পৃষ্ঠাসমূহ

মঙ্গলবার, ৮ আগস্ট, ২০১৭

ধ্যানে দেহ জগত দর্শন- পর্ব- ১১

(পুর্ব প্রকাশের পর হতে)

“মৌলিকহীন তাই যা কষ্ট যোগ
 বিয়োগের অতি পুষ্ট।”

ভারতীয় তন্ত্রশাস্ত্রের উল্লেখিত সব প্রক্রিয়া তত্ত্বই যে নির্ভুল এবং বৈজ্ঞানিক তা নয় এবং অনেক ক্ষেত্রেই তা ভ্রান্ত এবং ক্ষতিকারক। যেমনঃ এমন অনেক গুরু আছেন যারা ধ্যানকালে শিষ্যের মনচাঞ্চল্য দেখলে তার নিন্দা করেন। কিন্তু এত বড় ভ্রান্তি আর নেই। প্রকৃতপক্ষে মনচাঞ্চল্য এবং মনের নানা ধরনের চিন্তা আত্মতত্ত্ব জানার ক্ষেত্রে বড় সহায়ক। ‘PARAPSYCHOLOGY’ পরীক্ষা করে দেখেছে যে, স্বপ্ন মানুষকে সুস্থ রাখার পক্ষের বড় সহায়। 

মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনে নানা অবাঞ্ছিত ঘটনা এবং অপ্রাপ্তির বঞ্চনার সম্মুখীন হয়। সেগুলো তার মনের ভিতর জমে থেকে অশান্তি সৃষ্টি করে। এই তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলি যদি বেরুবার পথ না পায়, তাহলে মানুষের জীবনে নানা বিপত্তি ঘটতে পারে। সাধারণতঃ দেখা যায় তারা উন্মাদ হয়ে যায়। মানুষ প্রতি রাতে স্বপ্ন দেখে বলে এই উন্মাদ হয়ে যাবার সম্ভাবনার হাত থেকে রক্ষা পায়। প্রতিটি মানুষ প্রতি রাতে কমপক্ষে চার বা ততোধিক স্বপ্ন দেখে। মনের মধ্যে চেপে থাকা এই নানা তিক্ত অভিজ্ঞতা স্বপ্নের আকারে তার মধ্য থেকে বেরিয়ে যায় । এই স্বপ্ন ‘NON R.E.M ও R.E.M’ জাতের। অর্থাৎ প্রথম রাতে মানুষ যে স্বপ্ন দেখে তাতে তার চোখের পাতা কম আন্দোলিত হয়। একে বলে ‘NON RAPID EYE MOVEMENT’। শেষের দিকে যে স্বপ্ন দেখেন, তাতে চোখের পাতা বেশি কাঁপে। যাকে বলে ‘R.E.M’ অর্থাৎ ‘RAPID EYE MOVEMENT’। তার এই স্বপ্ন দেখা ‘ E.E.G’ অর্থাৎ ‘ELECTRO ELECTROENCEPHALOGRAPH’ নামক যন্ত্রে ধরা পড়েছে। স্বপ্ন দেখে বলেই মানুষ নরমাল থাকে। যাদের স্বপ্ন দেখা বন্ধ হয়ে যায়, তারা ক্রমশই উন্মাদ রোগগ্রস্ত হয়। একে বলে ‘APPROACHING SIGN OF INSANITY’ 

স্বপ্ন দেখলেও যে মানুষের ভিতরকার সকল অবরুদ্ধ বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতাই দূর হয়ে যায় তা নয়। কিছু কিছু থেকে যায়। সেগুলোই সে যখন কোন কিছুতে একাগ্রচিত্ত হতে চায়, তখন নানা চিন্তার আকারে বাইরে আসতে থাকে। এইভাবে কিছুদিন চলার পরে দেখা যায় যে, তেমনভাবে বিশৃঙ্খল চিন্তা ভাবনা আর তার ভেতর থেকে বেরুচ্ছে না। ক্রমশই তার দেহ হালকা হতে থাকে। ক্রমশই স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার মধ্যে সংযম দেখা দেয়। তার নানা দূরদর্শন ও দুরশ্রুতি হতে থাকে।

ব্রহ্মাণ্ডের নানা অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিসও তার নজরে পড়ে। এর কারন তখন তার শক্তির মাত্রা বৃদ্ধি পায়। শাসন করে যারা মনকে সংযমে রাখতে চায়। তারা আসলে মনের কতগুলি স্বাভাবিক ক্রিয়াকে অবরুদ্ধ করে রাখে। মানুষের ভিতর নানা যে সুক্ষ্মাস্তর আছে, অবরুদ্ধ কামনা-বাসনাগুলি তখন তার উপর আবরণ সৃষ্টি করে তার দৃষ্টিকে ঢেকে দেয়। এবং তাদের পক্ষেই সহজে অতিন্দ্রিয় জগতে পৌঁছানো কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। ‘ব্রহ্মচর্য’ মানে যে নিশ্পাত বীর্যধারণ তা নয়। ‘ব্রহ্মচর্য’ অর্থ হল সংযম, সাম্য, BALANCE । হিন্দুমতে, মানুষ তিন গুনের অধীন। সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ । এই তিন গুণের কোন গুন অতিরিক্ত প্রবল হলে সাম্য নষ্ট হয়। হিন্দুদের জীবনে আছে চারিটি আশ্রম – ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বাণপ্রস্থ ও সন্ন্যাস। এর মধ্যে সংযম থাকলেই যথার্থ ব্রহ্মচর্য হয়। 

হিন্দুমতে আছে, ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ অর্থাৎ সংসার, সমাজ ও রাষ্ট্রের নিয়ম মেনে চলা, টাকা-পয়সা উপার্জন করা, ভোগ করা আবার সত্যজ্ঞান লাভ করে মোক্ষ লাভ করা। এই চারটি আদর্শের মধ্যে যিনি সাম্য রাখতে পারেন, তিনিই ‘ব্রহ্মচারী’। ব্রহ্মাচার্য যদি নিশ্পাত বীর্যধারণ হত তাহলে বিশিষ্ট শত পুত্রের জনক হয়েও ‘ব্রাহ্মণ’ শ্রেষ্ঠ হতেন না বা যাজ্ঞবল্ক্য দুই বিবাহ করেও ব্রহ্মাজ্ঞ পুরুষ হতে পারতেন না।

 চলবে..................