পৃষ্ঠাসমূহ

শুক্রবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

সারমাদ দারদী আজাব সিকাস্তা কারদী তুনে-পর্ব তের

(পূর্ব প্রকাশের পর)

সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে আসছে। আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে কি-না জানি না কেমন যেন সবকিছুই নতুন সাজানো গোছানো লাগছে। আশে পাশে একটা ছোট খাটো মেলার মতো বসছে। কেউ বসাচ্ছে বইয়ের স্টল কেউ বা চায়ের দোকান। কেউ বা চটপটির দোকান। কেউ বা ডাব নিয়ে বসছে। আর সণ্ধ্যার প্রায় শেষ মুহুর্তে মাইকের আওয়াজে শুনলাম আযান দেয়া হচ্ছে। আমার বিষ্ময়ের সীমা রইলো না। কেননা এর পূর্বে যখন আসছিলাম তখন এমনটা দেখিনি। আজকের আবহাওয়া পুরোটাই আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। কেন এই পরিবর্তন তা মাহিনকে জিগ্যাসা করতে হবে।আমি মাহিনকে বললাম

-দোস্ত কি ব্যাপার? আগে যখন আসছিলাম তখনতো এমন দেখিনি। আজকে কেমন যেন অন্য রকম মনে হচ্ছে? ব্যাপারটা কি?

-ব্যাপারটা কিছুই না। আজকে এখানে ওরশ শরীফ পালন করা হবে।

-ওরশ শরীফ? সেটা আবার কি?

-সেটা তোকে আজকে নয়। অন্য কোনদিন বলবো। তু্‌ই একটু বোস। আমি আসছি।

মাঝে মাঝে মাহিন দেখি আমার চেয়েও বেশি পাগলামী করে। ওর কোন কিছুই আমি ধরতে পারছি না। কেন যে এমন করে তাও বুঝি না। বিশেষ করে এখানে এলে ও সম্পূর্ণ অন্য মাহিন হয়ে যায়। আমাকে রেখে মাহিন ভেতরে প্রবেশ করলো। অামি একটা চায়ের দোকানে বসে রইলাম। কি করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। কাউকে চিনিও না। কারো সাথে বসে যে একটু গল্প করবো সেইরকম কোন লোকও খুজে পেলাম না। আমি একটি সিগারেট ধরিয়ে দোকানীকে একটা চায়ের কথা বললাম। আর চারপাশের পরিবেশ দেখার চেষ্টা করলাম। ক্রমেই লোক সংখ্যা বাড়ছে। বুঝা যাচ্ছে সবাই সুফী সাহেবের অনুসারী। এরই মধ্যে দেখলাম মাহিন আসছে। সাথে একজন অপরিচিত লোক। তাকে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

-কি রে কি করছিস?

-কি আর করবো? তুই বসিয়ে রেখে কোথায় যেন গেলি আর খুঁজেই পেলাম না।

-পরিচয় করিয়ে দেই। এ হলো আমার বন্ধু সোহেল আর এ হলো মামুন ভাই।

আমার দিকে তাকিয়ে মামুন ভাই বললেন

-আসসালামুআলাইকুম। আপনি বুঝি এখানে নতুন আসছেন?

-ঠিক তা না। আমি এর আগেও দুবার আসছিলাম। কিন্ত্তু এই অনুষ্ঠানে এটাই প্রথম। ঠিক আছে বসেন। চা খান।
আমি দোকানীকে আরো দু কাপ চায়ের কথা বললাম। মামুন ভাই চা খেতে রাজী হলেন না। তিনি চলে যাইতে চাইছেন। তার বিশেষ ব্যস্ততা আছে। আমাদের কাছে অনুমতি নিয়ে মামুন ভাই চলে গেলেন। মামুন ভাই চলে যেতেই আমি মাহিনের কাছে জিগ্যেস করলাম

-আমাকে বসিয়ে রেখে তুই কোথায় হাওয়া হয়ে গেলি আর ফিরলি মামুন না ফামুন তাকে নিয়ে? ব্যাপারটা কি? আমাকে বলতো?

-কিছুই না। মামুন ভাই এখানকার অনুষ্ঠানের দায়িত্বে আছেন। তার সাথে কথা বলার প্রয়োজন ছিল বলেই তোকে বসিয়ে রেখেই অামি তার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।

-কোন জরুরী বিষয়?

-সেটা তুই পরে টের পাবি? এখন বল তোর সেই কথাটা শুনি?

-কোন কথাটা?

-ঐযে আল্লামা ইকবালের শিকোয়ার কথা। যেটার জন্য তাকে কাফের ফতুয়া পেতে হয়েছিল?

-এইখানে? পাগল হয়েছিস?

-কোন সমস্যা নাই।

-সমস্যা আছে। চল অন্য কোথাও গিয়ে বসি। আর সুফী সাহেবের সাথে দেখা করার দরকার না?

-সেটা হবে। তিনি বিশ্রামে আছেন। আজ সারারাত অনুষ্ঠান হবে। ভোর রাতে শেষ হবে। চা টা শেষ করে চল মামুন ভাইয়ের রুমে বসি।

অামরা চা টা খেয়ে বিল দিয়েই মামুন ভাইয়ের রুমে গিয়ে বসলাম। রুমটির এককোণায় বেশ কিছু বইয়ের স্তুুপ দেখতে পাচ্ছি। আরেক পাশে পানির বোতল ও কিছু কাপড়-চোপর। বিছানা বলতে একটা হোগলার উপর তোষক বিছানো। একটা বালিশ আর একটা পরিস্কার চাদর বিছানো। বুঝলাম মামুন ভাই এখানে থাকেন। দরজা খুলতেই কেমন যেন একটা বোটকা গন্ধ নাকে এল। বুঝলাম উনি আমাদের মতোই সিগারেট খান। কোন জানালা না থাকায় গণ্ধটা ভেন্টিলেশনের মাধ্যমে বের হতে পারেনি। রুমে ঢুকেই ফ্যান চালিয়ে দিলাম। আর মাহিন আমাকে বললো নে শুরু কর। আমি আরাম করে বসে বললাম

-আল্লামা ইকবাল বলেছেন
কী হাকছে ফারিশতাউনে ইকবাল কী গমমাজী
গুসতাখ হ্যায় করতা হ্যায় ফিতরাত কি হিমা বান্দী
খাকী হ্যায় মগার ইশকে আন্দাজ হ্যায় আফলাকী
রুমী হ্যায় না শামী হ্যায় কাশী না সামারকান্দী
সিখলাই ফারিশতাউকো আদম কী তরফ ইছনে
আদম কো শিখাতা হ্যায় আদাবে খোদাওয়ান্দী।।
হাকিমী নে মুসলমানী খুদী কি
কালীমে রামজে পিনহানী খুদী কি
তুঝে গুর ফখরে শাহী কা বাতাদো
গরীবি মে নিগেবানী খুদী কি
দায়ারে ইশক মে আপনা মাকাম প্যায়দা কর।।
না তু জমি কে লিয়ে হ্যায় না আসমাকে লিয়ে
জাঁহা হ্যায় তেরে লিয়ে তু নেহী জাঁহাকে লিয়ে
সেতারোঁ সে আগে জাহাঁ আওর ভী হ্যায়
আভী ইশক কী ইনতেহা আউর ভী হ্যায়
ইয়ে হিকমতে মালাকুতী ইয়ে ইলমে লাহুতী
হারাম কে দরদকা দারমা নেহী তো কুচ ভি নেহী।
ইয়ে জিকরে মীম সাবী ইয়ে বোরাক বে সারুর
তেরী খুদী কে নিগেবা নেহী তো কুচ ভি নেহী।
খিরাদ মে ক্যাহ দিয়া লা ইলাহা কো কিয়া হাসিল
দিলো নিগাহ মুসলমা নেহী তো কুচ ভি নেহি।।
নয়া জামানা লায়ে ফিতরাত ছে নাজ বেখুদকো
সখুকে লালা হো গুলসে কালাম প্যায়দা কর
উঠা না সীসা জারা ম্যায় ফরেন দেখে গা
ছাপালে পাকছে মিনা ওয়া জাম প্যায়দা কর
তেরা তারিকা আমিরী নেহী ফকিরী হ্যায়
খুদী না বেচে গরিবী মে নাম প্যায়দা কর
দায়ারে ইশক মে আপন মাকাম প্যায়দা কর।।

-মানে কি? তুই কি এটা শিকোয়ার কথা বলছিস?

-নাহ। এটা ইকবালের একটি বিখ্যাত সুফীবাদী কবিতা।

-বুঝলাম। কিন্ত্তু তুইতো বলেই খালাস। অর্থটা বল।

-শোন

কোন অধিকারে ফেরেস্তারা ইকবালের অতীতের ভুলগুলোর হিসাব লিখবে?
ভুলগুলোর মাঝে আমি তো আজন্ম বন্দি হয়েই আছি।
যদিও মাটির মানুষ আমি, কিন্ত্তু প্রেম উচু আকাশের অধিবাসী করেছে
অামি রুমীও নই, শামীও নই, কাশিও নই আর সামারকান্দীও নই।
ফেরেস্তাদেরকে শিখিয়ে দিলেন খোদা আদমের মর্যাদা সর্ম্পকে
তারপর আদমকে শিখিয়ে দিলেন কেমন করে খোদার নৈকট্য পাওয়া যায়।
খোদা তোমার রহস্যময় পোশাকের ভেতরেই তোমার আমিটির ভেতর লুকিয়ে আছেন।
তুমি কি তোমার বুজর্গির অহংকারের বিষয়টি আমাদেরকে বলবে?
অথচ তুমি গরিব আমিটির মাঝেই তোমাকে দেখার চেষ্টা কর।
জাগ্রত রুহের অধিকারী (প্রেমমন্দির, কামেল গুরু) প্রেমে আপন ঘরটির নুরময় করে তোল।
তোমাকে এই পৃথিবীর তরে নহে আর ঐ আকাশের তরেও নহে
পৃথিবীটা তোমারই জন্য তুমি পৃথিবীর জন্য নহে।
তারকা-রাজ্যের ঊর্ধে আরো সৃষ্টিজগত রহিয়াছে।
জেনে রাখ প্রেমের পরীক্ষা তাহারও ঊর্ধে অবস্থান করে।
ইহা ফেরেস্তা রাজ্যের রহস্যময় হিকমত। ইহা নাই-রাজ্যের জ্ঞান
হৃদয়ের অনুভুতি না থাকলে তো আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।
ইহা মিমেরই স্মরণ একমাত্র প্রশংসা ইহাই দ্রুতগামী বোরাক।
তোমার আমিটার প্রতি যদি দৃষ্টি না থাকে তো কিছুই রইলো না।
সকাল-সন্ধ্যায় তুমি তোমার জীবনের নবযুগের সূচনা কর।
যদি খোদা ইচ্ছা করেন তো তিনি তোমার সুন্দর আমিত্বের বিনাশ করতে পারেন
যদি তুমি তোমার আমিত্বের পরদাটুকু একটুখানি উঠাইতে পার তা হলে সঙ্গে সঙ্গে খোদাকে দেখতে পাবে।
তাহা হইলে তুমি তোমার বিদগ্ধ দাসত্বে থাকিয়াও ফুলের মাঝে কালাম (বাণী)
সৃষ্টি করতে পার।
তুমি তোমার জুব্বার ভেতরে রাখা পানপাত্রটিকে যদি পবিত্র করতে পার।
তোমার পথ তো আমিরি নহে, বরং ফকিরিই তোমার জন্য প্রযোজ্য।
তোমার স্বতীয়তাটিকে বিক্রি না করে বরং গরীবীর খাতায় লিখে নাও।

-কি শোনালি দোস্ত মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

-মাত্র এটুকুতেই? আল্লামা ইকবাল সুফী সাধনায় ফানার পর বাকা বিল্লাহর প্রবর্তন করেন।

-দোস্ত শিকোয়ার কথাটা বললি না?

-বলছি শোন

সুফি কবি আল্লামা ইকবালকে শিকোয়া নামক গ্রন্থের জন্য এক হাজার আলেম কাফের ফতোয়া দিয়েছিল। সেই গ্রন্থের একটি মাত্র বাক্যের জন্য কাফের ফতোয়া দিয়েছিল আর সেই বাক্যটি ছিলঃ "অাল্লাহ তুমি দয়ালু নও"। আরেকটি বাক্যের জন্য আলেম সমাজ খুব বেজার হয়েছিল। সেটি হলোঃ"তুমি সব কিছুই হয়েছ এখন একটি কথা বল তো? তুমি কি মুসলমান হতে পেরেছ? তুম সব কুচ হো বাতা্ও তো মুসলমান ভি হো? দেওবন্দের জাদরেল আলেম হুসায়েন ইবনে মাদানিই কাফের ফতুয়াটি দিয়েছিলেন। সেজন্য সুফি কবি আল্লামা ইকবাল একটি সামান্য গালিও দেননি। বরং নিজেকেই নিজে গালি দিয়ে বলেছিলেন যে, এই গোপন কথাগুলো তোমাকে (অাল্লাহকে) বলা ঠিক হয়নি। তাই আমাকে শাস্তি উপহার দাও আর যারা কাফের ফতোয়া দিয়েছেন তাদেরকে জান্নাত দান কর। ভারি মাজমো মে রাজ কি বাত ম্যায়নে কাহদি। বাড়া বেয়াদব হু ম্যায় সাজা চাহাতা হু। তারপর ইয়ে জো জান্নাত তুনে বানায়া দে দো মোল্লা কো। সত্যিই অবাক লাগে! কত মহান বিরাট মনের অধিকারী হতে পারলে এমন কথাগুলো বলতে পারেন। যে কারণে কাফের ফতোয়া দেওয়া হয়েছিল তা হলো এইঃ
সাফায়ে দাহের সে বাতেল কো মিটায়া হামনে
নওয়ে ইনসান কো গোলামি সে ছোড়ায়া হামনে
তেরে কাবেকো জামিনো সে বাসায়া হামনে
তেরে কোরানকো সিনোসে লাগায়া হামনে
ফের বি হামসে ইয়ে গেরা হ্যায় হাম অফাদার নাহি!
হাম অফাদার নাহি! তু ভি তো দিলদার নাহি।
অর্থঃ বিভ্রান্তিকর মতবাদের কবর রচনা করেছি আমরাই
দাসত্বের শৃংখল হতে মানুষকে মুক্ত করেছি আমরাই
ধরণীর বুকে তোমার কাবাকে পরিচয় করেছি আমরাই
তোমার কোরান বুকে ধারণ করেছি আমরাই
তারপরেও অনুগত নও বলে অপবাদ দাও আমাদের!
আমরা অনুগত নই! (তা হলে) তুমিও তো দয়ালু নও।

আমার কথা শেষ হতেই দেখলাম মাহিন যেন কোথায় হারিয়ে গেছে.......
(চলবে)