পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

সারমাদ দারদী আজাব সিকাস্তা কারদী তুনে-পর্ব উনিশ

(পূর্ব প্রকাশের পর)
মামুনভায়ের সাথে চলে গেলাম চায়ের দোকানে।
চা খেতে খেতে মামুন ভাই বললেনঃ
-আমি একটি কথা কিছুতেই বুঝতে পারছি না। সেটা হলো বাবাজান যখন বললেন "পৌঁছে মেরাজ মে আরশে তক মুস্তফা তাব মাবুদ না বান্দা মে পর্দা রাহা" অর্থাৎ যখন মুস্তাফা(সাঃ)মেরাজে গেলেন তখন মাবুদ আর বান্দার মধ্যে কোন পর্দা রইল না। ঠিক আছে। এর পরের লাইনে বললেন-"তাব মালায়েকনে হযরতছে ঝুঁককার কাঁহা ছারি মাখলুকমে হকনোমা তুহি তু "। অর্থাৎ ফেরেস্তারা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর নিকট মাথানত করে বললেন-সারা মাখলুকাতে শুধু তুমিই তুমি। তাহলে কোরআনে যে বলা হয়েছে-ফা আইনামা তুয়াল্লু ফাছাম্মা ওয়াজহুল্লাহ। অতঃপর তুমি যেদিকে তাকাও শুধুই আল্লাহর চেহারা। এছাড়া সুরা রহমানে বলা হয়েছে-কুল্লুমান আলাইহে ফান ওয়াইয়াবকা ওয়াজহু রাব্বিকা জুলজালালেওয়াল ইকরাম। অর্থাৎ যা কিছু আছে সব ধ্বংস হয়ে যাবে শুধু থাকবে কেবল তোমার রবের চেহারা যা জালালিয়াতসম্পন্ন। আবার বদরের যুদ্ধে নবীজি যখন একমুষ্ঠি ধুলি কাফেরদের প্রতি নিক্ষেপ করলেন তখন আল্লাহ বললেনঃ"তুমি নিক্ষেপ করো নাই। আমিই নিক্ষেপ করেছি।" কিছুই বুঝছি না। আল্লাহ আর নবীর মধ্যেতো পার্থক্য থাকার কথা? মালিক আর চাকর কি এক হতে পারে? কি রে ভাই? আপনে কি বলেন? আমার দিকে তাকিয়ে মামুনভাই বললেন।

অামিতো দেখছি মহা বিপদের মধ্যে পড়ে গেলাম। কারণ আমি জানতাম মামুন ভাই যেহেতু সুফী সাহেবের সাথে এখানেই থাকে। তার মানে ধরে নিয়ে ছিলাম তিনি সুফী সাহেবের দর্শন সর্ম্পকে বিশেষভাবে ওয়াকিবহাল। কিন্ত্তু তিনি যে কথা এখন বললেন তাতে তাকে কি বলা যায়? ইয়ানজুরুনা ইলাইকা ওয়াহুম লা ইয়াবসিরুন। অর্থঃ তোমরা তাহাকে দেখিতেছ অথচ দেখিতেছ না। ইয়ানজুরুনা=নজরুন=নজর দেয়া, দেখা। ইয়ারসিরুন=বসিরুন=দেখা তথা দর্শন করা। ইয়া রাসুলুল্লাহ(সাঃ) তাহারা আপনাকে দেখিতেছে অথচ দর্শন করিতেছে না। আল্লাহ পাক রাসুলকে সৃষ্টি করেছেন কেবল তাহার আপন সৃষ্টিকে স্রষ্টার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য। কিভাবে স্রষ্টার দর্শন করিতে হয় তাহা শিক্ষা দিবার জন্যই মেরাজের ঘটনার সৃষ্টি করা হইয়াছে। আমি মাহিনের দিকে তাকিয়ে বললাম

-মাহিন তুই কিছু বল। আমার মাথায় কিছুই কাজ করছে না। মাথার বুদ্ধিগুলো কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেছে।

-আমাকে বলছিস কেন? সেতো তোকে প্রশ্ন করছে। তুই বল।

-আরে ভাই আমিতো বললাম আমার সবকিছু কেমন যেন জট লেগে গেছে। তাইতো তোকে বলতে বলছি।
আমাদের কথা বার্তা বোধ করি চায়ের দোকানে অনেকেই শুনছে। তার ভেতর দেখলাম মুরব্বি স্হানীয় কেউ হয়তো আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। বিশেষ করে আমার দিকেই তার দৃষ্টি নিবন্ধিত। হয়তো আমি এখানে নতুন বলেই তাদের উৎসুক্য দৃষ্টি আমার দিকে নিবন্ধিত। সেই মুরব্বিকে দেখলাম চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে আমাদের পাশের চেয়ারে বসলেন। তিনি বললেন

-কি মামুন সাহেব, কেমন আছেন আপনারা?

-জ্বি ভালো। 

-তা আপনারা কি নিয়ে কথা বলছিলেন?

-কি নিয়ে আবার? সুফী সাহেবের রুমে গিয়েছিলাম। সেখানে তিনি আমাদের রুহ সর্ম্পকে কিন্ঞ্চিৎ কোরানের আলোকে ব্যাখা করে বুঝিয়ে বলছিলেন। তাই নিয়েই আলোচনা করছিলাম।

তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন

-বাবা তোমাকেতো চিনতে পারলাম না। তুমি কি নতুন এসেছো?

-জ্বি।

-আচ্ছা। তোমরা যদি কিছু মনে না করো তো আমি এই ব্যাপারে কিছুই বলতে পারি।যদি তোমাদের আগ্রহ থাকে।

আমরা সমস্বরে বললামঃ

-সেটা হবে আমাদের জন্য সুখকর। আপনি নির্দ্বিদ্ধায় তা বলতে পারেন।

আমাদের কথা শুনে মুরব্বিস্থানীয় ভদ্রলোকটি বললেনঃ

-সুরা মরিয়মের ১৭ নং আয়াতে বলা হয়েছেঃ"ফাততাখাজাত(সুতরাং তিনি[মরিয়ম] গ্রহণ করিলেন) মিন দুনিহিম(তাহাদের হইতে) হিজাবান(পর্দা) ফা আরসালনা(সুতরাং আমরা[আল্লাহ] পাঠাইলাম)ইলাইহা(তাহার দিকে) বাশারান(বাশার[মানুষ]) সাউইইয়ান(পরিপূর্ণ)।" অর্থাৎ সুতরাং তিনি(মরিয়ম) পর্দা গ্রহণ করিলেন তাহাদের হইতে, সুতরাং আমরা(আল্লাহ) পাঠাইলাম তাহার দিকে আমাদের(আল্লাহ)রুহ সুতরাং উহা প্রকাশিত হইল তাহার জন্য পরিপূর্ণ বাশার(মানুষ)।
এই আয়াতে প্রথমেই বলা হলো তিনি তথা মরিয়ম পর্দা গ্রহণ করিলেন। অর্থাৎ তিনি একাকী ধ্যানসাধনায় মগ্ন রইলেন-যে ধ্যানসাধনাটিকে অনেকেই মোরাকাবা-মোশাহেদা বলে থাকেন। তারপরেই বলা হলো, আল্লাহ "আমরা" রুপটি ধারণ করে তথা বহুবচনের রুপ ধারণ করে মরিয়মের দিকে "আমাদের" তথা বহুবচন ব্যবহার করে এক বচনে রুহকে পাঠানো হলো এবং সেই রুহ বাশার-এর রুপ ধারণ করে তথা পরিপূর্ণ মানবের রুপ ধারণ করে তথা পরিপূর্ণ মানবের আকার ধারণ করে তার কাছে দেথা দিলেন। অনেকে তো এখানেও এই "রহানা" শব্দটির অর্থ করে থাকেন জিবরাইল ফেরেস্তা। অথচ জিব্ররাইল ফেরেস্তাকে আল্লাহ রুহও দেন নাই এবং নফসও দেন নাই। আল্লাহর রুহ যে বাশার-রুপটি তথা পরিপূর্ণ মানব-রুপটি ধারণ করতে পারেন-কোরআনেরই এই আয়াতেই তার প্রমান। তার মানে রুহ যে পরিপূর্ণ মানব-আকৃতিও ধারণ করতে পারে এবং যে আল্লাহ রুহ-রুপ ধারণ করে সাধককে দর্শন দান করেন। তাই আল্লাহর ওলি,গাউস,কুতুবআবদাল এবং আরিফেরা বলে থাকেন যে যিনি অথবা যারা আল্লাহর দর্শন লাভ করেছেন তারা আদম-সুরতেই দর্শন করেছেন।এই আদম-সুরতটিকে কোথাও ইনসানরুপ ধারণ করার পরিবর্তে বাশাররুপে পাই। তাছাড়া যে জিব্রাইল ফেরেস্তা আল্লাহর সেফাতি নুরের তৈরী এবং জিব্রাইলের রুহ নাই নফসও নাই। সে জিব্রাইল ফেরেস্তা মানবের আকার ধারণ করে মহানবী এবং মহানবির সাহাবাদের সংগে দর্শন দান করেছেন। জিব্রাইল মানবের আকার ধারণ করলেই যে মাটির বলতে হবে ইহাও যেমন মোটেও সত্য নহে তেমনি মহানবী যদিও আমাদেরই মতো কিন্ত্তু মোটেও মাটির তৈরীতো ননই এমনটি আল্লাহর সেফাতি নুরেরও নহেন। বরং আল্লাহর জাত নুরে নুরময় হলেন মহানবী।যদি তাহাই না হয় তাহলে মহানবির পক্ষে লা-মোকামে প্রবেশ করা একটি অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তাই আল্লাহর অলিরা বলে থাকেন-"দোনোহিকা শেকেল এক হ্যায়, কিসকো খোদা কাহু তথা আল্লাহ ও মহানবীর একই চেহারা, কাহাকে খোদা বলবো?এই লামোকামে যাবার অনুমতি ও রহমতটি মহানবির উম্মতদেরকে দান করা হয়েছে। তাই মাহবুবে এলাহি নিজামউদ্দিন আউলিয়ার প্রধান খলিফা হযরত আমির খসরু লিখিত ফারসি ভাষার কালামে বলা হয়েছে-
খোদা খোদ মিরে মুজলিশ বুদ আন্দার লা মোঁকা খসরু তথা খসরুও লা মোকামে গিয়েছিলেন।

আমরা মুরব্বির কথা শুনে থতমত খেয়ে গেলাম। কারণ আল্লাহ বান্দার সাথে দেখা দেন বাশাররুপ ধারণ করে। নারীর রুহ পুরুষ রুপে দেখা দেয় হযরত মরিয়ম(আঃ)-এর সাথে। তাহলে হযরত আদম (আঃ)এর সাথে যে বিবি হাওয়ার কথা উল্লেখ আছে তাহা কোরআনে আছে জাওজ তথা তার জোড়া হিসাবে। আবার কোরনে আছে হযরত ঈসা(আঃ)কে আল্লাহপাক ঈসা রুহুল্লাহ তথা আল্লাহর রুহ বলে সম্বোধন করেছেন। তিনিই স্বয়ং আল্লাহর রুহের জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ। কিন্ত্তু সাধন তত্ত্বে বিশেষ করে নারী পুরুষের মৈথুনাত্মক চিত্রে অটল হবার প্রশ্নে বারামখানায় যে কাইকে দর্শন করে আগ্রহী তারাও কি রবের এই রুপটি তথা রুহটিকে দেখতে পান? আমি তাকে প্রশ্ন করলাম

-আচ্ছা বাউল সম্রাট লালন শাহের দর্শনে যে সাঁই-কাঁই দর্শনের কথা বলা হয়েছে এবং তারা বারামখানায় সে কাঁইকে দর্শন করতে চান তারা কি রবের এই রুহের দর্শন লাভ করতে পারেন?

আমার প্রশ্ন শুনে তিনি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন

-সবাই যদি অটল হতে চায় তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়ায় তা কি একবার চিন্তা করে দেখেছো?স্রষ্টা চান সৃষ্টিতে তার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকুক। আর তোমরা অটল ধারণায় কি করতে চাচ্ছ? সেই সৃষ্টি প্রক্রিয়াকে রদ করতে চাইছো। ধর একটি মোরগ দিনে ১৮ থেকে ২৪ বার রতি ক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারে। সে যদি তার বীজকে অটল রুপে ধরে রাখে তাহলে মুরগীর কি হবে? ডিম পাবা কোথা থেকে? মোরগতো অটল ধারণায়বদ্ধ থেকে বীজ নিক্ষেপ করা বন্ধ করে দিয়েছে? এখন বল ডিম পাওয়া কি সম্ভব?

তার কথা শুনে আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। আর মাইক হতে জিকিরের শব্দ শুনতে পাচ্ছি-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ...শুধু যিকিরের শব্দই কানে আসছিল...আর কোন কথা মনে আসীছল না।
(চলবে)