পৃষ্ঠাসমূহ

সোমবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

সারমাদ দারদী আজাব সিকাস্তা কারদী-পর্ব সাত

(ষষ্ঠ পর্বের পর)
সুফী সাহেবের কাছে আসার পর রুমে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে দিলাম। শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। কিছু না ভেবেই অলস শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিলাম। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের একটা সিগারেট বের করে ধরালাম। মোবাইলটা বের করে দেখলাম কেউ কল করেছে কি-না? সাইলেন্ট মুডে থাকায় টেরই পাইনি শ্বেতা কল করেছিল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সোয়া চারটা বেজে গেছে। চোখে রাজ্যের ঘুম চলে আসছে। বিশ্রাম নেয়া প্রয়োজন। আমি সিগারেটটা শেষ করেই সটান শুয়ে পড়লাম।

কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। ঘুম ভাংলো সাড়ে আটটার দিকে। খিদেই পেট চো চো করছে। খাওয়ার জন্য হোটেলে গেলাম। খাওয়া শেষ করে এক প্যাকেট সিগারেট কিনলাম। তারপর রুমে এসে দরজা লাগিয়ে চিন্তা করতে লাগলাম সুফী সাহেবের কথাগুলো। মোবাইল বন্ধ করে দিলাম। খাতা কলম নিয়ে বসলাম। আমাকে কেস স্ট্যাডি করতে হবে। পুণঃ পুণঃ চিন্তা করতে হবে। প্রথমেই আসি কলেমা তায়্যিবা সর্ম্পকে। শিরোনাম দিলামঃ

কালিমা তায়্যিবাঃ লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসুলাল্লাহ।

সুফী সাহেব বলেছেনঃ লা+ইলাহা+ইল্লা+আল্লাহ+হু+মোহাম্মদ+রাসুল+আল্লাহ।
লা-অর্থ শুন্যাবস্থা তথা মহাশুন্য। ইলাহা=উপাস্য। ইল্লা=ব্যতীত ।আল্লাহ=আল+ইলাহ। মোহাম্মাদুর রাসুল্লাহ=মোহাম্মদ আল্লাহর রাসুল। ইলাহ=উপাস্য। উপাস্য বলতে আমরা কি বুঝি? আমরা বুঝি যার উপাসনা করা হয়। কার করা হয়? আল্লাহর। আল্লাহ কি? আল+ইলাহ। আল=প্রতিষ্ঠিত উপাস্য। অর্থাৎ যাকে আমি প্রতিষ্ঠিত করলাম। কাকে করলাম? যে আমার মনের রাজ্যে বিরাজিত। কারণ আল বলতে সর্ব প্রকার বা সমগ্র বুঝায়। আর্দ ও সামার কেন্দ্র বিন্দুই আল্লাহ। আল্লাহু নুরুন সামাওয়াত ওয়াল আর্দ। আল্লাহ আসমান এবং জমিনের নুর। তাহলে নুর কি? নুর অর্থ অালো। আলো কি? শক্তি। সত্যিকার অর্থেই কি শক্তি বোঝায়? নাকি অন্য কিছু বোঝায়? ধরি শক্তিই বোঝায়। তাহলে এই শক্তির আলোকে আমি চলা ফেরা করি। খাই দাই ঘুমাই। সব কিছুই করি। কিন্ত্তু তিনি বলেছেন কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থানরত। তাহলে শক্তির কেন্দ্র বিন্দুতে তো কি কিছু অবস্থান করছে? কি অবস্থান করছে? বিজ্ঞানীরাতো শক্তি ছাড়া আর কিছুই পাননাই। জগত চলছে শক্তির দ্বারা। তার মানে কি? এই শক্তিই কি সেই মহা শক্তিরই অংশ? তাহলে কি 'হু' দ্বারা সেই মহাশক্তির দিকেই ইংগিত করা হয়েছে? সেই হু'কে তো পরক্ষণেই মোহাম্মাদুর রাসুল্লাল্লাহ বলা হয়েছে। বলা হয়েছে নুরী মোহাম্মদই সৃষ্টির বিকাশ ও প্রকাশ। নুরী মোহাম্মদীই সৃষ্টির প্রকাশ হয়ে চলছে।স্বয়ং হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) বলেছেনঃ আউয়ালু মা খালাকাল্লাহু নুরী। আল্লাহ পাক সর্বপ্রথম আমার নুর সৃষ্টি করেছেন।  আনা মিন নুরুল্লাহি ওয়া কুল্লু শাইইম মিন নুরী। আমি আল্লাহর নুর হইতে এবং বিশ্বজগত আমার নুর হইতে। তার মানে কি? সৃষ্টির প্রকাশ ও বিকাশ হচ্ছে মুহাম্মদী নুরের ধারা হতে?
আমিতো তাই দেখছি। কিন্ত্তু আমার মনের মধ্যে যদি শয়তানী থাকে তাহলে প্রতিষ্ঠিত আল হিসাবে তাকেই উপাস্য হিসাবেই তারই ইবাদত বন্দেগী করছি না? তাহলে উপাস্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত কোন কিছুই স্হায়ী হচ্ছে না। কেননা মন সর্বদাই পরিবর্তনশীল। পরিবর্তনশীল মন নিয়া কিভাবে আল ইলাহ প্রতিষ্ঠিত করা যায়? এ ব্যাপারটা জানা জরুরী। এই জরুরী বিষয়টিতে একটি মার্ক করা দরকার। কেননা এখানে যাকেই প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে সেই ইলাহ রুপে প্রতিষ্ঠিত হয়ে কলেমার মধ্যে তথা তৌহিদে অবস্থান করছে।

আমার মাথায় আর কিছুই ধরছে না। এ পর্যন্ত লিখে একটা সিগারেট ধরালাম। মনে মনে চিন্তা করলাম-সুফী সাহেব এ ব্যাপারে আর কি কি বলেছেন? হটাৎ আমার মনে পড়লো- একজন মোমিনের কথা। কারণ মোমিনের জন্য কোন আদেশ নাই। মোমিন দ্বারা পরিচালিত হলে তিনিই পথ দেখাইতে পারবেন। আমি আর দেরী না করেই আবার লিখতে বসলাম।

তৌহিদ সাগরে অবস্থানের জন্য প্রথম প্রয়োজন হচ্ছে মুসলিম হওয়া। মুসলিম হলেই মোমিনের নির্দেশেই কাজ করলে আমানু হওয়া যায়। আমানু হলেই আদেশ-নির্দেশ কোরআন মজীদেই পাওয়া যাবে। কেননা তিনি বলিয়াছেন - কোন একজন নবীর প্রচারিত নীতিকে স্বীকার করিয়া তাহার নিকট অথবা তাহার নীতির অনুসারী প্রতিনিধির নিকট আত্মসর্মপণ করিলে তাহাকে বলা হয় মুসলিম অর্থাৎ আত্মসমর্পণকারী। মোমিন হওয়ার জন্য ঈমানের কাজ করিতে থাকিলে তাহাকে বলা হয় আমানু। আর ঈমান অর্জনের পথে পূর্ণ সফলতা যখন অর্জিত হইয়া যায় তখন আমানু মোমিন হইয়া যান। তাছাড়া কেন্দ্রবিন্দুতে থাকার যে পদ্ধতি তাহা যিনি নিজের জীবনে পদ্ধতিস্থ করিয়াছেন তিনিই রসুল। রসুল অর্থ প্রতিনিধি। কোরানের পরিভাষাগত অর্থে আল্লাহর প্রতিনিধি অথবা কোন নবীর মনোনীত প্রতিনিধি নবীর প্রতিনিধিত্ব করা আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের শামিল। তার মানে কি দাঁড়ালো? তার মানে দাঁড়ালো কেবলমাত্র রসুল পর্যায় যারা তারাই কেবল তৌহিদ সাগরে অবগাহন করতে পারবে। মোহাম্মাদুর রাসুল্লাল্লাহ মানে তো তাহলে মোহাম্মদ আল্লাহর মনোনীত রসুল। কেননা আর্দ ও সামা দৈহিক ও মনোজগতে তিনিইতো কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। নুরে মোহাম্মদী সর্ম্পকে তিনি বলিয়াছেনঃ যে কোন একজন মোহাম্মদ দ্বারা অর্জিত স্বর্গীয় চরিত্র এবং গুণাবলীকেই 'নুরে মোহাম্মদী' বলে। নুরে মুহাম্মদীর বিকাশ লাভের জন্যই সমগ্র সৃষ্টির প্রয়োজন হইয়াছে। অথচ 'নুরে মোহাম্মদী' শব্দটি কোরনে কোথাও একত্রে নাই। একই রুপে দেখা যায় "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মোহাম্মাদুর রাসুলাল্লাহ" কথাটি কোরনে একত্রে উল্লেখিত নাই অথচ ইহা সকল ধর্মের এবং কোরানের মুলমন্ত্র।

তার মানে কি? এজন্যই কি মানসুর হাল্লাজ বলিয়াছিলেনঃ"আনাল হক্ক।" আমিই সত্য। হযরত খাজা বায়জীদ বোস্তামী বলিয়াছিলেনঃ"আনা সুবহানী আজিমুশশানী। আমিই সোবহানের শান। জুনায়েদ বোগদাদী বলিয়াছিলেনঃ"লাইছা ফি জুব্বাতি ছেওয়া আল্লাহ তায়ালা"। এই জুব্বার ভেতর আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কিছুই নেই। হযরত খাজা সামস তাব্রীজীি বলিয়াছিলেনঃ" জামালে খুদ জামালে ইয়ারে দিদাম (আমার পীরও আমি আবার আমার মুরিদও আমি;) বা শাকালে শায়েখে দিদাম মোসতফারা, না দিদাম মোস্তফারা বালকে খোদারা (পীরের সুরতে নবীকে দেখলাম ওটা নবি নয়, বরং স্বয়ং আল্লাহ)"। এছাড়া  হাজা হাবিবুল্লাহ মাতা ফি হুব্বুল্লাহ শাহেন শাহে ওলি আফতাবে অলি সুলতানুল হিন্দাল অলি, আতায়ে রসুল ইয়া বাবা সাইয়্যেদ মাওলানা মইনুদ্দিন হাসান সান্ঞ্জারী আল হোসাইনি ওয়াল হাসানী বলেছিলেনঃ ই-মানাম ইয়ারাম কে আন্দার নুরে হক ফানী শুদাম, মাতলায়ে আনোয়ারে জাতে সুবহানি শুদাম। অর্থাৎ আমার ভেতর আমার বন্ধুটির হকে ফানা হয়ে গেছি,তাই যে নুরের বিকিরণ হচ্ছে সেই নুর কেবলমাত্র সোবহানীর। তার মানে কি তারা সবাই রসুল ছিলেন। তৌহিদ সাগরে অবগাহন না করলে তো এসব কথা বলা যায় না ?

কিন্ত্তু কলেমায় তো অংশীদার করা মানে শিরিক করা। তারা কি শিরিক করছেন না? যদি তারা শিরিকই করে থাকেন তো প্রচলিত মতে তাদের কি বলা যায়? তাহলে তারা কি জানতেন না যে শিরিক করা আল্লাহ পাক ক্ষমা করবেন না? শিরিক করা জঘণ্যতম অপরাধ? তারা কি কোরআন জানতেন না? না তারা পড়তে পারতেন না? নাকি তারা না জেনেই এই জঘন্য(?) অপরাধটুকু(?) করে ফেলেছেন(?)-ব্যাপারটা তো আমাকে ভাবিয়ে তুললো? তারা কোন্ দৃষ্টিকোণ থেকে এ ধরণের অপরাধ(?) করতে পারেন(!)?-বিষয়টা জানা জরুরী।

এতটুকু লিখে আমি একটি সিগারেট ধরালাম। তারপর চিন্তা করতে লাগলাম। আসলে ব্যাপারটা কি হতে পারে? শিরক শব্দ টির অর্থ হচ্ছে - অংশীদার করা। ভাগীদার করা। অংশীদার হয় মনে। দেহে নয়। কেননা দেহ দ্বারা অংশীদার করা যায় না। মনের গতি-প্রকৃতিই ইবাদতে অংশীদারীত্বের সৃষ্টি করে। এজন্যই কি সুফী সাহেব বলিয়াছিলেন ইবাদতের জন্য প্রয়োজন হচ্ছে - ইশক বা প্রেম। কিন্ত্তু নিরাকার খোদার সাথে কি প্রেম করা সম্ভব? বস্তু আকারে না আসলে তো জ্ঞান লাভ হয় না। জ্ঞান লাভ না হলেও তা অলীক বস্ত্তু। তথা ঘোড়ার ডিম ব্যতীত আর কিছুই নহে। তার মানে কি? আমি আর দেরী না করে লিখতে শুরু করলামঃ

অংশগ্রহণকারী বা অংশীবাদীকে মোশরেক বলে। অদৃশ্য এক আল্লাহকে সর্বময় কর্তা স্বীকার করিয়াও যাহারা অন্যান্য সৃষ্টির কর্তৃত্ব এবং অধীনতা মানিয়া লয় তাহারা মোশরেক। কোন বস্তু বা বিষয়ের প্রতি দেহেরে নয় মনের অংশগ্রহণের ভাবকে তথা মোহকেই শেরেক বলা হয়। বস্তু জগতের সংগে শেরেক করা বিষয়টি দুনিয়াবাসী মানব মনের স্বভাব ধর্ম। সৃষ্টিতে শেরেক নাই। শেরেক মানব মনের রচিত এক ব্যাপক ও সূক্ষ্ম অপরাধ। মোমেন ব্যক্তির জীবনাদর্শ গ্রহণ করিয়া এই অপরাধ মন হইতে ত্যাগ করিতে পারিলেই মনে তৌহিদের প্রতিষ্ঠা হইয়া থাকে। এজন্যই কি সুফী সাহেব পুরুষ ইলাহর কথা বলিয়াছিলেন?

উপরোক্ত বিষয় হইতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে যে, কোন একজন মোমিন ব্যক্তির নিকট আত্মসমর্পণ করতে হবে। তবেই মুসলিম বলে পরিচয় দিতে পারবো। তার মানে কি আমি এখনো মুসলিম নই? নইতো। কেননা মহাপুরুষদের জীবনী লক্ষ্য করলেইতো বিষয়টি স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। জগত বিখ্যাত সবাই গুরু তথা মুর্শিদ ধরেই প্রথমে মুসলমান হয়েছেন। অতঃপর আমানু হতে মোমিন হয়ে তৌহিদ সাগরে ডুব দিতে পেরেছেন। আমাকে সেই সাগরে অবগাহন করতে হলে অবশ্যই আত্মসমর্পণ করতে হবে। তথা বায়াত নিতে হবে। কিন্ত্তু বায়াত সমন্ধে কোরআনে কি কোন ইংগিত আছে? এ বিষয়টি নিয়ে পরে ভাববো। আজ এ পর্যন্তই।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত প্রায় পৌনে দুইটা বাজে। আর দেরি করলাম না। লেখা বন্ধ করে ঘুমানোর আয়োজন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। (চলবে)