পৃষ্ঠাসমূহ

সোমবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

শিমুল তলীর মেলা


আজ একটি বিশেষ দিন আজ পনেরোই অগ্রহায়ণ এই পনেরো তারিখেই শিমুল তলীতে একটি মেলা হয় সেই মেলায় বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষজন দুর দুরান্ত হতে ছুটে আসে মেলাতে বসে নানা প্রকার দোকানপাট রাতে চলে যাত্রা আর বাউল গানের আসর মেলার আয়োজক মকসুদ মিয়া একজন প্রভাবশালী লোক দশ গ্রামের মানুষজন তাকে সমীহ করে চলে অঢেল সম্পত্তির মালিক তিনি জমি-জমার কমতি নেই মেলা উপলক্ষে তিনি ব্যস্ত দিন যাপন করছেন কোথায় কি হচ্ছে, কে কি করছে তার খোঁজ খবর রাখছেন সাথের লোক জন সবাই ছুটোছুটি করছে সবাইকেই দাওয়াত দেয়া হয়েছে মেলার প্রধান অতিথি রাখা হয়েছে আফজাল স্যারকে তিনি হাবিবপুর ডিগ্রি কলেজের দর্শন বিভাগের শিক্ষক

যথা সময়ে মুল অনুষ্ঠান শুরু হলো। একদিকে যাত্রা পালা। অন্য দিকে বাউল গান। লোকজন এদিক ওদিক ছুটোছুটি শুরু করে দিল। একবার যাত্রার দিকে আরেক বার পালা গানের দিকে। অতিথিদের জন্য দু জায়গায়ই বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সমস্যা শুরু হলো যখন যাত্রা আরম্ভ হলো তখন মাইকের আওয়াজে গানের কথা শুনা যেতে লাগলো। আবার যখন গানের অনুষ্ঠানে যাওয়া হয় তখন কানে আসে যাত্রার ডায়ালগ। কোন জায়গায়ই স্থিরতা নেই। অরাজগতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে এটি

আফজাল সাহেব কাউকে কিছু না জানিয়ে উঠে এলেন।  বিশাল স্থান জুড়ে মেলা চলছে। মাইকের ব্যবহার বেশি হওয়ায় এমনটা হয়েছে। কিন্ত্তু এরই মাঝে এককোণে দেখা গেল পুতুল নাচের আয়োজন করা হয়েছে। পুতুলগুলো সুতোর টানে নাচানাচি করতে লাগলো। আর পুতুল নাচের মুল কর্তাব্যক্তি গলার স্বর বিভিন্ন ভংগি করে সেগুলো নাচাচ্ছেন। আফজাল সাহেব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই পুতুল নাচ দেখতে লাগলেন

মাকসুদ সাহেব আফজাল স্যারকে কোথাও না দেখে যাত্রা পালা থেকে গেলেন বাউল সংগীতের আসরে। সেখানেও তাকে না পেয়ে হতাশ ভংগিতে বাইরে এসে দাঁড়ালেন। দেখলেন শিমুলতলার ঠিক নীচের দিকে অনেক লোকের জটলা। তিনি সেদিকটায় গেলেন। দেখলেন আফজাল স্যার মুগ্ধ দৃষ্টিতে পুতুল নাচ দেখছেন। তিনি আফজাল স্যারের পাশে এসে দাঁড়ালেন। তিনিও মুগ্ধ হলেন পুতুল নাচ দেখে। আফসার স্যার মকসুদ সাহেবকে দেখে বললেন চলুন চা খেয়ে আসি। তার পর তারা মুকতার মিয়ার চায়ের দোকানের দিকে গেলেন। চায়ের দোকানী দুজন সম্মানী ব্যাক্তিকে দেখে বসার স্থানটা ভালো ভাবে পরিস্কার করে বসতে দিলেন। তারা দুজনে সেই স্থানে বসলেন। মকসুদ সাহেব আফজাল স্যারকে জিগ্যেস করলেনঃ

-আফজাল সাহেব কি রকম দেখলেন?

আফজাল সাহেব অন্যমনস্ক থাকায় প্রথমে সে কথা শুনতে পেলেন না। তাকে আবারো মকসুদ সাহেব জিগ্যেস করলেন

-আফজাল সাহেব কি রকম দেখলেন?

-ভালো। তবে মাইকের ব্যবহারটা বেশি হয়ে গেছে

-তা যা বলেছেন। সবইতো দেখলেন। আপনার কাছে কোন্ টা বেশি ভালো লেগেছে?

-সবই ভালো লেগেছে। তবে আমি উপভোগ করেছি পুতুল নাচ

-কেন? বাউল গান কি শুনেননি

-তা না। শুনেছি। কিন্ত্তু গানের কথা শুনতে কষ্ট হয়েছে

-আর সেজন্যই বুঝি পুতুল নাচ দেখছিলেন?

-হ্যাঁ। ঠিক ধরেছেন। পুতুল নাচ দেখতে দেখতে একটা কথা খুব বেশি মনে পড়ে গেল। সেটা নিয়েই ভাবছিলাম

-কি ভাবছিলেন জানতে পারি?

মুকতার মিয়া তাদের দিকে চা দিয়ে দুজনের কথার দিকে মন দিলেন। আফজাল স্যার বললেনঃ

-"The world is a big state and men and women are merely players." William Shakespeare এই কথাটি বলেছিলেন। যার অর্থ হলোঃ এই বিশ্বটা হলো বিশাল একটা নাট্যশালা। নারী-পুরুষরা সেই নাট্যশালায় যার যার ভুমিকায় অভিনয় করে যাচ্ছে। দেখেন একজন নাট্যকার নাটকে চরিত্র সৃষ্টি করে। সেই চরিত্রে যে যার যার ভুমিকায় অভিনয় করে। কেউ ভিলেন হয়। কেউ নায়ক হয়। কেউ নায়িকা বা পার্শ্ব নায়িকার ভুমিকায় অভিনয় করে। স্রষ্টা যে নাটক রচনা করেছেন আমরা সবাই সেই চরিত্রে যার যার ভূমিকায় অভিনয় করে যাচ্ছি। দ্যাখেন সুরা বাকারায় আল্লাহ পাক আদম নামক চরিত্র সৃষ্টি করে তার জাওয়জ সৃষ্টি করলেন হাওয়া নাম দিয়ে। আর ভিলেন চরিত্রে অভিনয় করার জন্য শয়তানকে সৃষ্টি করা হলো। উদ্দেশ্য হচ্ছে এই দুনিয়া নামক বিশ্ব নাট্যশালায় তার রচিত পান্ডুলিপির বাস্তবায়ন করা। শয়তান নামক চরিত্রটি কখনো ইবলিশ কখনো খান্নাস কখনো বা মরদুদ নামক চরিত্রে অভিনয় করে যাচ্ছে। অন্যদিকে আদমকে তার জাওয়জ দিয়ে নাম চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ দেয়া হলো

-স্যার তাইলে তো দেখতাছি আমাগো কুন দোষ নাই। আমাগো চরিত্রে অবিনয়ের সুজুদ দিছে আমরা করতাছি। আমাগো কি দোষ? মুকতার মিয়া আফজাল স্যারের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললেন

আফজাল স্যার চায়ে চুমুক দিয়ে বললেনঃ

-তোমার কথার দর্শন আছে। তোমাকে নাট্যকার বলে দিয়েছে তুমি যদি কাজ করতে রাজী থাকো তাহলে অভিনয় করো। আর যদি রাজী না থাকো তো অভিনয় করো না

-ব্যাপারডা বুজবার পারলাম না

-শোন। আল্লাহ পাক যখন আদমকে সব শিখিয়ে পড়িয়ে বলে দিলেন তোমরা গাছটির কাছে যেও না। যদি যাও তো তোমরা জালিমের পর্যায়ভুক্ত হবে। সেই কথা অমান্য করে তোমরা সেই গাছটির কাছে গেছ এবং সেই গাছের ফল গন্দম খেয়েছো। স্রষ্টার কথা শোনোনি

-আফজাল ভাই গন্দম ফলের ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলুন। মকসুদ সাহেব বললেন। সেই কথা শুনে আফজাল স্যার কিছুটা দ্বিধায় পড়ে যান। তিনি চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন তারা ছাড়া আর কেউ নেই। এই নীরবতায় তিনি বলা শুরু করলেন

-গন্দম ব্যাপারটা বুঝতে হলে আপনাকে গমের দিকে তাকাতে হবে। দেখবেন গমটা দেখতে যেরকম ঠিক সেই রকম হচ্ছে স্ত্রীজনন ইন্দ্রিয়। সেই ফলটা রুপকের আড়ালে গন্দম নামকরণ করা হয়েছে। আদম তার জাওয়জ সেই ফল ভক্ষন না করলে দুনিয়ার সৃষ্টি হয় না। তাই সেই ফল খাওয়ার জন্য শয়তান নামক ভিলেন চরিত্রে অভিনয়রত নফসে আম্মারার সৃষ্টি করা হলো। সেই নফসের প্ররোচনায় আদম সেই ফল ভক্ষণ করলো। পরিণতিতে সে দুনিয়ায় আসলো। আসার পর সে যখন বুঝতে পারলো এটাতে রবের সম্মতি তথা গোপন ইরাদা ছিল তখন তার সাহায্য প্রার্থনা করলো। কারণ কোরআনে বলা হয়েছে - "ইন্নামাল নাফসুল আম্মারা বিসসুয়ে" নিশ্চয়ই নফসে আম্মারা কুমন্ত্রণা প্রদানকারী। তার থেকে বাঁচার জন্য রব তাকে বেশ কিছু বাক্য শিক্ষিয়ে দিলেন। কি সেই বাক্য? সেই বাক্য হলোঃ"রাব্বানা (আমাদের রব) লা (না ) তুয়াখিজ (পাকড়াও কর, ধৃত কর, অপরাধী বলিয়া রায় দাও, দোষ দাও, নিন্দা কর, দন্ডাদেশ দাও, ব্যবহারের অযোগ্য বলিয়া রায় দাও, অগ্রাহ্য কর) না (আমাদের) ইন (যদি) নাসিনা (আমরা বিস্মৃত হই, আমরা ভুলিয়া যাই) আও (অথবা) আখতোয়ালনা (আমরা ত্রুটি করিয়া ফেলি, ভুল করি, হতচকিত হই, স্থলস করি, দোষ করি, ক্ষতি করি, হানি করি) অর্থঃ (হে) আমাদের রব আমাদেরকে পাকড়াও করিও না যদি আমরা ভুলিয়া যাই অথবা আমরা ত্রুুটি করিয়া ফেলি। রাব্বানা (আমাদের রব) ওয়া (এবং) লা (না) তাহমিল (চাপাইয়া দেওয়া, বহন করা) আলাইনা (আমাদের উপর) ইসরান (বোঝা, দায়িত্ব, দায়, কঠিন কাজ, ভার, মোট, যাহা বহন করা হয়) কামা (যেমন) হামালতাহু (তাহা তুমি চাপাইয়া দিয়াছিলে) আলা (উপর) আললাজিনা (যাহারা) মিন (হইতে) কাবলিনা (আমাদের পূর্বে) অর্থঃ(হে) আমাদের রব এবং চাপাইয়া দিও না আমাদের উপর বোঝা যেমন তাহা তুমি চাপাইয়া দিয়াছিলে (তাহাদের) উপর যাহারা আমাদের পূর্বে হইতে (ছিল) রাব্বানা (আমাদের রব) ওয়া (এবং) লা (না) তুহামমিলনা (আমাদের উপর চাপাইও না) মা (যাহা) লা (নাই) তাকাতা (শক্তি) লানা (আমাদের) বিহি (ইহা দিয়া, তাহার সঙ্গে, উহার দ্বারা) অর্থঃ (হে) আমাদের রব এবং আমাদের উপর চাপাইও না যাহা আমাদের শক্তি নাই তাহার সংগে। ওয়াফু ( এবং মুছিয়া ফেল, এবং মোচন করিয়া দাও, এবং দুর করিয়া দাও, এবং নিশ্চিহ্ন করিয়া দাও) আন্না (আমাদের হইতে) অর্থঃ এবং মুছিয়া ফেল আমাদের হইতে। ওয়াগফিরলানা (এবং আমাদেরকে ক্ষমা কর) ওয়ারহামনা (এবং আমাদেরকে রহম কর) আনতা (তুমি) মাওলানা (আমাদের অভিভাবক) ফানসুরনা (সুতরাং আমাদেরকে সাহায্য কর) আলা ( উপর) কাওমি (কওমের) কাফেরিনা (কাফের) অর্থঃ এবং আমাদের ক্ষমা কর এবং আমাদের রহম কর তুমি আমাদের মওলা সুতরাং আমাদের সাহায্য কর কাফের কওমের উপর

চা খেতে খেতে মাকসুদ সাহেব মুগ্ধ হয়ে আফজাল স্যারের কথা শুনছিলেন। আর তিনি মনে মনে মেলাতে লাগলেন পুতুল নাচের অনুষ্ঠানটির সাথে। একই ব্যক্তি একাধিক স্বরে কন্ঠ পরিবর্তন করে রুপ দান করে যাচ্ছে অবলীলায়। তাহলে আমাদের পেছনে কি সেই অদৃশ্য শক্তির সুতোর টানটা কাজ করছে? যাত্রা পালায়ওতো একই অবস্থা। কেউ আড়াল থেকে শিক্ষিয়ে দিচ্ছে। চরিত্রে অভিনয়রত চরিত্রটা সেটা শুনে শুনে অাওড়িয়ে যান অভিনয়ের জগতে। আফজাল স্যার যে সেক্সপিয়ারের কথা বললেন তিনি হয়তো গভীরভাবে অবলোকন করেছিলেন স্রষ্টার সৃষ্টির নাটকটি। যেটা হয়তো আমরা করিনি।

-কি বুঝলেন মাকসুদ সাহেব?

-বুঝলাম পুতুল নাচার মতোই আমরা নাচছি।আমাদের নাচাচ্ছে আমরা নাচছি। সবইতো সেই পুতুল নাচের কর্তা ব্যক্তির হাতে। সুতোয় বাঁধা অদৃশ্য শক্তিতে আমরা বন্ধী। আর সেটা লক্ষ্য করেই হয়তো নজরুল ইসলাম বলেছিলেনঃ খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশুর আনমনে...প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা...

- হা...হা... আফজাল সাহেব সশব্দে হেসে উঠলেন। চলুন উঠা যাক। বেশ রাত হয়েছে।

মুকতার মিয়ার চায়ের দোকান হতে তারা বাড়ীর পথ ধরলেন। অগ্রায়হণ মাসের মাঝামাঝিতে শীতের আগমণের বার্তা মনে হয় প্রকৃতি জানান দিচ্ছে। আকাশের বুকে বড়ো গোলাকার চাঁদটা তখন শীতের কুয়াশায় ঘেরা। চারদিকে হাল্কা কুয়াশায় প্রকৃতি সেজেছে আজ নবরুপে। মধ্যরাতের মেঠো পথে আফজাল স্যার আর মাকসুদ সাহেব উপভোগ করছেন স্রষ্টার সাজানো প্রকৃতির আবিলতা। আর দুর হতে শুনতে পাচ্ছেন মাইকের আওয়াজে বাউল গান। রজব বয়াতি গাইছে ....আল্লাহ কে বোঝে তোমার অপার লীলে...তুমি আপনি আল্লাহ ডাকো আল্লাহ বলে..। অন্য দিকে যাত্রা পালার কথা ভেসে আসছে.... না... না... এ হতে পারে না। তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে..আমি যা বলবো তুমি সে মতেই কাজ করবে...কিন্ত্তু তুমি এ কি করলে....
নীরবতা ভেংগে আফজাল স্যার বললেন

-মকসুদ ভাই দ্যাখেন আপনি দুর হতে কিন্ত্তু সবকিছুই সুন্দরভাবে শুনতে পাচ্ছেন। অথচ যখন কাছে ছিলেন তখন কোলাহলে কিছুই শুনতে পাননি। অথচ নীরবতায় আপনি কিন্ত্তু সবই শুনতে পাচ্ছেন।

-হটাৎ এ কথা কেন?

-কারণ Silence is language of God Almighty. এই সর্বশক্তিমানের কথা শোনার জন্যই নীরবতার প্রয়োজন। কোলাহল নয়। তাই যারা স্রষ্টার এ বাণী শুনতে চান তারা লোকালয়ে বাস করেন না। লোকালয়ের ভীড়ে তারা নিজ ভুবনেই বেশি বিচরণ করেন। এটাকেই সুফী ভাষায় বলা হয় মোরাকাবা মোশাহেদা। বাংলায় ধ্যান। ইংরেজীতে মেডিটেশন।

মকসুদ সাহেব আর কোন কথা না বলে নীরবে শুনার চেষ্টা করলেন স্রষ্টার সেই বাণী।....