পৃষ্ঠাসমূহ

শুক্রবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

সারদাম দারদী আজাব সিকাস্তা কারদী-পর্ব বারো

(পূর্ব প্রকাশের পর)
মাহিন ওয়াস রুম হতে বের হয়ে বির বির করে কি যেন আবৃত্তি করছে। অামি শোনার চেষ্টা করলাম ও কি বলছে? আমি কান পেতে রই এর মতো অবস্থা। শুনলাম ও বলছেঃ

ঈদ গাহে মা গারিবা কুয়ে তো
অর্থঃ এই গরিবের খুশির ঈদের মাঠটি হলো তোমারই গলিতে
উমেরে ছাতে দিদে দিদাম কুয়ে তো
অর্থঃ আমার অতি পরিচিত জীবনসাথীকে তাঁর আসল রুপে তোমারই গলিতে দেখলাম
কাবা-এ-মান কেবলায়ে মান কুয়ে তো।
অর্থঃ আমারই কাবা, আমারই কেবলা তো একমাত্র তোমারই গলিতে
সেজদা গাহে মা আশেকারা আব কুয়ে তো
অর্থঃ প্রেমিকদের সেজদার একমাত্র স্থানটি তো শুধুমাত্র তোমারই গলিতে
ছদ হাজারা ঈদ-ও-কুরবা নাদকুনাম
অর্থঃ কত শত খুশির ঈদ আর কুরবাণি তুচ্ছ হয়ে যায় যখন তোমারই গলিতে অবস্থান করি
আয় হেলালে মা আব কুয়ে তো
অর্থঃ মারেফতের রহস্যের সদ্য উদিত চাঁদ দেখা পাবার স্থানটি তো তোমারই গলিতে
দাস্তে কুশা জানিবে বেদম পীরে মা আব রিনদানে হিম্মতে মা কুয়ে তো
অর্থঃ তোমারই হাতের সোহাগ-মাখা স্পর্শ, ওগো আমার পীর, আমার অন্থত্ব দূর করে দেয়। আর জীবনটা থেকেও মৃত্যূর ছোঁয়ায় রহস্যের আলোতে শিহরিত হয়,
ক্ষণে ক্ষনে অজানা জিগ্যাসায় কেঁপে ওঠে যিনি পা হতে মাথা পর্যন্ত নুরে নুরময়,সেই তুমিইতো আমার পীর। তোমারই নুরের সাহসী ধারা অর্জন করতে পেরেছি বলে কেবল তোমারই গলিতে পড়ে থাকি।
ইয়া নিজাম উদ্দিন মাহবুবে খোদা
অর্থঃ ওগো নিজামউদ্দিন খোদার বন্ধু
জুমলা মাহবুবা গোলামে কুয়ে তো
অর্থঃ কেবলই প্রেয়সী হয়ে আছ তাদের কাছে, যারা  দাসত্বের শৃংখল তোমারই গলিতে আপন ইচ্ছায় বরণ করে নিতে পেরেছে।

-কি রে বিড় বিড় করে কি আবৃত্তি করছিস? আমি চা হাতে নিয়ে আসতে আসতে জিগ্যাসা করলাম

-কি বলছি শুনবি। বলছি হযরত খাজা মোজাদ্দেদ আল ফেসানীর " পীরে আস্ত আউয়াল মাবুদ আস্ত" তোমার পীরই হলো তোমার প্রথম মাবুদ। সেই মাবুদের প্রশংসা করছি হযরত খাজা আমীর খসরু(রহঃ) এর কালামে পাকের মাধ্যমে।

-তাই? আচ্ছা তুই আমার একটা কথার পরিস্কার জবাব দিবি?

-বল।

-তুই কি সুফী সাহেবের কাছে বায়াত নিয়েছিস?

-হ্যাঁ। তোকে মিথ্যে বলবো না। কারণ আমার ইচ্ছে তুইও তার বায়াত নিবি। তারপর দুজনে মিলে তার দর্শন চর্চ্চা করবো। যদি তুই বায়াত হোস তো দুজনে মিলে শেয়ার করতে পারবো মনের ভাবগুলো। সাধারণ মানুষের কাছে এই দর্শন অনেকটা ভুত দেখার মতো হবে। তারা মেনে নিতে চাইবে না। কারণ তাদের কাছে দর্শন নেই।

-তার মানে বায়াত হওয়ার জন্য দর্শনের প্রয়োজন নেই। কিন্ত্তু উচ্চস্তরে প্রবেশ করার জন্য দর্শন প্রয়োজন আছে।বুঝলাম। কি জন্যে তুই আমাকে সুফী সাহেবের খানকায় নিয়ে গিয়েছিলি?

-কেন তোর কি এখনো মনে সন্দেহ আছে?

-কিছুটা আছে বৈকি?

-শোন হযরত খাজা বু আলী শাহ কলন্দর পানিপাথি তার দিওয়ানে কি বলেছেনঃ

হাস্তে দার সিনায়ে মা জলু জানানায়ে মা
বুত পরস্তম দিল মাসাত সানাম খানায়ে মা।
অর্থঃ আমার বুক আমার মাশুকের নুরে ভরপুর। বুত পুরস্তম তথা অামি কেবলই পীরপুজা করি। কেননা আমার হৃদয়টি হলো তথা অন্তরটি হলো পীরপূজার সনমখানা।
গুফতে উখানদা জানানে গারিয়া চুঁ কারদাম বদরশ
বু আলী হাস্তে মাগার আশিকে দিওয়ানায়ে মা।

অর্থঃ যখন আমি মাশুকের দরজায় লুটিয়ে পড়লাম তখনই আমার মাশুক বললেনঃ বু আলী আমারই প্রেমিক, আমারই দিওয়ানা।
আযানে সারি কে বাহ মাহবুব দারম
খাবার না'বুদ কেরামান কাতিবিন রা।
মি নাগানজাদ বু আলী হারগিজ খোদা আন্দার খুদি
তু হামি খোদাই বারি দার কাবায়ে বাজ আসনামোরা।
অর্থঃ অামি ও আমার মাশুকের মাঝে যে গোপন রহস্য লুকিয়ে আছে উহা কেরামান কাতেবিনও জানে না।
হে বু আলী, খোদাকে খুদির মাঝে কখনো সম্পূর্ণ ধরে রাখা যায় না। তাই তো খুদিকে পুণরায় কাবার দিকে নিয়ে যেতে চায়।
কলন্দর বু আলী আজাদে গাশতাম
নাদানাম রুসমেও রাহ কুফুর দীনেরা।
অর্থঃ ধর্ম ও কুফরির মত ও পথের আমার আর কোনো দরকার নাই, যখন বু আলী কলন্দর মুক্তি পেল।

-আচ্ছা খুদিতত্ত্বের দর্শন সর্ম্পকে তোর কি কিছু জানা আছে?

-কার কথা বলছিস?

-আল্লামা ইকবালের কথা বলছি। খুদিতত্ত্ব তথা আত্ম তত্ত্ব সর্ম্পকে বলছি। ইকবাল বলেছিলঃ

খুদি কর এতনা বুলন্দ কে হার তাকদীর ছে পেহেলে
খুদ খোদা বান্দা ছে পুঁছে বাতা তেরা রেজা কেয়া হে।
অর্থঃ তুমি তোমার আত্মাকে এত উন্নত কর যেন তোমার তকদীর রচনা করার পূর্বে খোদা যেন তোমাকে জিগ্যেস করে তোমার ইচ্ছা কি?
আল্লাম ইকবালের কালজয়ী রচনাবলীর মধ্যে খুদী ও রমুজে বেখুদী, শিকোয়া উল্লেখযোগ্য। এই শিকোয়া গ্রন্থের জন্য এক হাজার আলেম তাকে কাফের ফতুয়া দিয়েছিল। কি লিখেছিল জানিস কিছু?

-ধুর ব্যাটা আমি জানবো কিভাবে? পড়িইতো নাই। মাহিন বললো। মাহিনের কথা শুনে আমি মাহিনকে বললাম

-দোস্ত আমি দেখলাম অামি যেটা জানি তুই সেটা জানিস না। আবার তুই যেটা জানিস আমি সেটা জানি না।

-আরে সেজন্যই তো তোকে আমি চাই। আচ্ছা এখন বল শিকোয়ায় ইকবাল কি বলেছিল?

-শুধু মাত্র একটি বাক্যের জন্য কাফের ফতুয়া দিয়েছিল সেটা ছিল-"আল্লাহ তুমি দয়ালু নও"।

-আশ্চর্য্য । অথচ বাট্রেন্ড রাসেল বলেছিলঃ "গড ইজ অল মাইটি টাইরেন্ট।" ঈশ্বর হচ্ছেন জালিমের বাদশাহ। দুই জনের কথা প্রায় একই ধরণের। রাসেল দেখেছিল ম্যানিন জাইটিস ক্যান্সারে শিশুরা ধুঁকে ধুঁকে মারা যায়। তো সে সেই সময় এক পাদ্রীকে জিগ্যেস করেছিলেন - ঈশ্বর কেন এই শিশুদের এমন মারাত্মক রোগ দিয়েছেন? কেন এই শিশুরা তিলে তিলে ধুঁকে ধুঁকে মারা যায়? ঈশ্বর কি পারে না একবারেই মেরে ফেলতে? এত কষ্ট দিয়ে মারার কোন দরকার আছে? জালিম বাদশাহরা যেমন কয়েদীকে নানা প্রকার কষ্টদায়ক শাস্তি দিয়ে মেরে ফেলেন ঈশ্বরও দেখি তার চেয়ে কোন অংশে কম নন। তিনি দেখি জালিমের বাদশাহ।

-আচ্ছা চা খেয়ে নে। তারপর চল বেড়িয়ে পড়ি। অনেকতো হলো।

-ঠিক আছে চল যাই।

চা খেয়ে অামি আর মাহিন দুজনেই বেড়িয়ে পড়লাম সুফী সাহেবের আস্তানায় যাবার জন্য। মাহিনের সাথে আরো কথা বলার প্রয়োজন। অন্য একদিন বলা যাবে।আমরা একটা রিক্সা নিলাম। রিক্সায় ওঠে মাহিন আমাকে জিগ্যেস করলো

-তুই কেস স্ট্যাডি করে কি পেলি?

- যা পেলাম সেটার জন্যইতো যাচ্ছি। দেখলাম কোরআন-হাদীছের আলোকে বায়াত গ্রহণ জায়েজ। আর জায়েজ আছে বলেই প্রখ্যাত প্রখ্যাত আল্লাহর অলিগণ বাইয়াত হয়েছেন। তারা যা করেছেন কোরআন মেনেই করেছেন।

দেখতে দেখতে আমরা খানকার সামনে চলে এলাম। তখন সন্ধ্যা প্রায়ই ঘনিয়ে আসছে।

(চলবে)