পৃষ্ঠাসমূহ

মঙ্গলবার, ২২ আগস্ট, ২০১৭

ধ্যানে দেহ জগত দর্শন - পর্ব ২১

 (পুর্ব প্রকাশের পর হতে)

মানব জীবের জড় প্যাঁচ খুলে সে যখন অন্তরস্থ জ্যোতিতে প্রবেশ করে,বিশ্বও বিপরীত দিকে তার প্যাঁচগুলি খুলে তার অন্তরঃস্থ জ্যোতি প্রকাশ করে। সুক্ষ্মতম ব্যবধানের মধ্যে দিয়ে এক জ্যোতি অপর জ্যোতির সঙ্গে মিশে যায়। যেমনঃ কাঁচের জানালা দিয়ে সূর্যের আলো ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে। ভগবত গীতার এই শ্লোকটির ভাবও যারা আত্মতত্ত্ব ও জগততত্ত্ব জানেন না, তাদের পক্ষে ভাষ্য পড়েও কোনদিন প্রকাশ করা সম্ভব হবে না। সঙ্গে একটু বিজ্ঞান পরিচয় থাকাও প্রয়োজন। ভগবত গীতায় জগতের স্বরূপ ব্যাখ্যা করা হয়েছে এইভাবেঃ- 

“এই সংসার রূপ মায়াময় বৃক্ষের মুল (কারণ) উর্ধ্বে মায়াশক্তি বিশিষ্ট ব্রহ্মে হিরন্য গর্ভাদি শাখা নিম্ন দিক। কর্ম কাণ্ডরূপ বেদসমুহ ইহার কাণ্ড।” অর্থাৎ সংসার রূপ জগত বৃক্ষের মুল উর্ধ্বে। শাখা প্রশাখা,কাণ্ড ইত্যাদি নিচের দিকে। 

যোগদর্শনজাত গীতার এই জগত বর্ণনা যে কতটা সত্য অধুনা ASTRO PHYSICS ও তা অনুমোদন করেছে। কারণ ASTROPHYSICS এর ‘BIG BANG’ তত্ত্ব বা ‘STEADY STATE’ তত্ত্ব এ কথাই বলে যে, কোন কেন্দ্রস্থিত বস্তুকনা সমূহে শক্তির বিস্ফোরণের ফলেই গোলাকার জগতে সৃষ্টি। এই শক্তি ঘূর্ণায়মান হবার জন্য কিছুটা ‘ELLIPTICAL’ বা ‘OVAL’ মুলত গোলাকৃতি। যেখান থেকে জগত বিস্ফরিত হয়ে সৃষ্টি হয়েছে সেটাই তার কেন্দ্র। ছবিটি দাঁড়ায় এরকমঃ



এই গোলাকার জগতের যেদিক থেকেই কেন্দ্রের অভিমুখে যাওয়া যাক না কেন, কেন্দ্রকে উর্ধ্বমুখী মনে হবে। সুতরাং জগত (সম্প্রসারনশীল গোলক) এর মুল উর্ধ্বে ও ডালপালা অর্থাৎ সুক্ষ্মাংশ থেকে স্থুল অংশ নিচের দিকে। 

বস্তুবিজ্ঞান, আত্মজ্ঞান এবং অন্তর্জগতের স্বরূপবোধ হলে তবেই এই শ্লোকটি ব্যাখ্যা করা সম্ভবঃ “চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে আমরা ভেবে করবো কি?” গানটি বরং ভগবতগীতার উপরক্ত শ্লোকটি থেকেও দুরহ। কারণ দেহের অভ্যন্তরে কুল কুণ্ডলিনীকে জাগ্রত করে উর্ধ্বপর্যায়ে নিয়ে যেতে না পারলেও গানের অন্তঃর্নিহিত রহস্য কারও পক্ষে ভেদ করা সম্ভব নয়। দেহতত্ত্ব অংশে মুলাধারস্থ শক্তির উর্ধ্বগতির ফলে অন্তর্দৃষ্টিতে কিভাবে নানা রঙের খেলা দেখা যায়,  সেটা পুর্বেই ব্যক্ত করেছি। 

প্রকৃতপক্ষে অন্তরসত্ত্বা রীতিমত উজ্বল হয়ে ওঠে চেতনা কে ‘মনিপুর’চক্র অবধি ওঠালেই অনাহত চক্রের নীল আকাশে চেতনা উঠলে প্রায়শই মনে হয়, আকাশ যেন সহস্র চন্দ্র কিরণে উদ্ভাসিত। সেই স্নিগ্ধ জ্যোতি অন্তর আকাশের চন্দ্র কিরণ দেখিলে প্রাণে এক অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করা যায়। 

গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় খোলা ছাদে দক্ষিণ সমুদ্রের ভেজা হাওয়া গায়ে লাগলে যেমন স্নিগ্ধ ও তৃপ্ত ভাব বোধ হয়, এই দর্শনজাত ভাব ও অনুভুতিও তেমনি। সাধক অন্তর আকাশে এই জ্যোৎস্নার লাবন্য দেখে মুগ্ধ হয়ে যান। তন্ত্রে এই জন্য এই আকাশকে বলা হয়েছেঃ  ‘কোটি চন্দ্র সুশীলতম’ অর্থাৎ কোটি চন্দ্র যেন এই আকাশকে সুশীতল করে রেখেছে। এই চন্দ্র কিরন ধৌত আকাশ দেখেই দেহতত্ত্ব কবি মুগ্ধ হয়ে লিখেছেন- “চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে আমরা ভেবে করবো কি।” ‘

আমরা ভেবে করবো কি?” কথার অর্থ হলঃ বিচার বিশ্লেষণী বুদ্ধিতে এর কারণ ধরা পড়বার নয়। রবীন্দ্রনাথের “এই জ্যোতি সমুদ্রে মাঝে যে শতদল পদ্মরাজে তারই মধুপান করেছি ধন্য আমি তাই।” এর ব্যাখ্যাও কোন বাংলার অধ্যাপক করবেন? 

উপরে যে দেহতত্ত্ব বিশ্লেষণ করেছি তাতে কোথায় জ্যোতিসমুদ্র তার কথা বলেছি। আসল জ্যোতিসমুদ্র হল ‘বিন্দু’। কিন্তু এই জ্যোতিদর্শন আরম্ভ হয় ‘মনিপুর চক্র’ থেকেই। মনিপুর চক্র থেকে সহস্রারের মুল জ্যোতি পর্যায় পর্যন্ত ওঠাকালে জ্যোতির মধ্যভাগে সাধকরা “বিন্দুর” অস্তিত্ব দেখতে পান। 

চলবে............