উৎসর্গ : মনিরুদ্দীন ইউসুফ
তাঁর শাহনামা অনুবাদ সমুখে শ্রদ্ধায় সবিনয় নিবেদন তবে এই! এ জীবন এক সরাইখানা। এখানে বইছে
শরাব, মাটির সোরাহি থেকে তো নয়, বইছে বেহেশতেরই সালসাবিল নহর থেকে নির্মল,
ভরে তুলছে এই মর্ত্যরে পেয়ালা। সেই পেয়ালার দিকেই তবে তুলে ধরা আমাদের
তৃষিত ঠোঁট। মাতাল- মাতাল হয়ে যাওয়া! আর তবেই পাবো উদ্ধার! স্বর্গীয় ডানা
পাবো মাটি ছেড়ে আকাশে উড়বার। অপিচ এ উড্ডয়ন সকল
সৌন্দর্য আর আত্মার আরামের দিব্য উৎস সকাশে পৌঁছে যাবার জন্যেই বটে। যখন
এই অবকাশটি আমাদের জন্যে আসে তখন আমরা লীন হয়ে যাই অভূত এক সৌন্দর্যে,
একাত্ম হয়ে উঠি আত্মার সঙ্গে- ফারসিতে যাকে বলি খুদি, যা থেকে খোদা
শব্দটিরও উদ্ভব। বাংলা মুলুকে আমাদের পিতামহ প্রপিতামহদের যত ঊর্ধ্বে যাই
খোদা শব্দটি ছিল তাঁদের কাছে আল্লাহর সমনাম, কিন্তু হায়, সাম্প্রতিক
মৌলবাদীদের তথাকথিত শুদ্ধতার ধমকে শব্দটি এখন দণ্ডিত ও নির্বাসিত; খেদ শুধু
এ কারণেই নয়, পরন্তু হাফিজের জন্যেই যে তাঁর শরাব-সাকি-পেয়ালার স্বর্গীয়
প্রতীকতাও এখন এ বাংলাদেশে পেয়েছে করুণ ছিন্নতা।
হাফিজের সাধনা ছিল,তৃষিতের জন্যে অমৃত
সন্ধান- পার্থিব সরাইখানায় সাকির হাতে সেই শরাব- এবং আজও তা এই সামান্য
সাধারণ আমাদেরও চাওয়া। এ তৃষ্ণা চিরকালের, শতাব্দী পেরিয়ে যায় তৃষ্ণা ও
সন্ধান তবু চলেই চলেছে। তাই হাফিজ হয়ে ওঠেন এমত অনিবার্য যে জীবদ্দশাতেই
তিনি লোকসাধারণের প্রতিদিনের উচ্চারণে উঠে আসেন; জীবন যাপনের প্রতি বাঁকে,
অভিজ্ঞতার অভিঘাতে, ফারসিভাষীদের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন নিত্য উদ্ধৃতিযোগ্য,
যেমনটি বাঙালির কাছে রবীন্দ্রনাথ। তাঁর খ্যাতি পারস্য ছাড়িয়ে তাবরিজ কি
বাগদাদ, সমরখন্দ, এমনকি বাংলা মুলুকেও পৌঁছে যায়; তাঁর এক গজলেই আমরা
সংকেত পাই, হাফিজ বলছেন- ইরানের শর্করাখ- এই যে যাত্রা করছে বাঙালার
দিকে,সে দেশের কত শত তোতাপাখি একে তুলে নেবে তাদের চঞ্চুতে, স্বাদ নেবে
আনন্দে।
আজ থেকে সাতশ’ বছর আগে ইরানের শিরাজ
নগরে জন্ম নিয়েছিলেন তিনি, নাম রাখা হয়েছিল খাজা শামসুদ্দীন মুহম্মদ,
কবিনাম নিয়েছিলেন- হাফিজ; সম্পূর্ণ কোরান তাঁর কণ্ঠস্থ ছিল বলেই এই নামটি
তিনি বেছে নেন, প্রতিটি রচনার শেষ পদে তিনি স্বাক্ষর রেখে যান এ নামে, আর এ
নামেই জগৎ তাঁকে জানে; শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে তাঁকে জেনেছিলেন আমাদের
রবীন্দ্রনাথ- বালক বেলায় তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুখে
দক্ষিণের বারান্দার সান্ধ্য অন্ধকারে সুরসহ নির্ভুল ফারসি আবৃত্তি শুনে।
পরিণত বয়সে ইরানে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ হাফিজের সমাধি পাশে যান, বিবরণে তিনি লেখেন-
এই সমাধির পাশে বসে আমার মনের মধ্যে
একটা চমক এসে পৌঁছল,এখানকার এই বসন্তপ্রভাতে সূর্যের আলোতে দূরকালের
বসন্তদিন থেকে কবির হাস্যোজ্জ্বল চোখের সংকেত। মনে হল আমরা দুজনে একই
পানশালার বন্ধু, অনেকবার অনেক রসের অনেক পেয়ালা ভরতি করেছি। আমি তো কতবার
দেখেছি আচারনিষ্ঠ ধার্মিকদের কুটিল ভ্রুকুটি। তাদের বচনজালে আমাকে বাঁধতে
পারে নি; আমি পলাতক, ছুটি নিয়েছি অবাধপ্রবাহিত আনন্দের হাওয়ায়। নিশ্চিত মনে
হল আজ,কত-শত বৎসর পরে জীবনমৃত্যুর ব্যবধান পেরিয়ে এই কবরের পাশে এমন একজন
মুসাফির এসেছে যে-মানুষ হাফেজের চিরকালের জানা লোক।
হাফিজকে আর জেনেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর সদ্য কৈশোর পেরুনো কালেই এবং পরে অনুবাদ করেছেন হাফিজকে; নজরুল লিখছেন,
হাফিজকে আমরা কাব্যপিপাসুর দল কবি বলেই সম্মান করি, কবিরূপেই দেখি। তিনি হয়ত বা
সুফি-দরবেশও ছিলেন।…তবু তাঁর কবিতা শুধু কবিতাই। তাঁর দর্শন আর ওমর খাইয়ামের দর্শন
প্রায় এক। এঁরা সকলেই আনন্দ-বিলাসী।
ভোগের আনন্দকেই এঁরা জীবনের চরম আনন্দ বলে স্বীকার করেছেন।…তবে, এও মিথ্যা
নয় যে, মদিরাকে এঁরা জীবনে না হোক কাব্যে প্রেমের আনন্দের প্রতীকরূপেই
গ্রহণ করেছিলেন। শারাব বলতে এঁরা বোঝেন- ঈশ্বরের, ভূমার প্রেম, যা মদিরার
মতোই মানুষকে উন্মত্ত করে তোলে। সাকি অর্থাৎ যিনি সেই শারাব পান করান। যিনি
সেই ঐশ্বরিক প্রেমের দিশারী, দেয়াসিনী। পানশালা- সেই ঐশ্বরিক প্রেমের লীলা-নিকেতন।
সুফি মতবাদের শেকড়ে রয়েছে যে প্রেম
ধারণা, দেহজ প্রায়, তার আত্মভূত চিত্রটিই হচ্ছে মিলন- শরীরী এক যুগলের,
প্রেমিক-প্রেমিকারই যেনবা। নজরুল তাঁর রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ বইটি উৎসর্গ করেন
তাঁর অকালমৃত পুত্র বুলবুলের উদ্দেশ্যে, মর্মস্পর্শী ভাষায় তিনি পাঠ লেখেন,
বাবা বুলবুল! তোমার মৃত্যু-শিয়রে ব‘সে ‘বুলবুল-ই-শিরাজ’ হাফিজের রুবাইয়াতের অনুবাদ
আরম্ভ করি। যেদিন অনুবাদ শেষ করে উঠলাম, সেদিন তুমি- আমার কাননের বুলবুলি- উড়ে গেছ!
আমরাও দেখতে পাবো, মৃত্যুর এমত সন্নিধানে হাফিজ কীভাবে হয়ে ওঠেন জীবনের পাঠদাতা এক কবি। নজরুলেরই অনুবাদে আমরা পড়ে উঠব-
পরান ভরে পিয়ো শারাব, জীবন যাহা চিরকালের।
মৃত্যু-জরা ভরা জগৎ, ফিরে কেহ আসবে না ফের।
ফুলের বাহার, গোলাব-কপোল, গেলাস-সাথী মস্ত ইয়ার,
এক লহমার খুশির তুফান, এই ত জীবন!- ভাবনা কিসের?
একদিন যখন হৃদযন্ত্রের বৈকল্য কারণে
মৃত্যুর কার্নিশে আমি, অপেক্ষা করছি শল্য চিকিৎসার তারিখের জন্যে, অনিশ্চিত
এমত কালে লন্ডনের এক তীব্রশীত সন্ধ্যায় হাফিজকে প্রথম আবিষ্কার করি এ. জে.
আরবেরির ইংরেজি অনুবাদে, পুরোনো এক বইয়ের দোকানে, পাঠ করে উঠি রাতভোর
অবধি, মৃত্যু সম্পর্কে আমার যাবত ভাবনা যায় মিলিয়ে, হয়ত রবীন্দ্রনাথেই এটি
হতে পারতো, কিন্তু সমূহ সেই সন্ধ্যায় হাফিজই মুমূর্ষু আমার সমুখে মেলে
ধরলেন জীবনের মানচিত্রটি। বিশেষ করে হাফিজের সেই গজল যেখানে তিনি
নিরুদ্দিষ্ট ইউসুফের কথা বলছেন, আর ধ্রুবপদের মতো বারবার বলছেন- চোখের পানি
ফেলো না ফের, আমার চোখ ভেসে যায় জীবনের আশ্বাস ফিরে পাওয়া অশ্রুতে।
পারিবারিক পরম্পরায় হযরত শাহ সৈয়দ আলী মাহমুদের আধ্যাত্মিকতা আমার রক্তে,
সেই আমি হাফিজের রচনায় আদমের পাপশূন্য স্বর্গের রূপ প্রত্যক্ষ করে উঠি;
আবার, দ্বিতীয় পাঠে, মহাজন পদাবলী ধাবনে রক্তমাংসঋদ্ধ যে প্রেমের সাক্ষাত
বাঙালি আমি পাই, সেটিও তাঁর কবিতায় আবিষ্কার করে উঠি- আতুর প্রেমিকের মতো
বলে উঠি, অমরত্ব যদি আদৌ প্রাপনীয় তবে তা রাধারই আধারে।
ফারসি পেরিয়ে ইংরেজি ভাষ্য উজিয়ে বাংলায়
হাফিজকে যে তারপর একদিন এনে উঠি, সেটি এমন প্রেরণা থেকে যে হাফিজের রচনা
যেন বাংলা কবিতাই হয়ে ওঠে। অনুবাদের প্রথম শর্তই হচ্ছে, এক ভাষা থেকে অপর
ভাষাতেও যেন সেটি কবিতাই হয়। তবে, কলম হাতে এই যে হাফিজকে নিয়েছি, অনুবাদ
নয়, বরং রূপান্তর এবং আরো বিশেষ অর্থে বিম্বিত কবিতাই আমি রচনা করতে
চেয়েছি। হাফিজের খ- কবিতার সংকলন দিওয়ান-ই-হাফিজ-এর মোট চারশ’ ছিয়াশিটি
গজলের একাধিক ইংরেজি অনুবাদ আমি বছরের পর বছর পাঠ করেছি, দূরযাত্রায় সঙ্গে
রেখেছি, প্রবাসের নিঃসঙ্গ কামরায় এর পাতা উলটেছি এবং মাঝে মাঝেই আমার ভাষায়
হাফিজের উচ্চারণটি ধরে রাখবার খেলায় মেতেছি; এই নিমজ্জনের সম্প্রসারণেই
এখন হাফিজের সাতান্নটি পদ এখানে বাংলায় উপস্থিত করা গেলো। কোনো কোনো
ক্ষেত্রে তাঁর একাধিক গজল থেকে পঙক্তি নিয়ে নতুন একটি কবিতা দাঁড় করিয়েছি;
কিন্তু গজলের প্রথাসিদ্ধ যে-রূপ ও অন্তমিল বিন্যাসের সঙ্গে আমরা পরিচিত, তা
অনুসরণ করিনি, বরং প্রতিটি রচনার মনোভঙ্গী বুঝে এর ছন্দ-মিল-স্তবকের শরীরী
কাঠামো বাংলায় গড়বার চেষ্টা করেছি। আমার এই রচনা-স্বাধীনতা নিশ্চয়ই শিরাজ
নগরের সেই বুলবুল কবির অনুমোদন পাবে, নয়তো যদি ভাগ্যে হয় তবে তাঁর সমাধিতে
গিয়ে একদিন নতজানু হবো, হয়ত তখন তাঁর ‘হাস্যোজ্জ্বল চোখের সংকেতে’ ফুটে
উঠবে অমর এ কবির মার্জনা।
১লা নভেম্বর ২০১৩
সৈয়দ শামসুল হক