পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৭

ধ্যানে দেহ জগত দর্শন- পর্ব ১৯

(পুর্ব প্রকাশের পর হতে) 

“ এই সবই তো প্রহেলিকা,তবু মনে জোর আকাঙ্ক্ষা, 
সঙ্গে থাকো সর্বক্ষণ, তাই নমি অনুক্ষণ”। 

অন্তর্জগতের এই যে রহস্যময় ক্ষেত্র এটা শুধু রহস্যময় অনুভুতিই নয়, বাস্তব বিশ্লেষণী বুদ্ধিতেও এর অস্তিত্ব ধরা পড়েছে। এ নিয়ে আজকাল রীতিমত রিসার্চ হচ্ছে প্যারাসাইকোলজী ডিপার্টমেন্টে। প্যারাসাইকোলজী বা অধিমনোবিজ্ঞানে একটি জিনিস ধরা পড়েছে যে, বহিরিন্দ্রিয় বন্ধ করলে মানসিক কার্যকলাপের ক্ষমতা বেড়ে যায়। মণি তখন ইন্দ্রিয়ের কাজগুলির দায়িত্ব গ্রহন করতে পারে। শুধু পারে তা নয়,এমন সব অদ্ভুত কাজ সে করতে পারে, যাকে বলা যায় অতিন্দ্রিয় দর্শন। 

প্যারাসাইকোলজীর ভাষায় E.S.P অর্থাৎ ‘EXTRA SENSORY PERCEPTION’। প্যারাসাইকোলজীতে সমীক্ষা করে দেখা গেছে যে, বহিরিন্দ্রিয় বন্ধ হলে অতিন্দ্রিয় দর্শনের ক্ষমতা বেড়ে যায়। চর্মচক্ষে না দেখা গেলেও অনেক কিছুই দৃষ্টিগোচর হয়। অদ্ভুত ধরনের এক টেলিপ্যাথিক ক্ষমতা জন্মে যায় মনের। কিন্তু কিভাবে এই ক্ষমতা জন্মে, কিভাবে এই অতিন্দ্রিয় দর্শন হয়, সে বিষয়ে এরা তেমন ওয়াকিবহাল হতে পারেন না। বহিরিন্দ্রিয় বন্ধ করে চোখ বুজে মনের মধ্যে যে ছবি তারা দেখেন, সে ছবি কোথায় কিভাবে প্রতিফলিত হয়,এ নিয়ে তারা তেমন বিচার বিশ্লেষণ করতে পারেননি। এই যোগ ধ্যানে পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে বিশ্লেষণ করে এর যথার্থ ব্যাখা দেওয়া যায়। 

এই অতিন্দ্রিয় দর্শন হয়ত দেহের ভিতরে যে স্বচ্ছ অবস্থা আছে সেই স্বচ্ছ দর্পণ থেকে হয়, যাকে লালন বাবা ‘আরশী নগর’ বলে উল্লেখ করেছেন। পশ্চিমী অধিমনোবিজ্ঞানে এই অতিন্দ্রিয় দর্শন সম্পর্কে সমীক্ষা করা হয় ‘টেলিপ্যাথির’ আকারে। যেমন একটি SOUND PROOF ঘরে কাউকে বসিয়ে দেওয়া হল- তাঁর চোখ এবং কান বন্ধ করে দেওয়া হল, পাশের ঘরে একজন কতগুলি ছবির উপর মনোনিবেশ করলেন। তিনি যে বিশেষ ছবিটির উপর মনোনিবেশ করলেন রুদ্ধকক্ষে চোখ কান বন্ধ অবস্থায় পরীক্ষার্থী ব্যক্তিটিকে দেখা গেল ঠিক সেই ছবিটির বর্ণনাই দিচ্ছেন। পরে যখন তাকে অনেকগুলি ছবি দেখানো হল তার মধ্যে থেকে ঠিক সেই ছবিটিই তিনি নির্ভুলভাবে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিলেন। এধরনের দর্শনকে প্যারাসাইকোলজীতে ‘টেলিপ্যাথি’ বলে অর্থাৎ একজনের চিন্তা তরঙ্গ আরেকজনের মস্তিষ্কে আঘাত করে অনুরূপ ছবি ফুটিয়ে তুলেছে। পশ্চিম জগত একে মনের একটি বিশেষ ক্ষমতা বলে ধরে নিয়েছে। মনের এই বিশেষ ক্ষমতা প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই আছে। তবে বিষয়ের দর্শন যে সবসময় যথাযথ হয়,তা নয়। অনেক সময় প্রতীকের মধ্য দিয়ে পরীক্ষার্থী নিরীক্ষামূলক বিষয়টিকে দেখতে পান, বস্তুত অতিন্দ্রিয় দর্শন কখনও কখনও প্রতীকের মধ্যে দিয়ে সেকথা বলে। ঐশ্বরিক জগতের ভাষা এই প্রতীকময়তা দিয়েই তৈরি, যেকথা পরে বলব। 

এবার আমরা রামপ্রসাদ সেনের গানটির যথার্থ স্বরূপ ব্যাখ্যা করছি যা তথাকথিত পণ্ডিত ব্যক্তির পক্ষে বিশ্লেষণ দ্বারা ধরা সম্পূর্ণ অসম্ভব। রামপ্রসাদ লিখেছেন ‘এবার কালী তমায় খাবো।” বাহ্য অর্থে এতো একটি রাক্ষুসে ক্ষুধার পর্যায়ে পড়ে। এ যেন আফ্রিকার নরখাদক কোন কবির লেখা গান। অন্তর্জগতে যার প্রবেশাধিকার নেই এমন পশ্চিমী বিদ্যায় শিক্ষিত ব্যক্তির কাছে এই গানটি ‘NONSENSE VERSE’ এর চাইতেও Absurd প্রমানিত হতে পারে। কিন্তু দেহতত্ত্ব জ্ঞাত হবার পর এ গানের লাইনটির দিকে একটু যদি বিশ্লেষণী মানসিকতা নিয়ে তাকানো যায় তাহলে গভীরতর এক দর্শন এর মধ্য থেকে আত্মপ্রকাশ করে। ‘মা কালী হলেন আদি শক্তি,যাকে বলে আদ্যাশক্তি PRIMAL ENERGY KINETIC IN NATURE’। শূন্যে সুপ্তাকারে স্থিত এই শক্তি স্বভাব গুনে নড়ে চড়ে ওঠা মাত্র সময় বা কালের (TIME)উদ্ভব হয়েছে। কালের জন্মদাত্রী বলেই তিনি ‘মা কালী’। এই শক্তিই গোলাকার ব্রহ্মাণ্ডরূপে জগত হয়েছেন। কিছুটা শক্তির ঘূর্ণনের ফলে ‘ELLIPTICAL’ কিংবা ‘OVAL’।মানুষের দেহের মধ্যে এই জগতের ক্ষুদ্র সংস্করণ কাজ করছে ব্রহ্মরন্ধ্র থেকে মুলাধার পর্যন্ত। চলবে............