনারা খাওয়া দাওয়া করে নিন। তারপর আমরা মাহফিলে যাব। সোহেল ভাই আপনি রেডীতো?

-আমাদের খাবারটা উপরে আপনার রুমেই পাঠিয়ে দিন। আমরা এখানেই খেয়ে নেব।

আমাদের খাওয়া-দাওয়া শেষ হতে হতে রাত দশটা বেজে গেল। আর মাইকের আওয়াজে ওয়াজ শোনা যেতে লাগলো। অনেক লোকের সমাগম হয়েছে। রংবেরংয়ের লাইটের জ্বলো নিভু আলো আঁধারের খেলা চলছে বাইরে। লোক জনের কোলাহল। কথোপকথন - সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত পরিবেশ বিরাজ করছিল। আমরা খাওয়া দাওয়া করে মামুন ভাইয়ের রুমেই রেষ্ট নিচ্ছিলাম। ঠিক সেই সময় মামুন ভাই এসে আমাদেরকে মাহফিলে যাবার জন্য তড়িঘড়ি শুরু করে দিলেন। মাহিন বললো ওযু করে নে। আমি অযু করেই মাহিন আর মামুন ভাইয়ের পদাংক অনুসরণ করলাম।
(চলবে)